সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে পাকিস্তান

একটা আশঙ্কার কথা খুবই পরিষ্কার যে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য শেষ মুহূর্তে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় হয়তো হস্তক্ষেপ করেছে এবং সেই স্বার্থ হচ্ছে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফকে সরাসরি ক্ষমতায় আসা থেকে বিরত রাখা। পিটিআইয়ের সাফল্যের প্রাথমিক লক্ষণ এবং তারপরে দীর্ঘ সময় ধরে ফলাফল ঘোষণা বন্ধ রাখা, নির্বাচন কমিশনের সম্পূর্ণ নীরবতা, এসব শেষ মুহূর্তের কারচুপির পূর্বাভাস দেয়। আমার মনে হয়, পাকিস্তানে এমন একটি ফলাফল এসেছে যাতে দেশের দ্বন্দ্ব বাড়বে বৈ কমবে না। সুতরাং এটা পাকিস্তানের এবং সেদেশের গণতন্ত্রের জন্য আরেকটি আঘাত।
মো. মাঈন উদ্দিন
  ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে পাকিস্তান

পাকিস্তানের নির্বাচনী ফলাফল জানতে ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলি জানতে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশি জনগণ, বিশেষ করে সচেতন মহলের আগ্রহ দেখা যায়। কারণ এদেশটা তো এক সময় বাংলাদেশের অংশ ছিল। অপরদিকে, পাকিস্তান বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে প্রথম দ্বিতীয় বা তৃতীয় অবস্থানে না থাকলেও পাকিস্তানের নির্বাচন এলেই সারা বিশ্বের চোখের দৃষ্টি চলে যায় পাকিস্তানের দিকে। কারণ, পাকিস্তান একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। কী হয় ওদেশের নির্বাচনে তা দেখার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে গোটা দুনিয়া। এর কারণ হলো, পাকিস্তানের নির্বাচনে ওদেশের সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ ভূমিকা থাকে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সৃষ্টির লক্ষ্য থেকে বহুবার দেশটিতে চলেছে সামরিক শাসন। আবার সামরিক শাসন না হলেও প্রায় প্রতিটি সরকারপ্রধান পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আতাত করে দেশ চালাতে হয়। সে যাহোক, এবারে পাকিস্তানে নির্বাচন হয়েছে ৮ ফেরুয়ারি। আর বহু নাটকীয়তার পর চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয় তার তিনদিন পর ১১ ফেব্রম্নয়ারি। চূড়ান্ত ফল ঘোষণার পর এগিয়ে রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। প্রাপ্ত ফলাফলে ২৬৪ আসনের মধ্যে ১০১টি আসন পেয়েছেন তারা। এদের মধ্যে বেশিরভাগই দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খান সমর্থিত। পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের (ইসিপি) তথ্য অনুসারে, ২৬৪ আসনের মধ্যে স্বতন্ত্ররা পেয়েছেন ১০১টি আসন। নওয়াজ শরিফের পিএমএল-এন পেয়েছে ৭৫টি আসন। আর বিলাওয়াল ভূট্টোর পিপিপি পেয়েছে ৫৪টি আসন। এছাড়াও এমকিউএম দল পেয়েছে ১৭টি। আর বাকি ১৭টি আসন পেয়েছে অন্যরা। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মোট আসন ২৬৬। এর মধ্যে একটি আসনের প্রার্থী নির্বাচনের আগের দিন নিহত হওয়ায় ভোট স্থগিত করা হয়েছে। আর বাকি আরেকটি আসনের ফল ভোটের পর বাতিল করে দেশটির নির্বাচন কমিশন। স্থগিত আসনের ভোট এ মাসের ১৫ ফেব্রম্নয়ারি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে ইসিপি। এই যে ফল ঘোষণা করতে প্রায় তিনদিন সময় নিয়েছে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন। বিলম্বের কারণ হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক তথ্যমন্ত্রীর ভাষ্য মতে, বেলুচিস্তানের বেশ কয়েকটি নির্বাচনের ফল যৌক্তিক সমস্যার কারণেই বিলম্ব হয়েছে। তিনি বলেন, 'যখন কিছু এলাকায় ঠান্ডা থাকে, তখন লজিস্টিক সমস্যার কারণে ফল আসতে দেরি হবে এটাই স্বাভাবিক।' এমনকি নির্বাচন কমিশনও একই কথা বলেছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ৯ ফেব্রম্নয়ারি রাতেই আসন সংখ্যার দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বলছেন, তার দলই নির্বাচনের সবচেয়ে বড় দল। এই কারণে তিনি অন্যদেরও তার সঙ্গে যোগ দিয়ে সরকার গঠন করার আহ্বান জানিয়েছেন। কারাবন্দি ইমরান খান ১৬তম সাধারণ নির্বাচনে তার দলের প্রার্থীরা এগিয়ে থাকায় তিনি তার ভেরিফায়েড এক্স (বর্তমানে টুইটার) অ্যাকাউন্টে বাংলাদেশ সময় শনিবার মধ্যরাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি করা এক ভিডিও বার্তা পোস্ট করেন। এক্সে পোস্ট করা সেই ভিডিওতে তিনি দাবি করেন যে, তার দল পিটিআইয়ে ওপর শত দমন-পীড়ন চলা সত্ত্বেও তারা এই নির্বাচনে 'নিরঙ্কুশ বিজয়' অর্জন করেছেন। তার দল সমর্থিত প্রার্থীদেরকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার জন্য তিনি ভোটারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি সেখানে নওয়াজ শরিফকে একজন 'দুর্বল নেতা' হিসেবে অভিহিত করেন। সেই সঙ্গে তিনি আরও বলেন যে, পাকিস্তানি নাগরিকরা তাকে চায় না। এই হলো পাকিস্তানের বর্তমান নির্বাচনের ফলাফলের হালচাল।

তিনদিন পরে পাকিস্তানের ফল ঘোষণা বহির্বিশ্বের দৃষ্টিতে প্রকৃত পক্ষেই দৃষ্টিকটু। তবে ইতিহাস বলছে, পাকিস্তানে নির্বাচনের ফল পেছানোর ঘটনা এটাই প্রথম নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্বাচনের দিন ও পরের রাতে সারা দেশে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখা হয় এবং ২৪ ঘণ্টা পরও পূর্ণাঙ্গ ফলাফল প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। ফলে গত দু'দিনের ঘটনাবলি দৃশ্যত বিদ্যমান বিভাজন এবং রাজনৈতিক ফাটলকে আরও গভীর করেছে, মনে করেন অনেকেই। পরবর্তী সরকার কে হবেন তা নিয়েও জনমনে বিভ্রান্তি রয়েছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর থেকে মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক ব্যবহারকারীকে একদিকে নির্বাচন কমিশন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমালোচনা করতে দেখা গেছে, অন্যদিকে সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগকেও এই বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী করা হচ্ছে। তবে এই বিভাজন, বিভ্রান্তি ও জনরোষের ফল কী হবে, সময়ই তা বলে দিবে। নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফল সবাইকে অবাক করেছে। কারণ প্রত্যাশার বিপরীতে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এগিয়ে আছে। তবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফলাফল আসা বন্ধ হয়ে যায়। এ নিয়ে সামাজিক ও মূলধারার গণমাধ্যমে ছিল বিতর্ক, যাতে ছিল নানা প্রশ্ন ও সংশয়। মানুষের চোখ ছিল পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের দিকে, কিন্তু তাদেরও অসহায় দেখাচ্ছিল। রাত ১২টার পরও মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু হয়নি এবং ভোট গণনার ফলাফলও বের হচ্ছিল না। পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের প্রার্থী ও সমর্থকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের বিজয়ী ঘোষণা করেন এবং ফলাফল বিলম্বকে 'কারচুপির চেষ্টা' বলে অভিহিত করেন। এক পর্যায়ে আধা ঘণ্টার মধ্যে ফল আসতে শুরু করার কথা বলা হলেও রাত ৩টা পর্যন্তও নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত কিছু আসেনি। সকালে আবার ঘোষণা দেওয়া হয় ১০টার মধ্যে ফলাফল দেওয়া হবে, কিন্তু তাও করা হয়নি। মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় ইন্টারনেট সুবিধা না থাকায় ফল সংগ্রহের জন্য তৈরি করা নতুন ব্যবস্থায় কাজ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়ে দেয় নির্বাচন কমিশন। কিন্তু এই বিবৃতির আগে নির্বাচন কমিশনেই ঘোষণা করেছিল যে ইন্টারনেট ছাড়াও নতুন ব্যবস্থা সক্রিয় থাকবে। অন্যদিকে, পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ক্যাম্পাসে ছিল সম্পূর্ণ নীরবতা। এদিকে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থিত প্রার্থী ও দলীয় সমর্থকরা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কারচুপির অভিযোগ করে আসছেন। পিটিআই সমর্থিত এক প্রার্থী বলেন, বিচার বিভাগ, যারা যে কোনো ঘটনার বিষয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে নজর দিতে পারে, তারা মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধের বিষয়টি খেয়াল করেনি এবং কেন ফলাফল এত দেরিতে আসছে সেটাও খেয়াল করেনি। তিনি যোগ করেন, রাত পর্যন্ত তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন বলে দাবি করলেও সকালে তিনি পরাজিত হন। গত দু'দিনের এসব ঘটনার পর ইতোমধ্যেই বিদ্যমান বিভাজন ও রাজনৈতিক ফাটল আরও গভীর হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। পাকিস্তানে নির্বাচন নিয়ে ছিনিমিনি বা পুতুল পুতুল খেলার এই যে অতীত ইতিহাস, অতীতের ভুল থেকে এবারও রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো শিক্ষা নেয়নি বলেই মনে হচ্ছে। ফলে একটি প্রশ্ন এবারও 'জনমত পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে এমন শক্তি পাকিস্তানে কারা'। আর এটা একবার বা দু'বার নয়, পঁচাত্তর বছর ধরে হয়ে আসছে। আমরা দেখছি। সারা বিশ্ব দেখছে। পাকিস্তানের জনগণ এই মুহূর্তে অনেকাংশেই দ্বিধাবিভক্ত। রাজনৈতিক দলগুলোও বিভক্ত। যে মুহূর্তে পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা আসা উচিত ঠিক সেই মুহূর্তে দেখা দিচ্ছে বিভক্তির। এটি চলতে থাকলে পাকিস্তানের সামনে ঘোর বিপদ। অনেকেই মনে করেন, এই নির্বাচন পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা আনবে না। সহিংসা, আন্দোলন মেরুকৃত দেশকে আরও বিভক্ত করবে। পাকিস্তান শুধু আজ চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখিই নয়, সন্ত্রসবাদও এ দেশে বাড়ছে। বিশ্ব কীভাবে একটি অস্থিতিশীল পাকিস্তানকে দেখবে এবং বিশ্বশক্তির কাছে এর অর্থ কী তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তবে এটি লক্ষ্য করা উচিত যে, পাকিস্তান একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ এবং এটি এমন একটি অঞ্চলে অবস্থিত যা আঞ্চলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে, সম্প্রতি ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও পাকিস্তানের পাল্টা হামলা দেশটিকে আবারো বিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। একদিকে সন্ত্রাসবাদ বাড়ছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ওঠানামা অব্যাহত রয়েছে এবং চীন পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু পার্শ্ববর্তীদেশ ভারতের সঙ্গে রয়েছে তাদের চিরবৈরিতা।

একটা আশঙ্কার কথা খুবই পরিষ্কার যে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য শেষ মুহূর্তে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় হয়তো হস্তক্ষেপ করেছে এবং সেই স্বার্থ হচ্ছে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফকে সরাসরি ক্ষমতায় আসা থেকে বিরত রাখা। পিটিআইয়ের সাফল্যের প্রাথমিক লক্ষণ এবং তারপরে দীর্ঘ সময় ধরে ফলাফল ঘোষণা বন্ধ রাখা, নির্বাচন কমিশনের সম্পূর্ণ নীরবতা, এসব শেষ মুহূর্তের কারচুপির পূর্বাভাস দেয়। আমার মনে হয়, পাকিস্তানে এমন একটি ফলাফল এসেছে যাতে দেশের দ্বন্দ্ব বাড়বে বৈ কমবে না। সুতরাং এটা পাকিস্তানের এবং সেদেশের গণতন্ত্রের জন্য আরেকটি আঘাত।

মো. মাঈন উদ্দিন : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে