বাংলার ইতিহাসে বাঙালির সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য দুটি গৌরবোজ্জল ঘটনা হলো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই দুটি মহান আন্দোলনে বিজয়ী হয়েছি। আজ সেই মহান ফেব্রম্নয়ারি মাস।
একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা দেওয়ার বিষয়ে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন কানাডায় বসবাসকারী কয়েকজন বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে কানাডার ভ্যাঙ্কুবারের রফিকুল ইসলামের নাম বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য। তার মনেই প্রথম ধারণা জন্মে যে, আমাদের শহীদ দিবস একুশে ফেব্রম্নয়ারিই হতে পারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কেননা, পৃথিবীর আর কোনো দেশে কোনো ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করার ঘটনা কোনো দিন ঘটেনি। যেমনটি ঘটেছে একুশে ফেব্রম্নয়ারি আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা ভাষার জন্য। সুতরাং, একমাত্র এ দিনটিই হতে পারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। রফিকুল ইসলাম এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অন্যান্য ভাষার উৎসাহী কয়েকজন মানুষকে নিয়ে কানাডায় একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। সংগঠনটির নাম 'মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট'।
১৯৯৮ সালের ৮ জানুয়ারি রফিকুল ইসলাম 'মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট'-এর মাধ্যমে তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার বিষয়ে প্রথম আবেদন জানান। আবেদনে তিনি সরাসরি একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব পেশ করেন এবং এর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। কিন্তু জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান 'মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট' বিষয়টি 'ইউনেস্কো'র কাছে উত্থাপনের পরামর্শ দেন। কেননা, এটি ছিল ইউনেস্কোর আওতাধীন বিষয়।
১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ সাত জাতি ও সাত ভাষার ১০ জনের স্বাক্ষর সংবলিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার একটি আবেদন প্যারিসের ইউনেস্কো সদর দপ্তরে পাঠানো হয়। সাত জাতি ও সাত ভাষার যে ১০ জন আবেদনে স্বাক্ষর করেছিলেন তারা হলেন- আলবার্ট ভিনজন (ফিলিপিনো), কারমেন ক্রিস্টোবাল (ফিলিপিনো), জ্যাসন মেরিন (ইংরেজি), সুসান হভগ্রিন্স (ইংরেজি), ড. কেলভিন চাও (ক্যান্তনিজ), নাজনীল ইসলাম (কা-সি) রেনাটে মার্টিন্স (জার্মান), করুনা জোসি (হিন্দি), রফিকুল ইসলাম (বাংলা) এবং আব্দুস সামাদ (বাংলা)। ইউনেস্কো সদর দপ্তরে যোগাযোগের ক্ষেত্রে জাতিসংঘে কর্মরত বাঙালি কর্র্মকর্তা হাসান ফেরদৌস বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
এর মধ্যে এক বছর কেটে যায়। আশাবাদী রফিকুল ইসলাম ইউনেস্কো সদর দপ্তরে টেলিফোন বার্তা পাঠান। জবাবে ইউনেস্কোর শিক্ষা বিষয়ক প্রকল্প বিশেষজ্ঞ মিসেস আনা মারিয়া ১৯৯৯ সালের ৮ এপ্রিল কানাডায় রফিকুল ইসলামকে একটি চিঠি দেন। মিসেস আনা মারিয়ার চিঠির তথ্যগুলো হলো- প্রস্তাবটি গ্রহণ করার জন্য জাতিসংঘের একটি সাধারণ অধিবেশন ডাকতে হবে। দ্বিতীয়টি হলো- যে কোনো একটি দেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি উপস্থাপনা করতে হবে। সর্বশেষ প্রস্তাবটি হলো- 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' ঘোষণার জন্য ইউনেস্কো ন্যাশনাল কমিশনের দেশসমূহ যেমন- বাংলাদেশ, কানাডা, ফিনল্যান্ড, ভারত, হাঙ্গেরিকে প্রস্তাবক হতে হবে।
মিসেস আনা মারিয়ার চিঠি পেয়ে রফিকুল ইসলাম উলিস্নখিত পাঁচটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। বাংলাদেশের তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন এবং দ্রম্নত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ১৯৯৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সরাসরি ইউনেস্কো সদর দপ্তরে প্রস্তাবটি পেশ করা হয়। প্রস্তাবটিতে স্বাক্ষর করেন 'বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কো'র সচিব প্রফেসর কফিল উদ্দিন আহমদ। ১৭ লাইনের মূল প্রস্তাবের সঙ্গে ছিল ২১ ফেব্রম্নয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করার পক্ষে যৌক্তিকতার একটি স্তবক। মূল প্রস্তাবের শেষ লাইনে লেখা হয়- বাংলাদেশ প্রস্তাব করছে যে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ দিনটিকে সারা পৃথিবীর জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হোক।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ অধিবেশনে প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয়। প্রস্তাবের সূচনায় বলা হয়- 'সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। পৃথিবীতে প্রায় ৫০০০ মাতৃভাষা আছে। মাতৃভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও মর্যাদা দানের জন্য একটি দিবস থাকা প্রয়োজন।
প্রস্তাবে আরো বলা হয় '১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি বাংলাদেশে মাতৃভাষার জন্য অভূতপূর্ব আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ এবং সেদিন যারা প্রাণ উৎসর্গ করেছেন তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার প্রস্তাব করা হচ্ছে।'
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর জেনারেল কনফারেন্স ফর ডিসিপিস্ননারি সেশনে প্রস্তাবটি ১৮৮ ভোটে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। এর ফলে, আমাদের 'শহীদ দিবস' পরিণত হয় 'আন্তার্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে একুশে ফেব্রম্নয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। প্রতি বছরেই দেশের সংখ্যা বাড়ছে। এখন বিশ্বে ১৯১টি দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়।
আমাদের ভাষা আন্দোলনই বিশ্বের সব মানুষকে এনে দিয়েছে মাতৃভাষা লালনের সুযোগ, স্বপ্ন ও অধিকার। এই একটি ক্ষেত্রে বিশ্বে আজ আমরা অগ্রপথিক জাতি। এ নিশ্চিয়ই আমাদের জন্য এক দুর্লভ সম্মান ও অনন্য গৌরবের বিষয়। আমরা এ দিনটির জন্য গর্ব অনুভব করি। আমাদের ভাষা আন্দোলনের মহান দিন একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিশ্বের সব ক্ষুদ্র জাতি ও ভাষা জনগোষ্ঠীকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে।
হাজার বছরের পুরনো আলো-আঁধারির ভাষা বাংলা আজ ঐশ্বর্যমন্ডিত। এ ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য '৫২র ভাষা আন্দোলনে আমাদের তরুণরা দিয়েছে বুকের তাজা রক্ত ও প্রাণ। এ ভাষার সুরম্য পথ বেয়ে আমরা পেয়েছি বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
তাই হাজার বছরেরও আগে যে ধুপছায়া পথ দিয়ে আমাদের ভাষার যাত্রা হয়েছিল শুরু, সে ভাষা চর্যাপদের পথ ধরেই আমরা বর্তমান বাংলা ভাষার গৌরবদীপ্ত অবস্থানে উপনীত হয়েছি, উপনীত হয়েছি বর্তমান বাংলা ভাষার অগ্রগতির গৌরবোজ্জ্বল শীর্ষে।
জোবায়ের আলী জুয়েল :প্রাবন্ধিক