একটি জাতির সামগ্রিক অগ্রগতির প্রশ্নে যথাযথ শিক্ষার বিস্তার ঘটানোর পাশাপাশি শিক্ষার মান উন্নয়নের বিষয়টিও অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া যদি শিক্ষায় বিশৃঙ্খলা কিংবা যে কোনো ধরনের অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়, তবে তা কতটা উদ্বেগজনক বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে, শিক্ষায় চরম বিশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয় উঠে এসেছে। বিশেষ করে জানা যাচ্ছে যে, কোচিং বাণিজ্য বন্ধে গতানুগতিক পড়াশোনা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কারিকুলামে শিক্ষা ব্যবস্থা এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা এখন 'বুমেরাং' হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা মনে করি, সৃষ্ট পরিস্থিতি আমলে নিয়ে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।
লক্ষণীয়, এমন তথ্য উঠে এসেছ যে, ইংলিশ ভার্সনের অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী কোচিং সেন্টারে সহপাঠীর সঙ্গে ইংলিশের বেসিক গ্রামার শিখছে। অংক ও বিজ্ঞান কোচিং করছে। অথচ এই তিন বিষয়ের কোচিংয়েই ক্লাস এইটের পুরানো কারিকুলামের বই পড়ানো হচ্ছে। আবার নতুন কারিকুলামের যে বই রয়েছে, তার সঙ্গে পুরানো বইয়ের কোনো মিল না থাকায় তাদের স্কুলের শিক্ষকদের কাছে অংক-বিজ্ঞান-ইংলিশ গ্রামারের পাশাপাশি বাংলা ব্যাকরণের জন্য কোচিং করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমলে নেওয়া দরকার, অভিভাবকদের ভাষ্য, নতুন কারিকুলামে প্রতিটি বিষয়ে যে পড়া রয়েছে তা পড়ে একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া খুবই কঠিন। তাই সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তারা পুরানো কারিকুলামের বইও পড়াচ্ছেন। যদিও তাদের বক্তব্য, এতে নতুন কারিকুলামের চলমান পড়াশোনা যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত করতে স্কুলের শিক্ষকদের কাছেও কোচিং করাচ্ছেন।
এক্ষেত্রে আমলে নেওয়া দরকার, অধিকাংশ সচেতন বাবা-মা সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নতুন কারিকুলামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুরানো কারিকুলামের পড়াশোনা সমান তালে চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ এতে শিক্ষার্থীরাও যেমন চাপে পড়েছে, তেমনি তাদের পড়াশোনার খরচ চালাতে গিয়ে নিম্ন-মধ্যবিত্ত অভিভাবকদেরও নাভিশ্বাস উঠেছে। অন্যদিকে যাদের আর্থিক সামর্থ্য ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আছে, তারা কেউ কেউ তাদের সন্তানদের বাংলা মিডিয়াম থেকে সরিয়ে নিয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করিয়ে হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন- আমরা মনে করি এমনটি যখন জানা যাচ্ছে, তখন পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে সংশ্লিষ্টদেরকেই।
বলা দরকার, শিক্ষা ক্ষেত্রে কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা গ্রহণযোগ্য নয়। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে তা নিরসন করতে হবে। উলেস্নখ্য, নতুন শিক্ষাক্রমে বিদ্যালয়ের শিক্ষকের হাতে মূল্যায়নের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। এর ফলে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হবে, বলা হচ্ছে। কিন্তু অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাতে কোচিং বাণিজ্যকে আরও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। যা 'গোদের ওপর বিষফোঁড়া' বলে শিক্ষাবিদরা মন্তব্য করেছেন। এছাড়া নতুন কারিকুলামের ফলে গাইড ব্যবসা বন্ধ হবে এবং অভিভাবকরা গাইড ব্যবসায়ীদের হাত থেকে মুক্তি পাবে এমন কথা বলা হলেও বাস্তবে তার উল্টোটা ঘটছে বলে জানা যাচ্ছে। এটাও আলোচনায় এসেছে যে, অতীতে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করার পর দেখা গেছে, বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেরাই পদ্ধতিটি বুঝে উঠতে পারেনি। ফলে বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষাগুলোতে বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বাজার থেকে গাইড কিনে এনে সেই গাইড থেকে কপি করে, তা দিয়ে পরীক্ষা গ্রহণ করতেন। আর এ ক্ষেত্রে তারা প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের বাজার থেকে নির্দিষ্ট কোম্পানির গাইড কিনতে উৎসাহিত করতেন। তাই গাইড ব্যবসা বন্ধ না হয়ে বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এবারও একই ধরনের ঘটনা ঘটবে বলে শিক্ষা খাত পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন। ফলে সামগ্রিক পরিস্থিতি আমলে নিতে হবে। কোচিং বাণিজ্য নিয়ে যে আশঙ্কার বিষয় সামনে আসছে তা এড়ানো যাবে না।
সর্বোপরি আমরা বলতে চাই, শিক্ষার্থীদের আনন্দময় পরিবেশে পড়ানোর পাশাপাশি মুখস্থনির্ভরতার পরিবর্তে দক্ষতা, সৃজনশীলতা, জ্ঞান ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে শেখাতেই চালু করা এই নতুন শিক্ষাক্রমে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কতটা শিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠবে তা নিয়ে শিক্ষাবিদরা অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন। যা সংশ্লিষ্টদের আমেল নিতে হবে। একইসঙ্গে শিক্ষা খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে তা দূর করতে উদ্যোগী হওয়ার বিকল্প নেই। শিক্ষার যথাযথ মানও নিশ্চিত করতে হবে। সার্বিক পরিস্থিতি আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে এমনটি কাম্য।