বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশেই বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি সংক্রান্ত আলোচনা-সমালোচনা এখন তুঙ্গে। ইউটিউবভিত্তিক চ্যানেল সার্চ অব মিস্টেরি 'হোয়াই এন্টি-ইন্ডিয়া সেন্টিমেন্ট ইজ গ্রোয়িং ইন মালদ্বীপ, বাংলাদেশ অ্যান্ড নেপাল?' শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সম্প্রতি। প্রতিবেদনটি স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমেও ছাপা হয়েছে। সার্চ অব মিস্টেরি'র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম দেশ এবং বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী। স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশটি বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে দুই দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যে ভারতবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠেছে তা ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে নয়। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের বিশ্লেষকরাও মনে করেন, ভারত সরকারের কিছু নীতি এই মনোভাবকে প্রবলমাত্রায় ইন্ধন দিয়েছে। আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব থাকতে পারে। কিন্তু সে প্রভাব যদি জনগণের সার্বভৌম অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে তাহলে জনগণের মধ্যে তার প্রভাব পড়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। দু'দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব সাবধানে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে ভারতের একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে। এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের জনগণের স্পন্দন বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরি বা লক্ষণীয় হওয়ার কথাই তো ছিল না। বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭১ সালে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত সরকার এবং ভারতের জনগণের সহযোগিতা বাংলাদেশের মানুষ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ আগেও করেছে, এখনো করে, অনাগত দিনেও করবে। বাংলাদেশের মানুষ অকৃতজ্ঞ নয়। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরির দায় কার?
প্রতিবেদনটি মূল্যায়ন করলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব সৃষ্টির নেপথ্যের কারণ ভারতের (বাংলাদেশ) নীতি। এটা অস্বীকার করা যাবে না, ভারতের (বাংলাদেশ) নীতি বন্ধুসুলভ/প্রতিবেশীবান্ধব বলার সুযোগ তেমন একটা নেই বরং ভারতের বাংলাদেশ নীতি অবন্ধু-প্রভুুসুলভ-অমর্যাদাকর বলার সুযোগ আছে। ভারতের বাংলাদেশ নীতি সার্বভৌম বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা মানুষ মেনে নেওয়া বাংলাদেশকে ভারতের আজ্ঞাবাহী দেশ হিসেবে মেনে নেওয়ারই শামিল। সোজাসাপ্টা কথায় বলা যায়, ভারতের বাংলাদেশ নীতি বাংলাদেশের মানুষকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই ভারতবিরোধী মনোভাবাপন্ন করেছে। এ নীতির কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব বিদ্যমান। এ নীতি যতদিন অব্যাহত থাকবে ততদিন বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও ভারতবিরোধী মনোভাব থাকবে, ক্রমে বাড়বেও।
এক সময় ভারতের শীর্ষ স্থানীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক ছিলেন জে এন দীক্ষিত। অভিজ্ঞ নিরাপত্তা বিশ্লেষক জে এন দীক্ষিত তার 'লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড' বইতে লিখেছেন, 'ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়েছিল ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি থেকে।' এ তথ্য বলে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র আড়াই বছরের মাথাতেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির সূত্রপাত হয়েছিল। এর দায় কার বাংলাদেশের না ভারতের? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে শ্যাম মানেকশ'র কথায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ভারতের সেনা এবং বাংলাদেশ ভারতের যৌথ গঠিত মিত্রবাহিনীর প্রধান ছিলেন জেনারেল শ্যাম মানেকশ'। মি. মানেকশ' ১৯৮৮ সালে ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক স্টেটম্যান-এ লিখেছেন, 'আমাদের সত্যাশ্রয়ী হতে হবে। বাংলাদেশীদের প্রতি আমরা সঠিক আচরণ করিনি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের সবধরনের সাহায্য করা উচিত ছিল। আমাদের রাজনীতিবিদরা তা করেননি। তারা বেনিয়ার মতো আচরণ করেছেন।' বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব ভারতের রাজনীতিবিদদের মানসিকতা/মস্তিষ্ক প্রসূত বাংলাদেশ নীতির প্রডাক্ট বলা যায়।
