আজ সরস্বতী পূজা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে ভক্তি আর শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত হচ্ছে জ্ঞান আর ললিতকলার দেবী সরস্বতী। কে না চায় পৃথিবীতে জ্ঞানী হতে? সবাই চায়। আর সেই জ্ঞানের জন্য, যশের জন্য, বিদ্বান হওয়ার জন্য ভক্তরা মা সরস্বতীর পূজা করে থাকেন। আমরা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থের দিকে তাকালে সরস্বতীর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপপ্রকাশ দেখতে পাই। যজ্ঞরূপা সরস্বতী, সূর্যকিরণময়ী সরস্বতী, অন্নদাত্রী সরস্বতী, নদীরূপা সরস্বতী, দানবদলনী সরস্বতী ও সবশেষে সরস্বতী দেবীর প্রকাশ ঘটেছে বাগদেবী হিসেবে। ব্রাহ্মণে স্পষ্টভাবেই সরস্বতীকে বাক্ বা বাক্যদেবী বলা হয়েছে-
'বাগ্ৈব সরস্বতী বাচমেব তৎ প্রীণাতি।'
-বাক্ই সরস্বতী, যজ্ঞ বাককে প্রীত করে।
সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবী। বেদে কিন্তু সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। সরস্বতী=সরস (জল)+মতুন (অস্ত্যর্থে)+ঙীন (স্ত্রী)। অতএব, সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী অর্থাৎ নদী।
বৃহস্পতি হচ্ছেন জ্ঞানের দেবতা, তিনি বাক্পতিও। ইন্দ্রও বাক্পতি। বৃহস্পতি-পত্নি সরস্বতীও জ্ঞানের দেবী। সব জ্ঞানের ভান্ডার তো ব্রহ্মা-বিষ্ণু আর মহেশ্বরের। তাদেরই শক্তিতে সরস্বতী জ্ঞানের দেবী। সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞের আগুন জ্বেলে সেখানেই ঋষি লাভ করেছিলেন বেদ, ঋগমন্ত্র ঋষির কণ্ঠ থেকে নির্গত হয়েছিল- সামমন্ত্র গীত হয়েছিল। সুতরাং, সরস্বতী জ্ঞানের দেবী হিসেবেই পরিচিত হয়েছিলেন। সরস্বতী নদীর তীরে প্রজ্বলিত যজ্ঞাগ্নিতে হবিঃপ্রদানকালে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারিত হওয়ায় সরস্বতী হলেন বিদ্যারূপা বা বাগরূপা-জ্ঞানের উদ্দীপনকারিণী।
ত্রিলোক বিচরণশীলা জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী প্রবাহমানা জলময়ী মর্তসরস্বতীতে অবতীর্ণা হলেন- জলময়ী নদী সরস্বতী জ্ঞানের উদ্দীপনকারিণী হওয়ায় তিনি হলেন বাগ্েদবী বা বিদ্যাদেবী। দিনে দিনে সরস্বতী তার অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে কেবল মাত্র বিদ্যাদেবী অর্থাৎ জ্ঞানের দেবীতে পরিণত হলেন।
সরস্বতীর প্রকৃত তাৎপর্য নিহিত রয়েছে সূর্যাগ্নির জ্যোতিতে। সূর্যাগ্নির তেজ, তাপ ও চৈতন্যরূপে জীবদেহে বিরাজ করায় চেতনা, জ্ঞানের প্রকৃত কর্ত্রী তো দেবী সরস্বতী। সরস্বতী দেবীর রূপান্তর হয়েছে পৃথিবীতে নদীরূপে এবং সরস্বতীই অগ্নি-ইন্দ্র-মরুৎ অশ্বিদ্বয়ের সংস্পর্শে শত্রম্নঘাতিনী, ধনদাত্রী এবং বৃহস্পতি-ব্রহ্মাণস্পতির বিদ্যাবত্তার সংযোগে নদী সরস্বতীর সঙ্গে অভিন্নরূপে সরস্বতী তীরে উচ্চারিত বৈদিকমন্ত্রে সংশ্লিষ্ট হয়ে পুরাণে বিদ্যা ও জ্ঞান ভিন্ন অপর জ্ঞানগুলো অন্যত্র স্থাপন করে হলেন বিদ্যাধিষ্ঠাত্রী। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে গোলোকে বিষ্ণুর তিন পত্নী-লক্ষ্ণী, সরস্বতী ও গঙ্গার মধ্যে বিবাদের ফলে গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতীর নদীরূপ পাওয়াই হচ্ছে সরস্বতীর পৃথিবীতে সরস্বতী নদী ও সরস্বতী দেবীরূপে প্রতিষ্ঠিতা হওয়ার তত্ত্ব। পন্ডিতরা অনেকেই মনে করেন যে, সরস্বতী প্রথমে ছিলেন নদী, পরে হলেন দেবী। রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন- 'আর্য্যাবর্তে সরস্বতী নামে যে নদী আছে, তাই প্রথমে দেবী বলে পূজিত হয়েছিলেন। বর্তমানে গঙ্গা যেমন হিন্দুরা উপাস্যদেবী হিসেবে পূজা করে থাকেন। ক্রমান্বয়ে সরস্বতী হলেন জ্ঞানের দেবী।'
বৈদিক জ্যোতিরূপা সরস্বতী ও নদী সরস্বতী সম্মিলিতভাবে জ্ঞানের দেবতারূপে পুরাণতন্ত্রে ও সাহিত্যে বিপুল শ্রদ্ধা ও ভক্তির অধিকারিণী হয়েছেন। তিনি হিন্দু সংস্কৃতির বেড়া ডিঙিয়ে জৈন ও বৌদ্ধধর্মেও পূজার আসনে অধিষ্ঠিতা হয়েছেন। সরস্বতীর আরাধনার ক্রমবিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রূপকল্পনাও বহুবৈচিত্র্য লাভ করেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে দেবীর বাহুর সংখ্যা অধিকতর হলেও সাধারণত তিনি চতুর্ভুজা, পদ্মাসনা, শুক্লাবর্ণা, শুভ্রবর্ণা-বীণা-পুস্তক জপমালা-সুধাকলসধারিণী-চন্দ্রশেখরা, ত্রিলোচনা-কদাচিৎ পদ্ম, লেখনী ও মস্যাধার দেবীর হাতে স্থান পায়। কদাচিৎ দেবী দ্বিভূজা। তন্ত্রে সরস্বতীই বাগীশ্বরী-বর্ণেশ্বরী-সারদা ও শারদা। একটি মন্ত্রে বাগীশ্বরী মদোন্মত্তা-হস্তে পানপাত্র নরকপাল। বর্ণেশ্বরী সিন্দুরবর্ণা এবং মৃগশাবকধারিণী
জ্ঞানই দূর করতে পারে মানুষের অজ্ঞতা। পৃথিবীকে সুন্দর করে তুলতে পারে জ্ঞানের আলো। এই আলোতে দূর করে দিতে পারে সব অন্ধকার। পৃথিবীর জ্ঞানীদের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তারাই সাফল্যের চরম শিখরে অবস্থান করছেন যারা জ্ঞানসুধা আকণ্ঠ পান করেছেন। আর এই জ্ঞানের সুধা এমনিতেই পাওয়া যায় না। এর পেছনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। সাধনা করতে হয়। তাইতো জ্ঞান পিপাসা মেটাতে আজ মেতে উঠেছে সনাতন ধর্মবলম্বীরা মা সরস্বতীর আরাধনায়। তারা বিশ্বাস করেন- পৃথিবীর সব অন্ধকার দূর হবে মায়ের কৃপায়; তার আলোয় ভরে যাবে ভুবন।
তারাপদ আচার্য্য : সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