জীবনের প্রয়োজনে সংগ্রাম
নিয়তি মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়। পরিবেশ, পরিস্থিতি মানুষকে পরিবর্তন হতে শেখায়। নিয়তির কারণেই গ্রামের অটোওয়ালা আজ ঢাকার রিকশাওয়ালা। গ্রামের মেধাবী ছেলেটা শহরের নামমাত্র বেতনের চাকরিওয়ালা। পেটের দায়ে, জীবনের প্রয়োজনে দুটি ভিন্ন শ্রেণির মানুষ একই পথের পথিক।
প্রকাশ | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
হাবিবুর রহমান
দীর্ঘক্ষণ জ্যামে বসে থাকায় বিরক্ত হয়ে এক পর্যায়ে বলে উঠলাম, মামা, আপনি এ রাস্তায় না এসে সামনের ওই গলি ধরে গেলে এতক্ষণ পৌঁছে যেতাম। আপনি বরং রিকশা ঘুরিয়ে ওই গলি দিয়েই চলেন।
এখন সব রাস্তাই ভিড়। কোনদিক যাব এবং কেন?
রিকশাওয়ালার এ কথা শুনে হতাশ হয়ে চুপ করে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে স্ক্রলিং করে যাচ্ছি। যখন কোনো কিছুতে মন বসে না, বর্ষার আকাশের মতো বিষণ্ন থাকে মনটা, তখন ফেসবুকিং করেই দিব্যি সময়টা কাটিয়ে দেওয়া যায়। কে কি পোস্ট করল, কোনো বন্ধু কার সঙ্গে ঘুরতে গেল, কোন বান্ধবী নতুন শপিং করে স্টোরি দিল সেসবের দিকে আর মনোযোগ থাকে না। সময় কাটানোর জন্যই হয়তো এ এলোপাতাড়ি ফেসবুকিং অন্যতম একটা মাধ্যম হতে পারে।
সকালে ক্লাস করতে গিয়ে হঠাৎ করেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারও ফোনকল পেলে মানুষের মাঝে স্বর্গীয় সুখানুভূতি লাভ করে। আবার কারও ফোনকল পেলে বিরক্তিতে মাথা গরম হওয়ার জোগাড়। আমার বেলাতে হয়েছে দ্বিতীয়টা। খুব বেশি মাথা গরম না হলেও একটু যে বিরক্ত হয়েছি সেটা অস্বীকার করে পাপের ভাগিদার হওয়ার ইচ্ছে নেই। ইব্রাহিম ভাই ফোন দিয়ে জানতে চাইল ফ্রি আছি কিনা। ফুফাতো ভাই অনেক দিন পর ফোন দেওয়ায় মনে একটু আনন্দ পেলাম। ভাবলাম, ভাই হয়তো সিলেট থেকে ক্যাম্পাসে এসে খোঁজ নিচ্ছে আমার। দেখা সাক্ষাৎ করবে, ভালো লাগবে। শহুরে একলা জীবনে বদ্ধ পরিবেশে আপনজনদের কাছে পেলে মনটা আনন্দে নেচে উঠে। কিন্তু ভাই তার গুরুত্বপূর্ণ কাজের একাংশ আমার ওপর চাপিয়ে দিল। ভাই নিজে বই লিখেন, এডিটিং করেন। সুদূর সিলেট থেকে ঢাকার বাংলাবাজারে এসে পেপারপত্র কেনা, প্রিন্টিং পাবলিকেশন, বাঁধাই করা সব সময় তার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই ছোট ভাই হিসেবে মাঝে মাঝে সে কাজের দায়িত্ব অর্পিত হয় আমার কাঁধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাবাজার খুব বেশি দূরে না বলে আমাকেই যেতে হয়।
তবে আজ হঠাৎ করেই বিরক্তি চেপে বসলো মাথায়। বিরক্তিটা আরও চরম হয়ে উঠলো যখন জুয়েল আমার সঙ্গে যেতে অস্বীকার করল। ঢাকা শহরের এই যানজটপূর্ণ পরিবেশ, ধুলাবালি জ্যামের কারণেই একা যেতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে না করে দিল জুয়েল। তাই বাধ্য হয়ে একাই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ক্লাস শেষে গোসল, দুপুরের খাবার, নামাজের পরেই বুয়েট ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে ফুলবাড়ী বাসস্যান্ডের উদ্দেশে সোজা হাঁটা ধরলাম।
এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সময় কিছুটা গেলেও রিকশা বিন্দুমাত্র চলার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। বাবুবাজার থেকে শাহ পার্কে আসতে না যে সময় লাগল, তার থেকেও চার-পাঁচগুণ বেশি সময় ধরে রিকশা দাঁড়িয়ে আছে পিলারের মতো। জ্যামের গুমোট পরিবেশ আর যানজটের শব্দে মাথায় বোম ফাটার মতো অবস্থা। বিরক্তি এবং অস্থিরতা দূর করতে ভাবলাম রিকশাওয়ালা মামার সঙ্গে একটু গল্প করি। যেটা সচরাচর সব রিকশাওয়ালার সঙ্গেই করা হয় আমার। বিশেষ করে, যখন রিকশাতে একা যাতায়াত করি। এই প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে যতবেশি মেশা যায়, তাদের যত গভীরে যাওয়া যায়, ততই জীবনের মানে বোঝা যায়। জীবনকে উপলব্ধি করা যায় নতুন আঙ্গিকে, নতুন অবয়বে। উপেক্ষিত এই সব মানুষ সবার সঙ্গে নিজেদের তুলে ধরে না। যদি কেউ তাদের জানতে চায়, বুঝতে চায় তখন এই ধরনের মানুষ তাদের সবকিছু উন্মুক্ত করেই উপস্থাপন করে। নিজের দুঃখের কাহিনী অন্যের কাছে প্রকাশ করলে যেমন ব্যক্তির দুঃখের কিছুটা হলেও লাঘব হয়। তেমনই শ্রোতাও নতুন করে জীবনকে উপভোগ করতে পারে, নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে নতুন করে। তাই, বিশেষ করে রিকশা মামাদের সঙ্গে আমার আত্মিক বন্ধনটা একটু বেশি।
মামা, আপনার দেশের বাড়ি কই?
কুষ্টে...
ভাষা শুনে বুঝলাম কুষ্টিয়া। সব মানুষই আঞ্চলিক ভাষায় নিজের পরিচয় তুলে ধরতে খুশি হয়। এ রিকশাওয়ালাও অন্যের থেকে ব্যতিক্রম নয়।
বললাম এ যে আমার পাশের জেলা। আমার বাড়ি ঝিনাইদহে।
মামা একটু কৌতূহল প্রকাশ করে বলল, ঝিনাইদার কনে আপনার বাসা?
মহেশপুর,
আপনার এলাকায় তো প্রায়ই যাই। সেদিনও বারোবাজার গিছিলাম অটো নিয়া।
রিকশাওয়ালা মামার উপজেলার নাম জানতে চাওয়ায় বলল তার বাড়ি দৌলতপুর উপজেলায়।
এবার আমার একটু অবাক হওয়ার পালা। জিজ্ঞেস করলাম, মামা আপনার অটো কই আর আপনি গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় কেন?
দেখলাম মামার মুখটা মলিন হয়ে গেল। বুঝলাম ভাগ্য তার সঙ্গে খেলা করেছে। মানুষের জীবনে এমন অনেক ঘটনা লুকায়িত থাকে- যা তার বাহ্যিক অবস্থা দেখে বোঝার উপায় নেই। দেখলে বলা যাবে না যে এই লোকটা সর্বহারা। গ্রামের সর্বস্ব হারিয়ে শহরের উদ্বাস্তু সে। তেমনই এক ভুক্তভোগী এই রিকশা মামা।
গ্রামে থাকতি অটো চালাতাম। এক রাতি অটো নিয়ে বাড়িতে আসার পথে ডাকাতের খপ্পরে পড়ছিলাম। বলে, গাড়ি দে! না হলি তোক মাইরে ফেলব।
আমি ভাবলাম, গাড়ি নিয়ে যাক নিক। জীবনে বাইচে থাকলি গাড়ি কত আসপি। আমি মইরে গেলি আমার বৌ-বাচ্চা কিডা দেখপি, কি হবি তাগোর। ডাকাতরা আমাক গাছের সঙ্গে বাঁইধে গাড়ি নিয়ে চইলে গেল।
আমি জানতে চাইলাম, থানায় মামলা করেননি?
মামলা কইরে আর কি হবি! গরিবের জন্যি কি আইন আছে? যার টাকার দেমাগ আছে, আইন তাগের জন্যি। আর মামলা করতিও তো টাকা লাগে, এত টাকা কনে পাবো?
আমি ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। ভাবলাম কিছু বলব। কিন্তু ভাষা খুঁজে পেলাম না।
জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এবার মামা নিজেও বিরক্ত হয়ে গেল। এবার রিকশা ঘুরিয়ে আমার বলা গলির দিকেই চলতে শুরু করল। এদিকেও ভিড়। তবে তুলনামূলক কম। এবার মামা নিজেই বলতে শুরু করল। বাঁধ ভেঙে গেলে পানির স্রোতকে যেমন আটকে রাখা কঠিন হয়ে যায়, মানুষও তেমন দুঃখ ভাগ করার মানুষ পেলে সবটুকু উগলে দিয়ে বলতে শুরু করে।
আমি পাঁচসাত দিন হইলো ঢাকা আইচি। বাড়ি থেইকে আর কি হবি! জমিও নাই যে চাষ করব। আগেও ঢাকায় রিকশা চালাতাম। তাই আবার চলে আলাম। বাড়ি থাকলি পরিবার নিয়ে না খায়া মরা লাগতো।
এখানে পরিবারের কেউ নেই?
না, সবাই গিরামে আছে। ঢাকা শহরে যে খরচ। নিজেরই প্যাট চলে না আবার বাড়ির লোকে!!
কে কে আছে আপনার পরিবারে?
তিন মেয়া আছে। সবাইরে বিয়ে দিইচি। এক ছাওয়াল আছে। সে মাদ্রাসায় সেভেনে পড়ে।
রিকশা কি নিজের মামা, নাকি ভাড়া নিছেন?
মামা একটু শুকনো হাসি হেসে বলল, নিজে রিকশা কোনে পাবো কন? ভাড়ায় চালাই। নিজে কিনলিও দুদিন পর ছিনতাই হয়ে যাবি। গেরেজ থাকি নেয়া আসি। কাজ শেষে ওকেনেই রাইখে দিই।
অবশেষে আমরা মা-বাবা প্রিন্টিংয়ের সামনে পৌঁছালাম। ভাইও ইতোমধ্যে ফোন করে জানতে চাইলো কাজ কতদূর শেষ হয়েছে। কাগজগুলো দোকানে রেখে মামাকে বললাম,
চলেন কোথাও বসে চা টা খাই,
না মামা, আপনে খান। আমার আবার অন্য জাগায় যাওয়া লাগবি।
আমি আর জোর করলাম না। ওনার কাছে আমার চায়ের অফার থেকে নতুন যাত্রী ধরা বেশি প্রয়োজন।
পকেটে হাত দিয়ে দেখি টাকা এখনো অতিরিক্ত কিছু আছে। ভাই খরচ বাবদ কিছু বেশি টাকা দিয়েছে আমায় বিরিয়ানি খাওয়ার জন্য। গুনে দেখলাম পাঁচশত মতো। তাই বড়োলোকি ভাব ধরে রিকশাওয়ালা মামাকে বললাম, আমায় পার্কের বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিতে।
সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসছে। আসরের ওয়াক্ত ইতোমধ্যে কাজা হয়ে গেছে। মাগরিবটা যেন কাজা না হয় তাই দ্রম্নত পা চালিয়ে বাসে উঠে বসলাম। উদ্দেশ্য হলো (ছাত্রাবাস) মসজিদে মাগরিব নামাজ পড়া। লোকাল হলেও বাসটা মোটামুটি খালি। মাঝামাঝি একটা সিটে বসে পড়লাম। ফোনটা বের করে ফেসবুকিং করে জ্যাম ও ক্লান্তিটা দূর করার চেষ্টা করতে যাচ্ছিলাম। তখনই মনে পড়ে গেল সেই রিকশাওয়ালা মামার কথা। আসার সময় অবশ্য ভাড়া থেকে অতিরিক্ত আরও বিশ টাকা বেশি দিয়ে আসছি। ওনার করুণ দশার জন্য নাকি একজন রিকশাচালক বলে টাকাটা দিলাম তা জানি না। তবে ভাবলাম দেওয়া উচিত।
নিয়তি মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়। পরিবেশ, পরিস্থিতি মানুষকে পরিবর্তন হতে শেখায়। নিয়তির কারণেই গ্রামের অটোওয়ালা আজ ঢাকার রিকশাওয়ালা। গ্রামের মেধাবী ছেলেটা শহরের নামমাত্র বেতনের চাকরিওয়ালা। পেটের দায়ে, জীবনের প্রয়োজনে দুটি ভিন্ন শ্রেণির মানুষ একই পথের পথিক।
\হকেউ বা রিকশা চালিয়ে জীবনের প্রয়োজন মেটায় কেউ বা পেপারপত্র বিক্রি করে।
জীবন এক রহস্যময় পর্দায় ঘেরা। রয়েছে হাজারো স্তর। এই স্তর ভেদ করতে করতে উপস্থিত হয় জীবনের যবনিকাপাতে।
হাবিবুর রহমান : নবীন লেখক