সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু হোক
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির স্বীকৃতির পরবর্তীকালে দেখা গেছে বাংলা সাহিত্যের প্রসারে বাঙালি কবি সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিকদের নতুন নতুন বই লিখতে ও প্রকাশ করতে, বই মেলার প্রচলন হতে, ধীরে ধীরে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটতে। বস্তুত সমাজে এক বিশাল ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে সমাজদেহ থেকে সাম্প্রদায়িকতা উচ্ছেদ বা হ্রাসের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
তারাপদ আচার্য্য
আজ অমর একুশে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি' রক্তে রাঙানো সেই ফেব্রম্নয়ারি মাস, ভাষা আন্দোলনের উজ্জ্বল প্রতীক। আজ চারদিকে ধ্বনিত হবে সেই অমর সঙ্গীতের অমিয় বাণী। বাঙালি জাতি আজ শ্রদ্ধা ভালোবাসা জানাবে- ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ফেব্রম্নয়ারি ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিবাদ প্রতিরোধ এবং জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষকাল।
আমরা জানি, ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দুর্বার আন্দোলনে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পায় মাতৃভাষার মর্যাদা এবং আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। তারই পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং একাত্তরে নয় মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
বস্তুত ফেব্রম্নয়ারি মাস একদিকে শোকাবহ হলেও অন্যদিকে আমাদের জাতীয় জীবনে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। কারণ পৃথিবীর একমাত্র জাতি বাঙালি, যারা ভাষার জন্য এ মাসে জীবন দিয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রম্নয়ারির প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় নানা কর্মসূচি। সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানা সংগঠন আজ নানা কর্মসূচির আয়োজন করবে।
এক কথা সত্য, ভাষা আন্দোলনের বহুমাত্রিক অর্জন আমাদের জানা। তবুও নতুন নতুন প্রজন্মের আগমনের কারণে এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদাসীনতার সুযোগে যে সব অর্জন কার্যত ইতোমধ্যেই ফিকে হয়ে এসেছে। দেশের সচেতন মানুষের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধ্যমতো সেগুলো তুলে ধরা। যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আবার নতুন উৎসাহে হারানো বিজয়গুলো পুনরায় অর্জন করতে পারে এবং তার মাধ্যমে দীক্ষিত হতে পারে।
উলেস্নখ্য, ভাষা আন্দোলনের চেতনার পথ ধরে সবাই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেন। শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, সঙ্গীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, বাদ্যশিল্পী, ছাত্র ও যুব সংগঠন, নারী সমাজসহ সমগ্র বাঙালি জাতি। ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছরে এটা আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন।
আমাদের সবারই মনে আছে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টে। ছয় থেকে সাত মাস যেতে না যেতেই ১৯৪৮ সালের মার্চে বাঙালি তরুণরা 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' বলে মাঠে নেমে পড়লেন। তাদের যে উদ্দীপনা দেশপ্রেম ভাষাপ্রেম আজ তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। কারণ ১৯৪৭ সালে মূলত অসাম্প্রদায়িক শক্তির পরাজয় ঘটেছিল, সেখানে ১৯৪৮-এর শুরুতেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ভিত্তিমূলেই আঘাত হানার মাধমে সেই শক্তি আবার জেগে ওঠে। এত দ্রম্নততার সঙ্গে আন্দোলনটির সূচনা হলো যে, ব্যাপক মানুষের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে তা বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির স্বীকৃতির পরবর্তীকালে দেখা গেছে বাংলা সাহিত্যের প্রসারে বাঙালি কবি সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিকদের নতুন নতুন বই লিখতে ও প্রকাশ করতে, বই মেলার প্রচলন হতে, ধীরে ধীরে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটতে। বস্তুত সমাজে এক বিশাল ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে সমাজদেহ থেকে সাম্প্রদায়িকতা উচ্ছেদ বা হ্রাসের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনেপ্রাণে ও চিন্তাচেতনায় আজন্ম বাঙালিসত্তাকে বুকে ধারণ করে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে নিঃস্বার্থ হৃদয়ে ভালোবেসেছেন। তিনি ছিলেন একজন খাটি বাঙালি। 'কারাগারের রোজনামচা'য় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, "অনেকক্ষণ শুয়ে ছোটবেলার কত কাহিনিই না মনে পড়ল। কারণ আমি গ্রামের ছেলে। গ্রামকে আমি ভালোবসি।" নিজের পরিধেয় বস্ত্র সম্পর্কে বলেন, "আমি তো লুঙ্গিই পরি।" (ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু ভূমিকা, হারুন অর রশিদ, পৃষ্ঠা-৬৬] আমৃতু্য বাঙালি ও মাতৃভাষাপ্রেমি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি ও বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা ও স্বীকৃতি অর্জনে ছিলেন সর্বদা আপসহীন। ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্ব থেকে পরবর্তীতে বাংলা ভাষার যথাযথ মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল বিশাল অবদান। তিনি আজীবন বাংলা ভাষার উন্নয়ন, বিকাশ ও বাংলা ভাষাবিদদের দাবির কথা বলে গেছেন। ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল বিশাল অবদান।
\হআশার কথা, আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, গড় মাথাপিছু আয় বেড়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, গড় আয়ু বেড়েছে। আমরা বিশাল বিশাল বাজেট পাস করছি তাও সত্য। কিন্তু মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য কি কমেছে? সর্বস্তরে বাংলাভাষা কি চালু হয়েছে? একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রর্বতন ছিল আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার। জাতীয় শিক্ষানীতি কি আমরা একমুখী করতে পেরেছি? ভাষার মাসে এসব প্রশ্ন সামনে চলে আসে। ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে এ কথা আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, বাঙালি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনের বিপুল অর্জনের পাশাপাশি আমাদের ব্যর্থতাও রয়েছে। এই ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে হবে। এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
তারাপদ আচার্য্য : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক