আমাদের সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাই বলেন- বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মাত্র দু'টি- একটি ভারত আরেকটি মিয়ানমার। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই প্রতিবেশী এক রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মধুরই বলা চলে; হয়তো কখনো-সখনো সম্পর্কে টানাপড়েন চলে- কিন্তু সামগ্রিকভাবে সম্পর্কটা বিষাদপূর্ণ হয়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, আরেক প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সম্পর্ণভাবে মধুর ছিল না কখনো-ই। হয়ত কখনো-সখনো সম্পর্কটা জোড়া লেগেছে মাত্র। এর অনেক কারণ আছে। আমি সেদিকে যাচ্ছি না। বলা হয়ে থাকে, প্রতিবেশীর বাড়িতে বা ঘরে আগুন লাগছে তার উত্তাপ পাশের ঘরেও লাগে। ঠিক যেমনটা হয়েছে আমাদেরও। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা আজকের নতুন না। মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে গত ৫ দশকেরও বেশি সময় ধরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে বিভিন্ন সশস্ত্র বিদ্রোহীগোষ্ঠীর। তবে এই লড়াই নতুন গতি পেয়েছে ২০২১ সালে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর থেকে। বর্তমানে এর তীব্রতা বাড়তে বাড়তে এতটাই বেড়েছে যে, এর লেলিহান শিখার তাপে আমাদের শরীরের লোমও পুড়তে শুরু করেছে। তবে এটা শুরু মাত্র, এর শেষ কোথায়- বলাটা মুশকিল। বর্তমানে মিয়ানমারের যে পরিস্থিতি তা এখন মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ- তা আর বলা যাবে না। কারণ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের জেরে গত বুধবার পর্যন্ত দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ৩২৭ জন সদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তাদের নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়েছে। এসব বিজিপি সদস্য এখনো বাংলাদেশেই রয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকজন হাসপাতালে চিকিৎসাও নিচ্ছেন। তাদের নিজ দেশে ফেরাতে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলে জানা গেছে। বেশ কিছুদিন যাবত মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গ্রম্নপের তুমুল লড়াই চলছে। তাদের ছোড়া গুলির সিসা ও রকেট লঞ্চার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তুমরু সীমান্তে উড়ে এসে পড়ছে। এতে ঘুমধুম-তুমরু এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন। ইতোমধ্যে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। ৬ ফেরুয়ারি ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে এসে পড়ে একটি মর্টার শেল। এ সময় বসতবাড়ির জানালা ও গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রচন্ড শব্দে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে এতে কেউ আহত হননি। ঘটনাস্থলে বিজিবি সদস্যরা উপস্থিত হয়ে মর্টার শেলের অংশ নমুনা হিসেবে নিয়ে যায়। এতে সীমান্তে আতঙ্ক বিরাজ করছে। হাজার হাজার সীমান্তবর্তী মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছেন।
এর আগের দিন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউপির ৪ নম্বর ওয়ার্ডের জলপাইতলি এলাকায় তুমরু সীমান্তে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে বাংলাদেশিসহ দুজন নিহত হয়েছেন। ঘটনাস্থলেই এক রোহিঙ্গা শ্রমিক নিহত হন। আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান আরও একজন। তিনি স্থানীয় ব্যবসায়ী।
পত্রিকার খবরে জানা যায়, রান্নাঘরে ওই রোহিঙ্গা শ্রমিক ভাত খাচ্ছিল ঠিক সেই সময় বিকট একটি শব্দ শোনা যায়। এতে ঘটনাস্থলেই ওই শ্রমিক নিহত হন। আহত অবস্থায় বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান।
যদিও মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে বাংলাদেশে দুজনের মৃতু্য এবং সীমান্তে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তলব করা হয়। পরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে আসেন রাষ্ট্রদূত। বিষয়গুলো উলেস্নখ করে এর কড়া প্রতিবাদ করা হয়। তবে, তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো যে মিয়ানমার সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই একথা বিদালোকের মতো সত্য। এখন প্রশ্ন হলো, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় বাংলাদেশের লোক আহত ও নিহত হচ্ছে এর প্রতিকার তো দূরের কথা- মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী সেনাসদস্য যারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে বা নেবে এদের যে মিয়ানমার ফিরিয়ে নিবে তারই কী গ্যারান্টি আছে।
\হমিয়ানমারের কথা ও কাজে যে মিল নেই এটা তো রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়েই টের পাচ্ছি। ইতোমধ্যে মিয়ানমার সীমান্তের চলম?ান প?রি?স্থি?তি নয়াদি?লিস্ন সফ?রে তু?লে ধর?বেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণাল?য়ে আয়োজিত এক সংবাদ স?ম্মেল?নে তিনি এ তথ?্য জান?ান। তিন দি?নের সফ?রে আজ মঙ্গলবার দি?লিস্ন যাওয়ার কথা র?য়ে?ছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব?লেন, ভারতে গিয়ে আমার সেই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী ও নিরাপত্তা উপ?দেষ্টার স?ঙ্গে দেখা হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে আমরা সার্বিক বিষয়গুলো আলোচনা করব, যেহেতু মিয়ানমার ভারতেরও প্রতিবেশী রাষ্ট্র, আবার আমাদেরও প্রতিবেশী রাষ্ট্র। আমরা সব সময় ভারতের সহযোগিতা চেয়ে এসেছি। মিয়ানমার থেকে যাদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়েছে, তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের সহায়তা আমরা বহু আগে থেকেই চেয়েছি। সুতরাং, এ বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই আলোচনায় উঠবে। মিয়ানমার এমন একটি দেশ যে দেশে শান্তি বিরাজমান ছিল খুব কম সময়ই। সময়ে সময়েই এ দেশটাতে চলেছে সামরিক শাসন। আর এই সামরিক শাসনের কারণেই দেশটা মূলত বর্হিবিশ্ব থেকে বলা চলে একরকম বিচ্ছিন্নই। দেশটিতে চীনের প্রভাব তীব্র। বলা চলে চীনই সময়ে সময়ে সামরিক শাসকদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। এখনো চীন বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সমঝোতা চালাতে কিন্তু ব্যাহত এখনো তারা। এই প্রচেষ্টায় বিফল। বিশাল সম্ভাবনার এই দেশটিতে গণতন্ত্র বিরাজমান থাকলে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা বাণিজ্যিক দিক থেকে অনেক সহযোগিতা পেতাম কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে তার উল্টোটি। এমনি এক অস্থির পরিবেশের মধ্যে ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্য থেকে মূলত ওদের সেনাবাহিনী (যদিও গণতন্ত্রী পন্থি নেত্রী অং সাং সুচি তখন ক্ষমতায় ছিলেন) বারো লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমদের 'ওরা বাঙালি বলে' বাংলাদেশে বিতাড়িত করেছিল। সেই সঙ্গে ওদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছিল। যেই বারো লাখ রোহিঙ্গার বোঝা আমরা আজ পর্যন্ত বহন করছি। মিয়ানমারের জান্তা সরকার ওদের নিচ্ছি নেই বলে এখনো নিচ্ছে না। লাখ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতিতে যেভাবে ওই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা সেনাবাহিনীর সদস্যরা প্রাণ ভয়ে এ দেশে প্রবেশ করছে তা সত্যিই ভয়ের কারণ। এর সঙ্গে সঙ্গে যে কোনো বৈরী পরিস্থিতিতে সাধারণ রোহিঙ্গাদের আবার এ দেশে ঢল নামবে না তারই বা নিশ্চয়তা কী। যদি বিষয়টি এমনি দাঁড়ায়- তাহলে বাংলাদেশের জন্য তা হবে অত্যন্ত বিপর্যয়কর। তাছাড়া আরও একটি ভয়ের কথা মাথায় উঁকি দিচ্ছে, তাহলো- যদি আরকান আর্মি রাখাইন রাজ্য দখল করে নেয় তাহলে ওরা কি বাংলাদেশে যে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিচ্ছে ওদের রাখাইনে ফেরার বিষয়টি মেনে নেবে? বিষয়টি সত্যিই এমন হলে তা যেমন রোহিঙ্গাদের জন্য তেমনি বাংলাদেশের জন্যও আরও বিপর্যয়কর নিঃসন্দেহে।
মো. মাঈন উদ্দিন : কলাম লেখক