ভারতের বাংলাদেশ নীতি অবন্ধু-প্রভুসুলভ, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের জন্য অমর্যাদাকরই শুধু নয়, প্রকারান্তরে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের প্রতি বৈরী মনোভাবাপন্নও। এ মন্তব্যের সপক্ষে উদাহরণ/প্রমাণ অনিঃশেষ। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সীমান্তের একটি গণ্য করা হয়। এর কারণ, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর ঠান্ডা মাথায় নিরীহ বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা, যখন তখন বাংলাদেশে বেআইনি অনুপ্রবেশ, অনুপ্রবেশ করে বাংলাদেশিদের বাড়ি-ঘরে হামলা, লুটতরাজ, নারীর সম্ভ্রমহানি ইত্যাদি। বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের স্থল সীমান্ত রয়েছে। ওই সব দেশের সীমান্তে বিএসএফকে দেশগুলোর বেসামরিক নাগরিক হত্যা, দেশগুলোর ভূখন্ডে বেআইনি অনুপ্রবেশ করতে দেখা যায় না। বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ'র বেআইনি/আগ্রাসী কর্মকান্ড বন্ধের কার্যকর উদ্যোগ ভারত সরকারকে নিতে দেখা যায় না। সীমান্তে বিএসএফ-এর আগ্রাসন বা আগ্রাসী মনোভাব বন্ধে বাংলাদেশ ভারতকে অনুরোধের পর অনুরোধ করেও প্রতিকার পায় না। বাংলাদেশ ভারতের বড় বাজার। বৈধ-অবৈধ পথে ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ পণ্য বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশের হাতেগোনা কিছু পণ্য ভারতের বাজারে যায়। ভারত ট্যারিফ-ননট্যারিফসহ নানা ধরনের কর আরোপ করে বাংলাদেশি পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। ভারত কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডাবস্নুউটিও)আইন/নিয়ম-নীতিরও তোয়াক্কা করে না। বাংলাদেশকে দেওয়া প্রতিশ্রম্নতি, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিও ভারত মাঝে মধ্যে ভঙ্গ করে। বাংলাদেশ নদীর দেশ, নদী বাংলাদেশের প্রাণ। ভারত থেকে বাংলাদেশে ৫৪টি নদী এসেছে। এ ৫৪টি অভিন্ন নদী আন্তজার্তিক নদী। এসব নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশ আন্তজার্তিক আইন অনুযায়ী দাবিদার। ভারত আন্তজার্তিক আইন/কনভেনশনের তোয়াক্কা না করে শক্তির জোরে অভিন্ন নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নেয়। ভারত থেকে বানের পানির মতো মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে আসে। এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে বহু দেন-দরবার করেছে বাংলাদেশ, লাভ হয়নি।
ভারত আদৌ বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম বন্ধুরাষ্ট্র মনে করে কি না তা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সংশয় রয়েছে। ২০১৫ সালে সিপিবি ও বাসদের তিস্তা মার্চের সমাপনী সমাবেশে সিপিবি ও বাসদ নেতারা বলেছেন, 'পাকিস্তান ২৩ বছর বাঙালিদের শোষণ করেছে। আর ভারত ৪২ বছর ধরে স্বাধীনতায় সহযোগিতার নামে বাংলাদেশ শোষণ করছে। টুটি চেপে ধরে আছে বাংলাদেশের (২০.৪.২০১৫ নয়াদিগন্ত)। ২০১৬ সালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ভারত ঘুরে এসে বলেছেন, 'প্রতিবেশি দেশ হিসেবে চীন ও পাকিস্তানকে যেভাবে ভারতে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে, বাংলাদেশের বেলায় তেমনটা হয় না (১৮.০৯.২০১৬ প্রথম আলো)।' ২০১১ সালে বিশ্বখ্যাত পত্রিকা দ্য ইকনোমিস্ট লিখেছে, '৪০ বছর আগে বাংলাদেশের জন্মের সময় ভারত ছিল 'দাইমা'র মতো আর সীমান্ত এলাকায় হত্যাকান্ড ও অসম বাণিজ্যনীতির ফলে সে দেশটি এখন ক্রমে 'সৎমা' হয়ে যাচ্ছে (২২.০৪.২০১১ আমাদের সময়)।' বলা অন্যায্য হবে না যে, বাংলাদেশে 'ভারতবান্ধব' মনোভাব তৈরির সুযোগই রাখেনি ভারতের বাংলাদেশ নীতি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল অনেক বাংলাদেশিদের কাছে ভারতঘেঁষা হিসেবে পরিচিত। ইনি ২০১৭ সালে জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলকে বলেছেন, 'দিলিস্নর আগ্রাসী মনোভাব অনেককেই ভারতবিরোধী করে তুলবে। আমার ভাসুর কলকাতায় থাকেন, তিনি অসুস্থ। অথচ তাকে আমি দেখতে পারছি না, কারণ রামপাল বিরোধী আন্দোলন করায় ভারত আমাকে ভিসা দেয়নি (২৮.০২.২০১৭ ইনকিলাব)।' সুন্দরবন লাগোয়া রামপালে তাপ বিদু্যৎকেন্দ্র নির্মিত হলে বাংলাদেশে বহুমাত্রিক ক্ষতির আশঙ্কা থেকে রামপালবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালসহ কয়েক বুদ্ধিজীবী। বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আন্দোলনের দায়ে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ভারতের রোষানলে পড়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি বন্ধুসুলভ কিনা প্রশ্নসাপেক্ষ।
ভারতের বাংলাদেশ নীতিকে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাবের 'মা' বলা হলে অতু্যক্তি হবে না। ভারতের বাংলাদেশ নীতিতে বাংলাদেশের স্বার্থ ও বাংলাদেশের মানুষের সেন্টিমেন্ট উপেক্ষা আকাশের গণগণে সূর্যের মতো দৃশ্যমান। ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক বন্ধুসুলভ/অর্থবহ করতে হলে ভারতের বাংলাদেশ নীতি বাংলাদেশের মানুষের আস্থায় থাকতে হবে। ভারতের বাংলাদেশ নীতি ভারতের জন্য অনাগতদিনে ভালো না খারাপ হবে তা সময়ই বলে দিবে। তবে ভালো যে হবে না তার আলামত দেখা যাচ্ছে। ১৮ কোটি মানুষ অধুষ্যিত সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব ক্রমবৃদ্ধি ভারতের জন্য অশনি সংকেত।
জহির চৌধুরী :কলাম লেখক