সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের মনস্তত্ত্ব

যখন উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ ভাঙতে শুরু হয় তখন পুরো গ্রামবাসীর ঐকান্তিক চেষ্টার নজির অহরহ দেখতে পাওয়া যায় আমাদের মতো নদীমাতৃক দেশে।
নুসরাত জাহান পন্নি
  ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের মনস্তত্ত্ব

দিনকে দিন জলবায়ু পরিবর্তন একেকটা নতুন মাত্রা লাভ করছে। এমনকি ২০২৩ সালকে তো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর রেকর্ড ভাঙার বছর বলা হয়। কিন্তু এতকিছুর পরও আমরা শেষ পর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে নিজেদের এ রকম বৈরী পরিবেশে মানিয়ে চলেছি। এর পেছনে কাজ করছে বেশ কিছু মনস্তাত্ত্বিক দিক। সেগুলোর দিকেই আজকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্রান্থাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট ২০২২ সালের অক্টোবরে 'অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিকস' নামে একটি প্রতিবেদনে দেখিয়েছে যে, বাংলাদেশে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া ৪৬ শতাংশ বেড়েছে। গবেষণাটিতে মূলত ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ওপরে আঘাত হানা দুর্যোগগুলোর তথ্য নেওয়া হয়েছে। তবে গবেষকদের মতে, পরবর্তী সময়ে সংঘটিত আবহাওয়ার বিপদের তথ্যগুলো যোগ করলে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া বৃদ্ধির হার আরও বাড়বে। এক্ষেত্রে আবার বিশ্ব আবহাওয়া বিষয়ক সংস্থা ডবিস্নউএমও আরও এক ধাপ এগিয়ে জানিয়েছে, ২০২৩ সালের চেয়েও ২০২৪ সালের আবহাওয়া আরও ভয়ংকর ও চরমভাবাপন্ন আচরণ করতে পারে। এতে বিশ্বজুড়ে দুর্যোগের বিপদ তো বটেই, রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাবও বাড়তে পারে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে দেশে ৫ মাত্রার ওপরে মোট ছয়টি ভূমিকম্প আঘাত করেছে। এর আগে ২০২২ সালে মাঝারি মাত্রার বা রিখটার স্কেলে ৫-এর ওপরে মোট তিনটি ভূমিকম্প হয়। অথচ ১৯৭২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে যে কটি ভূমিকম্প হয়েছে, তার মধ্যে মাঝারি মাত্রার কম্পনের ঘটনা ঘটেছে প্রতি দুই থেকে চার বছরে একবার। আর ২০২৩ সালে ৪ থেকে ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে মোট বেশ কটি। নিয়মিত ওই কম্পন রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর জন্য বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে মনে করেন তারা।

ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইআইইডি) একটি গবেষণার বরাত দিয়ে গত বছরের মাঝামাঝি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ র?্যাপোর্টিয়ারের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রায় ৪৩ শতাংশ গ্রামীণ বসতি বন্যার কবলে পড়ে। আর প্রায় ৪১ শতাংশ বসতি ঝড়ের আঘাতের শিকার হয়।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষর্ যাপোর্টিয়ারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেনে বলা হয়, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সব ধরনের দুর্যোগ বাড়ছে। বিশেষ করে বজ্রপাত ও তাপপ্রবাহের মতো নতুন ধরনের বিপদ দ্রম্নত বেড়ে ক্ষতি ও জীবনহানি বাড়িয়ে দিচ্ছে। যেমন প্রথম আলোর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৮৩ শতাংশ মানুষ দাবদাহ, বজ্রপাত ও শৈত্যপ্রবাহের মতো দীর্ঘমেয়াদি দুর্যোগের কারণে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা থেকে প্রায় তিন মিটার উঁচুতে থাকা হাওর এলাকায় কয়েক বছর পরপর হঠাৎ বন্যা হয়। এর বাইরে খরা ও উপকূলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার সমস্যাও বাড়ছে। খুলনা এলাকাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র এক মিটার উঁচুতে হওয়ায় ঝড়বৃষ্টি হলে সেখানে জোয়ারের পানি উঠে যায়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃতু্য বেড়ে গেছে। প্রতি বছর তিন শতাধিক মানুষ বজ্রপাতে মারা যান। নতুন এ দুর্যোগ পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বাংলাদেশে অবনতি হচ্ছে দাবদাহ পরিস্থিতিরও। মানে ২০২৩ সালটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম উষ্ণ বছর ছিল।

প্রত্যেকটা প্রাণীই নিজের সবটুকু দিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। মানুষও এর ব্যতিক্রম না। সেজন্য আমরা কৌশল অবলম্বন করি। এমনকি বারবার পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েও। এর বেশিরভাগ দিকটাই মনস্তাত্ত্বিক। আমেরিকার বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য ও সমাজকর্মী লাপরিশা বেরি ড্যানিয়েলের মতে, আমরা মূলত তিনটি ধাপে মানসিকভাবে নিজেদের প্রস্তুত করি। এটাকে বলা হয় ত্রিপল এ (ঞৎরঢ়ষব অ)।

প্রথমেই আসে একসেপ্টেন্স (অপপবঢ়ঃধহপব) বা স্বীকারোক্তি। আমরা প্রথমেই এটা মেনে নেই যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটছে সেটা অনেক অস্বাভাবিক কিছু না। এটা ঘটবেই। এটা আমাদেরই কর্মের ফল। এই ধাপটির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ঘটে যাওয়া বিপর্যয়ের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার চেষ্টা করি। পাশাপাশি, ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি ঠিক করি- যাতে যে কোনো ধরনের ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়।

দ্বিতীয়ত, এইড (অরফ) বা সাহায্য। আমরা একা কখনোই কোনো সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম নই। সেই প্রাচীনকাল থেকেই এই মূলমন্ত্র অনুধাবন করেই আমরা যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছি। তারই সূত্রধরে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও আমাদের একটা কমিউনিটি তৈরি করতে হবে- যা আমরা সব সময়ই করে থাকি। এর মাধ্যমে যে কোনো দুর্যোগে পরস্পরকে সাহায্য করার মনমানসিকতা বহাল থাকে। এর উদাহরণ আমরা সব জায়গায় দেখতে পাই।

যখন উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ ভাঙতে শুরু হয় তখন পুরো গ্রামবাসীর ঐকান্তিক চেষ্টার নজির অহরহ দেখতে পাওয়া যায় আমাদের মতো নদীমাতৃক দেশে।

আর সর্বশেষ হলো এডাপটেশন (অফধঢ়ঃধঃরড়হ) বা অধিগ্রহণ। পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করা। যেমন আমাদের মতো কৃষিপ্রধান দেশে বন্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্যা সহিষ্ণু ফসল উদ্ভাবন, খরাপ্রবণ এলাকার জন্য খরা সহিষ্ণু ফসল উদ্ভাবন ইত্যাদি।

এই ধাপগুলো অনুসরণ করেই মূলত আমাদের পূর্বপুরুষরা নানা প্রতিকূল পরিবেশে টিকে ছিলেন। একই রকম ধারা অব্যাহত আছে আমাদের মাঝেও এবং টিকে থাকবে পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত। জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের মনস্তত্ত্বকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করেছে। তবে এই প্রাথমিক ধাপগুলো অনুসরণ করে আমরা যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকতে পারি।

নুসরাত জাহান পন্নি : নবীন লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে