রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম সরব প্রকাশ

চেতনার নিরিখে বিচার করলে এ সত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে একুশের আন্দোলন, যার সূত্রপাত হয়েছিল অনেক আগে থেকেই, তা শুধু ভাষার পরিসীমাতে আবদ্ধ ছিল না। তা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের সরব প্রকাশ। যার পূর্ণতা এসে দাঁড়ালো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টিতে।

প্রকাশ | ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

আ. শ. ম. বাবর আলী
আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য শুধু ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। মূলত তা ছিল আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রাথমিক প্রকাশ। ১৯৫২ সালে এর চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটলেও আন্দোলনের শুরু অনেক আগেই। ভাষা মানুষের সামগ্রিক চেতনা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম। একমাত্র মাধ্যমও বলা যেতে পারে। জীবনের পাওনাকে দাবি করে বুঝে নেবার দ্বিতীয় কোনো মাধ্যম নেই। তাই মাতৃভাষার অপমান যে কোনো জাতির কাছে চরম গস্নানিকর। ব্যক্তি, তথা একটা গোটা জাতির উন্নতি একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমেই সম্ভব। তাই দেখা যায়, ১৭৫৭ সালে বণিক ইংরেজ জাতি যখন এদেশে বাণিজ্য করতে এসে কূট-কৌশলে রাজভার গ্রহণ করল, তখন তাদের মাতৃভাষাকে এদেশে প্রতিষ্ঠার জন্য সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হলো। কারণ তারা জানত, যেহেতু তারা শাসক এবং তাদের মাতৃভাষা ইংরেজি, সেহেতু একমাত্র ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনো ভাষার মাধ্যমে তাদের শাসনকার্য একচ্ছত্রভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাদের এ ধারণা অমূলক ছিল না। তার প্রমাণ, বিদেশি হয়েও দীর্ঘ দু'শ বছর তারা এদেশ শাসন করে গেছে। আর তা বেশ প্রতাপের সঙ্গেই। এদেশের জনগণ যেদিন থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করেছিল, সেদিন থেকেই তারা উপলব্ধি করেছিল, নিজেদের মুখের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে সামাজিক হোক, রাজনৈতিক হোক, আর্থিক হোক- কোনো স্বাধীনতা অর্জনই তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই দেশ বিভাগের আগেই ১৯৪৭ সালের ৩ জুন বড়লাট লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন যখন ভারত বিভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করলেন, তখনই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠল এদেশের সচেতন নাগরিকরা। তাদের দাবি মোটেই গুরুত্বহীন ছিল না। একথা বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারল স্বার্থন্বেষী তৎকালীন পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ। তারা শংকিত হলো। কারণ বিভক্ত দেশের অধিকাংশ লোকের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিকে স্বীকার করে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে, বাঙালিদের ন্যায্য আধিপত্যকে মেনে নিয়ে নিজেদের পায়ে কুড়ালমারা। কারণ স্বার্থভোগী হিসেবে একথা তারা ভালোভাবেই জানত যে, আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য মাতৃভাষার চেয়ে বড় হাতিয়ার দ্বিতীয়টি নেই। আর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানবাসী, অর্থাৎ বাঙালিদের আত্মপ্রতিষ্ঠার অর্থ হচ্ছে, তাদের কায়েমী স্বার্থের পরাজয়। তাই নবপ্রতিষ্ঠিত দেশের শাসনভার হাতে নিয়েই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের রাষ্ট্রভাষার দাবিকে নস্যাৎ করে দেওয়ার সার্বিক 'দায়িত্ব' তারা গ্রহণ করল। বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবির প্রতিরোধকারীদের স্বপক্ষে কোনো যুক্তি ছিল না। কারণ নবপ্রতিষ্ঠিত গোটা পাকিস্তানের সর্বমোট জনসংখ্যা ছিল ৮ কোটির মতো। তারমধ্যে বাঙালির সংখ্যা ছিল ৫ কোটি। মোটামুটি প্রধানত ৬টি ভাষা ছিল তৎকালীন গোটা পাকিস্তানে। এরমধ্যে বাংলা মাতৃভাষা ছিল শতকরা ৫৬ জনের। যে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য তৎকালীন শাসকচক্র কোমর বেঁধে লেগেছিল, তাদের মাত্র ৭ শতাংশ নাগরিকের মাতৃভাষা ছিল উর্দু। মাতৃভাষার কল্যাণ ছাড়া কোনো জাতির কল্যাণ আসতে পারে না। সুতরাং শতকরা ৫৬ জনের ভাষাকে বাদ দিয়ে ৭ জনের ভাষার উন্নয়ন কিছুতেই রাষ্ট্র্রীয় কল্যাণের সহায়ক হতে পারে না। একথা যে তৎকালীন শাসকচক্র জানত না, তা নয়। কিন্তু ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠীকল্যাণের চেয়ে জাতীয় কল্যাণকে বড় করে দেখার মানসিকতাকে তারা কোনোদিনই গ্রহণ করেনি। বাংলাভাষাকে উপেক্ষা করার কারণ হিসেবে তারা বলল, এ ভাষা বিজাতীয় ভাষা। যুক্তির কথা আপাতত না হয় বাদ রইল, তথ্যের কথাই ধরা যাক। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যাদের সামান্যতম জ্ঞান আছে, তারা জানেন কথাটা কত অযৌক্তিক। তাছাড়া সৌকর্যের দিক দিয়ে বাংলাভাষা অনেক বেশি সমৃদ্ধ, অন্তত উর্দুর চেয়ে তো বটেই। উর্দুতে ক'জন সাহিত্যিক বিশ্বের দরবারে সমাদৃত হয়েছেন? নোবেল প্রাইজের সম্মান উর্দু সাহিত্যে কার ভাগ্যে জুটেছে? বাঙালিরা ভালোভাবেই জানত, উর্দু রাষ্ট্রভাষা হওয়ার অর্থ ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, রাজনীতি সর্বক্ষেত্রে তাদের পশ্চাৎগামিতা। এর নজীর তারা দেখেছে দীর্ঘ দু'শ বছর ধরে। অফিস আদালত সর্বক্ষেত্রে কার্য পরিচালনার একমাত্র মাধ্যম হলো ইংরেজি। তখন সব ভাষাই উপেক্ষিত হলো। এসব ভাষার চর্চাও এক রকম বন্ধ হয়ে গেল। কারণ, তা হলো নিষ্প্রয়োজনীয়। এমনকি জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে ইংরেজি শিক্ষা তাদের কাছে বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ালো। এদেশীয় ভাষায় একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির চেয়ে স্বল্প ইংরেজি শিক্ষিত ব্যক্তি পেতে থাকল অধিকতর সুযোগ-সুবিধা। এদেশীয় ভাষায় উচ্চশিক্ষিত ইংরেজি না জানা ব্যক্তি হয়ে পড়ল একজন নিরক্ষরের চেয়েও গুরুত্বহীন। রাষ্ট্র এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে পড়ল। সুতরাং লঘিষ্ঠ ভাষা হওয়া সত্ত্বেও এদেশের বাঙালিদের ভাগ্যও যে অনুরূপ হবে, এ আশংকা তর্কাতীত। এদেশের জনগণ তা ভালোভাবেই বুঝল। তাই ১৯৪৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের কর্ণধার জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় এসে রমনা রেসকোর্সে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এবং কার্জন হলের ছাত্রসমাবেশে যখন উর্দুকে 'পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা' বলে ঘোষণা করলেন, তখন বিক্ষোভে ফেটে পড়ল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজসহ গোটা সচেতন নাগরিক মহল। উত্তাল তরঙ্গে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল একটি সফেদ সমুদ্র। এতদিন যা ছিল নদীর কলধ্বনি, আজ থেকে তা পরিণত হলো সামুদ্রিক গর্জনে। সে গর্জন চলতে থাকল। কিন্তু তা সহজ অথবা সাবলীল পথে নয়, অনেক প্রতিকূল প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। অনেক রক্ত ঝরিয়ে সে সমুদ্রের তরঙ্গ একদিন আছড়ে পড়ল বেলাভূমিতে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারি। সে তরঙ্গের কিছু অংশ ভেঙে চূর্ণ হলো ঠিকই, কিন্তু বেলাভূমিও ধসে পড়ল সমুদ্রের অতলে। অর্থাৎ পরাজয় স্বীকারে বাধ্য হলো কুচক্রী শাসকগোষ্ঠী। শপথ সুদীপ্ত হলে কোনো বাধাই দুর্ভেদ্য হতে পারে না, বাঙালিরা তা আর একবার প্রমাণ করল। অবশেষে চক্রান্তকারীদের জাল হতে মুক্ত হয়ে বাংলাভাষা তার প্রাপ্য মর্যাদা পেল। জয় হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদের। আর সে জাতীয়তাবাদেরসূত্র ধরে ধীরে ধীরে সজীব হয়ে উঠতে থাকল স্বাধিকারের সোচ্চার সচেতনতা, যার সর্বশেষ বা চূড়ান্ত ফল লাভ হলো একাত্তরের স্বাধীনতা। চেতনার নিরিখে বিচার করলে এ সত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে একুশের আন্দোলন, যার সূত্রপাত হয়েছিল অনেক আগে থেকেই, তা শুধু ভাষার পরিসীমাতে আবদ্ধ ছিল না। তা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের সরব প্রকাশ। যার পূর্ণতা এসে দাঁড়ালো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টিতে। আ. শ. ম. বাবর আলী : লেখক