সুন্দরবন নিয়ে সাম্প্রতিক দুশ্চিন্তা কতটুকু প্রাসঙ্গিক?

শত শত বছর ধরে সুন্দরবন নিজেই নিজেকে সুরক্ষা দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। আমাদের কাজ হবে সুন্দরবনকে প্রভাবিত না করা। তাহলে এটি নিজেই নিজেকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে অভিযোজিত হয়ে আরও শত শত বছর টিকে থাকতে পারবে।

প্রকাশ | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

এ বি এম রায়হানুল ফেরদৌস
জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত এই বনের প্রায় ৬২ শতাংশ পড়েছে বাংলাদেশে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই বনের ওপর নির্ভরশীল। তবে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা সুন্দরবন নিয়ে কিছুটা উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। সম্প্রতি বনবিভাগের এক বিবৃতিতে উঠে এসেছে গত ১০০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমেছে ৪৫১ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে সুন্দরবনে কমেছে ৭৯ ভাগ সুন্দরী গাছ (১৫ ফেব্রম্নয়ারি, ২০২৩)। দেশের আরও কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের প্রকাশিত সংবাদে সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। যার ফলে, দেশের ফুসফুস খ্যাত এই বনের ভবিষ্যৎ নিয়ে জনমনে দুঃন্তা ভর কতে শুরু করেছে। গত কয়েক দশকে সুন্দরবনের আয়তন যে কমেছে, এটা সত্য। কিন্তু উদ্বেগজনক হারে কমেছে এমনটা বলা যায় না। এখানে দুইটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সুন্দরবনের ভূপ্রকৃতি সক্রিয় ব-দ্বীপ (অপঃরাব উবষঃধ) শ্রেণির। এই শ্রেণির ভূমি জোয়ার-ভাটার প্রভাবে নিয়মিত জলমগ্ন হয়। ফলে বছরের পর বছর ধরে জলমগ্ন হওয়ায় এ জাতীয় ভূমির আয়তন কিছু কমে যাওয়াই স্বাভাবিক বিষয়। পাশাপাশি যে কোনো বনভূমির আয়তন বছরের পর বছর একই থাকে না। সুন্দরবন এক সময় যশোর, বাগেরহাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১০০ বছরের হিসাব ধরলে সুন্দরবনের আয়তন যতটুকু হ্রাস পেয়েছে তা স্বাভাবিক-ই বলা চলে। এখানে পজিটিভ বিষয় হলো বনভূমি নিধনের (উবভড়ৎবংঃধঃরড়হ) ফলে আয়তন কমে যাওয়ার বিষয়টি সুন্দরবনে ঘটেনি। ফলে সুন্দরবনের আয়তন যতটুকু কমেছে প্রাকৃতিকভাবেই কমেছে। আরেকটি বিষয় হলো: বনভূমির আয়তন পরিমাপ করা হয় স্যাটেলাইট চিত্রের মাধ্যমে। এখন যদি শুষ্ক মৌসুমের চিত্র নেয়া হয় সেক্ষেত্রে বনের যে আয়তন আসবে ভরা মৌসুমে (বর্ষাকাল) নিশ্চিতভাবে তারচেয়ে কম আসবে। তখন তো সুন্দরবনের বড় একটা অংশ তো পস্নাবিত থাকে। পাশাপাশি সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বাড়ায় প্র বছরই পানির স্তর ওপরে উঠে আসছে। যার ফলে, সুন্দরবনের অপেক্ষাকৃত নিচু অংশ ক্রমান্বয়ে পানির নিচে চলে যাচ্ছে। এতে করেও সুন্দরবনের আয়তন কিছু কমছে। তাই সুন্দরবনের আয়তন উদ্বেগজনক হারে কমছে- এমন ভাবনার সময় এখনও আসেনি। তবে সুন্দরবন নিয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় যে নেই, তা নয়! এক্ষেত্রে প্রথম যে বিষয়টি আসে সেটি সুন্দরবনের লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া। লবণাক্ততার কারণে গত পাঁচ বছরে বাগেরহাট রেঞ্জে ৭৯ শতাংশ সুন্দরী গাছ কমে গেছে (বাংলাদেশ প্রতিদিন/ ১৫ ফেব্রম্নয়ারি, ২০২৩)। এটা আশঙ্কাজনক। প্রশ্ন উঠতে পারে লবণাক্ত জলাভূমির গাছ লবণাক্ত পরিবেশে অভিযোজিত হতে পারছে না কেন? এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে সুন্দরবন পৃথিবীর অন্যান্য সব লবণাক্ত জলাভূমির মতো কেবল বুশ ম্যানগ্রোভ (খর্বাকায় শ্বাসমূলীয় বৃক্ষের বনভূমি) নয়। এখানে যেমন সুন্দরী, পশুরের মতো বৃহতাকার বৃক্ষ রয়েছে- তেমনি গরান, কেওড়ার মতো অপেক্ষাকৃত খাটো শ্বাসমূলীয় বৃক্ষও রয়েছে। সুন্দরীর মতো বৃহতাকার উদ্ভিদগুলো মূলত মিঠাপানির উদ্ভিদ। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে এজাতীয় বৃক্ষের সংখ্যাই বেশি। দেশের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা অসংখ্য নদী- যেগুলো সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে, তারাই বছরের পর বছর ধরে মিঠাপাসরবরাহ করে এ সব উদ্ভিদকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু বর্তমানে নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণের ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলোতে মিঠা পানির চরম সংকট দেখা দেয়। এ প্রসঙ্গে সর্বাগে চলে আসে ফারাক্কা বাঁধের নাম। সরকারি তথ্য অনুসারে, ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ৪০০ কিউসেক। ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে একই পয়েন্টে পানির পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র নয় হাজার ৬৯৮ কিউসেক। শুষ্ক মৌসুমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাশাপাশি সুন্দরবনের নদীগুলোতে মিঠাপানির সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ এই ফারাক্কা বাঁধ। পাশাপাশি প্রাকৃতিক নিয়মে সুন্দরবনে জোয়ার-ভাটা চলতেই থাকে। জোয়ারে বনের একটা বড় অংশ নিমগ্ন হয়। যেহেতু উজানের নদীগুলোতে মিঠাপানির সরবরাহ কমে যায়- তাই জোয়ারের সময় নদীগুলোর অনেক ভেতর পর্যন্ত লবণপানি ঢুকে পড়ে। এতে করে সুন্দরবনে সুন্দরীর মতো মিঠাপানির উদ্ভিদের সংখ্যা উলেস্নখযোগ্য হারে হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শত বছর ধরে সুন্দরবনের বৃহতাকার উদ্ভিদগুলো ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঢালের মতো কাজ করেছে। সুন্দরবনে এ জাতীয় গাছের সংখ্যা কমায় আগামী বছরগুলোতে দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা নিশ্চিতভাবেই বাড়বে। সুন্দরবন নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্যতম আরেকটি কারণ, বনের পরিবেশ পরিবর্তন হওয়াতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এর জীববৈচিত্র্য। পরিবেশ বদলে গেলে প্রতিটা প্রাণীর স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। দীর্ঘদিনের বিরূপ পরিবেশে বিলুপ্তির আশঙ্কাও থাকে। বর্তমানে সুন্দরবনের ২৯টি প্রাণী মহাবিপন্নের তালিকায় রয়েছে (প্রথম আলো/১৩ নভেম্বর, ২০১৯)। সুন্দরবনের পরিবেশের সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জনজীবনও। ইতোমধ্যে সুন্দরবনের অনেক জেলে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। জীবিকার তাগিদে এদের বড় অংশই শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। এই জনগোষ্ঠীকে ধরে রাখতে সরকার সুন্দরবন কেন্দ্রিক যে ইকো-টু্যরিজম প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তার ছিটেফোঁটা উপকার পাচ্ছে না এসব মানুষ। যেসব পর্যটন স্পট গড়ে উঠেছে তার মালিক থেকে কর্মচারী সব শহুরে। ব্যবসা করে লাভবান হচ্ছে তারাই। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো। পাশাপাশি জেলে, মৌয়ালদের ওপর স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা আর প্রভাবশালীদের দাপটতো রয়েছেই। দাদন ছাড়া ট্রলার নিয়ে বনে গেলেই জোটে পদে পদে হয়রানি। এসব বিষয়ে আলাদা করে বলার কিছু নেই। এক্ষেত্রে দেশের সামগ্রিক অবস্থার চিত্র আর সুন্দরবনের চিত্র প্রায় এক। পার্থক্য হলো প্রান্তিক এই মানুষ নিজেদের অধিকার নিয়ে অতটাও সচেতন না, ফলে হয়রানিতে পড়ে বেশি। সুন্দরবনকে নিয়ে দুশ্চিন্তার আরও একটি কারণ এটিকে ঘিরে দীর্ঘমেয়াদি টেকসই পরিকল্পনায় ক্ষমতাসীন দলগুলোর তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। এখানে দুটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমটি সুন্দরবন সংরক্ষণ খুব বড় প্রকল্প। এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে লম্বা সময় আর কাড়িকাড়ি অর্থের প্রয়োজন। পাশাপাশি এটি বাস্তবায়ন করলেও দৃশ্যমান উন্নয়নের দেখা সঙ্গে সঙ্গেই মিলবে না। এখান থেকে তো আর সরাসরি হারভেস্ট (ফসল সংগ্রহ) করা যায় না- যেটা দেশের জিতে সরাসঅবদান রাখবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের অন্তত দশ-বছর পর আস্তে আস্তে পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে। অন্যদিকে, দেশের শাসনব্যবস্থায় দলগুলো এক মেয়াদে ক্ষমতায় থাকেই পাঁচ বছর। তারা কেন পদ্মা সেতু বা মেট্রোরেলের মতো দৃশ্যমান প্রকল্প রেখে সুন্দরবনে বিনিয়োগ করবে? সরকার চায় জনগণকে দেখাতে যে দেশের উন্নতি হচ্ছে, আমরা কাজ করছি। আবার সুন্দরবনের উন্নতি করলে সরকার সহসা বাহবা পাবে এমন জাতিও আমরা না! দ্বিতীয় কারণটি হলো সুন্দরবনকে নিয়ে সামগ্রিক আলোচনা দক্ষিণাঞ্চল ঘেঁষা। সহজ করে বললে সুন্দরবনকে এখনো আঞ্চলিক সম্পদ (খড়পধষ জবংড়ঁৎপব) হিসেবে দেখা হয়। দীর্ঘসময়েও এই ধারণাটা পরিবর্তন করা যায়নি। সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মানুষজনও একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের। প্রকৃত অর্থে যদিও বিষয়টা এমন নয়। তারপরও সুন্দরবনের আঞ্চলিক ইমেজটা থেকে গেছে। ফলে সুন্দরবন দিবস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ছাড়া সুন্দরবন কখনই মূল আলোচনায় থাকে না। তাহলে সামগ্রক এই দুশ্চিন্তার সমাধান কোন পথে? সুন্দরবনকে ঘিরে সব দুশ্চিন্তার বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান রয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা এবং পলিসি- এ তিনটি বিষয়ের যোগসূত্র। সুন্দরবন প্রাকৃতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এর বাস্তুতন্ত্র সেভাবেই তৈরি। কিন্তু দীর্ঘসময় ধরে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট উভয় কারণেই এর ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। এটা সত্য যে ফারাক্কা বাঁধ তৈপর বিকারণে পাণ্টন চুক্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়। তবে আমাদের কি ভিন্ন কিছুই করার ছিল না! লম্বা সময় পেরিয়ে গেলেও কেন আমরা গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পা? এটা বাস্তবায়িত হলে শুষ্ক মৌসুমে নদনদীতে মিঠাপাথাকতো। সেক্ষেত্রে সুন্দরবন কেন্দ্রিক মিঠাপানির এতটা সংকট দেখা দিত না। উদ্ভুত পরিস্থিতি অনেকাংশে সামাল দেয়া যেত। আরেকটি বিষয়, যেটাকে অনেকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে দেখে। খাল খনন প্রক্রিয়া। এটাকে যে যেভাবেই নেয় না কেন, সামগ্রিক বিচারে খাল খনন খুব ভালো প্রকল্প ছিল। এতে করে মিষ্টি পানির নতুন প্রাকৃতিক জলাধার সৃষ্টি হতো। সেক্ষেত্রে শুষ্ক মৌসুমেও নদীগুলোতে মিঠাপানির প্রবাহ বজায় থাকতো। শত শত বছর ধরে সুন্দরবন নিজেই নিজেকে সুরক্ষা দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। আমাদের কাজ হবে সুন্দরবনকে প্রভাবিত না করা। তাহলে এটি নিজেই নিজেকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে অভিযোজিত হয়ে আরও শত শত বছর টিকে থাকতে পারবে। এ বি এম রায়হানুল ফেরদৌস : নবীন লেখক