সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবন

বরকত আলী, শিক্ষার্থী, দিনাজপুর সরকারি কলেজ
  ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবন

জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশসহ পুরো পৃথিবীকে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মূলত এমন ঘটনাকে বোঝানো হয়, যা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি এবং মানুষের প্রাত্যহিক স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত করে। মানুষ ও পশুপাখির প্রাণহানির পাশাপাশি মানুষের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি, পরিবেশের ক্ষতিসহ অসংখ্য ক্ষতিসাধন করে। ফলে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনে এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম- ঘুর্ণিঝড় ও বন্যা। আর ঘুর্ণিঝড়ের সঙ্গে সুন্দরবনের নামটিও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সুন্দরবন অবস্থিত। যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগণা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা এলাকাজুড়ে এই অপরূপ বনভূমি বিস্তৃত। যার আয়তন প্রায় ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে এবং বাকি অংশ রয়েছে ভারতে। এই বনভূমি প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি প্রাণী ও ভেষজ উদ্ভিদের আঁধার। যেখানে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, কুমির, সাপ, বানর ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখিসহ অসংখ্য প্রাণীর আবাসস্থাল। উলেস্নখ্য, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯৭ খ্রিষ্টস্টাব্দ ইউনেস্কো বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে সুন্দরবনকে স্বীকৃতি দিয়েছি। পরিবেশে অক্সিজেন দিয়ে এবং পরিবেশ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে পরিবেশকে বিশুদ্ধ রাখতে সুন্দরবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি এই বন প্রাকৃতিক দুর্যোগ রক্ষা করাসহ উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবিকা নির্বাহের একটি বড় উৎস হিসেবে কাজ করে। পর্যটনশিল্পের জন্যও এই বন গুরুরূপূর্ণ। প্রতিবছর এই বন দেখতে ভিড় জমায় দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক। আর বাংলাদেশের বনবিভাগের রাজস্ব আয়ের অধিকাংশ আসে এই বন থেকে, যা সরাসরি দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব রাখে। কিন্তু এরপরও সুন্দরবনের অমূল্য সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ বা তদারকির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এমনকি প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মহল থেকে সময় সময় এই বনকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা চলছে। সুন্দরবনকে ঘিরে নানান পরিকল্পনার কথা শোনা যায় হরহামেশাই। এই বনের চারপাশে শিল্পকারখানা স্থাপন, অবাধে গাছপালা কেটে বসতিস্থাপন করে ক্রমেই সুন্দরবনের অস্তিত্ব ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের আয়তন ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। এতকিছুর পরও থেমে নেই বন ধ্বংসের প্রক্রিয়া। কিছু প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বের অন্য যেকোনো উপকূল অঞ্চল থেকে বঙ্গোপসাগরের উত্তর উপকূল জলোচ্ছ্বাসের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। বলা যায়, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশর অবস্থানের কারণে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সবচেয়ে বেশি মোকাবিলা করতে হয়। আর মায়ের আঁচলের মতো ঢাল হয়ে খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের উপকূল রক্ষা করে চলছে আমাদের সুন্দরবন। বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ছোট-বড় ঘুর্ণিঝড়ের সামনে সুন্দরবন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, ফলে এটি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমে যায়। বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকাতে বনায়ন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। আর বাংলাদেশে এমনিতেই প্রয়োজনীয় বনভূমি নেই। একটি দেশের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা উচিত, কিন্তু তা আমাদের নেই। আর আইলা, সিডর কিংবা বুলবুলই শেষ দুর্যোগ নয়, বরং সামনে আরও বড় বড় দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হতে পারে। সুন্দরবন আমাদের পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলাসহ আমাদের জাতীয় জীবনে কতটা ভূমিকা রাখছে, তা বর্ণনাতীত। তাই এই বনের কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই। সুন্দরবনকেন্দ্রিক জীবিকানির্বাহ করছে তাদের বিকল্প আয়ের পথ গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা বনের ক্ষতিসাধন না করে। বনের ভেতর অভয়াশ্রম গড়ে তোলাসহ সুন্দরবন রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের ফুসফুসের ন্যায় সুন্দরবন। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে ধ্বংস হবে সুন্দরবন। আর সুন্দরবন ধ্বংস মানে আমাদেরই ধ্বংস। তাই সুন্দরবন রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ ব্যক্তিগত পর্যায় থেকেও কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারি মহলকে এ বিষয়ে আরও কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। শুধু সুন্দরবন রক্ষা নয়; বরং দেশের সব বনায়ন রক্ষাসহ বনায়ন বৃদ্ধিতেও মনোযোগ দেওয়া জরুরি। তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে টিকিয়ে রাখি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে