পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের এমন একটি পাহাড়ি অঞ্চল, যে অঞ্চলের সুভাষিত সবুজের স্পর্শ পাওয়ার তাড়নায় দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন সমতলের মানুষ। শুধু দেশের মানুষ? বিদেশি পর্যটকদের কাছেও পার্বত্য চট্টগ্রাম আকর্ষণীয় পর্যটন অঞ্চল। আর এই পর্যটন অঞ্চলকে কেন্দ্র করে দেশি-বিদেশি কোম্পানির বাণিজ্যিক হোটেল, রেস্তোরাঁ তৈরি হয়েছে। যার বেশির ভাগ অংশ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর চাষাবাদের ভূমি দখল করে। প্রকৃতির অসাধারণ সৌন্দর্যে সুভাষিত সবুজ পাহাড় দিন দিন কেটে কেটে পর্যটনকেন্দ্র করা হচ্ছে। এই পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লাভবান হওয়ার কোনো সুযোগ নেয়। উল্টো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভূমি হারাতে হয়। পাহাড়ে প্রায় খবরের শিরোনাম হতে হয় হত্যা, গুম, নির্যাতন। এই হত্যা, গুম স্বাধীনতার পূর্বেও ছিল, স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৫৩ বছর এই হত্যা, গুম অবধারিত। পাহাড়ের শিশুরা বাবা, মা, ভাই হারানোর বেদনা নিয়ে বড় হয়। কিন্তু বারবার কেন সবুজ পাহাড় রক্তাক্ত হয়? কেন পাহাড়ের শিশুরা তাদের বাবা, মা, ভাই হারানোর বেদনা নিয়ে বড় হবে? তারা কি দেশের নাগরিক না? নাগরিক হিসেবে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা কোথায়?
পাহাড়ে আধুনিক কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেয়, যেটুকু পরিমাণে রয়েছে প্রয়োজনের চেয়ে অত্যন্ত কম। পাহাড়ে চিকিৎসাসেবার সঠিক কোনো ব্যবস্থা নেয়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স থাকলেও সেখানে মানসম্মত কোনো চিকিৎসাসেবা নেই। ডাক্তার, নার্স সংকট তো রয়েছে, চিকিৎসা সরঞ্জামেরও ব্যাপক সংকট। দুর্গম পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা এখনো অনুন্নত হওয়ায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স কিংবা হাসপাতালে আনার পথেই মৃতু্যঝুঁকিতে থাকতে হয়। অন্যদিকে পাহাড়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বাহিরে বাঙালি জনগোষ্ঠীরাও বাস করে। এখানকার বাঙালি জনগোষ্ঠীরা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে বর্ণবাদী দৃষ্টিতে দেখেন। যার ফলে বাঙালি জনগোষ্ঠী দ্বারা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরা নির্যাতিত নিপীড়িত হোন। উলেস্নখ্য, ১৯৮০, ১৯৯২, ১৯৯৬ সালে বাঙালি ও তৎকালীন সেনাবাহিনী কর্তৃক পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ওপর বারবার হামলা, নির্যাতন ঘরবাড়ি পোড়ানোরসহ প্রায় হাজারের অধিক হত্যার অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সাধারণ জনগণ হিসেবে একজন সমতলের নাগরিকের যেমন অধিকার রয়েছে, ঠিক তেমনি একজন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সমান অধিকার রয়েছে। কিন্তু এর বাস্তব চিত্র হুবহু বিপরীত, পাহাড়ি জনগোষ্ঠী অধিকার বঞ্চিত। এই অধিকার বঞ্চনার যন্ত্রণা থেকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী আন্দোলন সংগ্রাম করে। নিজেদের শিক্ষা, চিকিৎসা, পাহাড়ের স্বায়ত্তশাসনসহ মৌলিক দাবি নিয়ে লড়াই করে। ঠিক তখনই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্য একদল বিচ্ছিন্ন গ্রম্নপ পাহাড়ে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, হত্যা ও নির্যাতন চালায়।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার, পাহাড়ের স্বায়ত্তশাসনের দাবি আদায়ের সংগ্রামের লড়াকু কর্মী কল্পনা চাকমাকে গুম করা হয়েছে দীর্ঘ ২২ বছর। আজ পর্যন্ত কোনো খোঁজ নেই, প্রশাসন এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তদন্ত রিপোর্ট দিতেও ব্যর্থ। পাহাড়ে শান্তি চুক্তির নামে অঘোষিত সেনাশাসনও জারি হয়েছে। যা নিয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ ও অভিযোগের শেষ নেই। সেনাশাসন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে আরও অবরুদ্ধ ও আতঙ্কিত করছে বলে অভিযোগ করছেন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরা। পাশাপাশি পাহাড়ে বারবার সংগঠিত হওয়া হত্যাকান্ডে সেনাবাহিনীর প্রশাসনিক তৎপরতা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে।
গত বছরের ১১ ডিসেম্বরের ২০২৩ তারিখ রাতে পানছড়িতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি বিপুল চাকমা, পিসিপির সহসভাপতি সুনীল ত্রিপুরা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের নেতা লিটন চাকমা ও ইউপিডিএফ সদস্য রুহিন বিকাশ ত্রিপুরাকে সন্ত্রাসীরা নিহত করে। ঘটনার পর লাশ উদ্ধারের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সময়ক্ষেপণ নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। ঘটনার পর সন্ত্রাসীদের কাউকে এখনো পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি প্রশাসন। প্রশাসনের এমন নীরব ভূমিকার ফলে ৪৩ দিনের মাথায় নতুন বছর শুরু হতে না হতেই পাহাড়ে আবারও হত্যা গত ২৪ জানুয়ারি ২০২৪ দূরছড়ি গ্রামের নিজ বাড়িতে তিন ইউপিডিএফ সদস্য রবি কুমার চাকমা, শান্ত চাকমা ওরফে বিমল ও রহিন্তু চাকমা ওরফে ত্রিপল সেখানে অবস্থান করছিলেন। সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলায় রবি কুমার চাকমা ও শান্ত চাকমা (বিমল) নিহত হয়েছেন।
পাহাড়ে এমন ভয়াবহ হত্যাকান্ডের ফলে, পাহাড়ি জনগোষ্ঠী নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এর মধ্যে প্রশাসনের নীরব ভূমিকা সেই শঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
সুতরাং, এই পরিস্থিতিতে পাহাড়ের স্বায়ত্তশাসন ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সরকার যদি এই পরিস্থিতি কালক্ষেপণ বা সময়ক্ষেপণ করে, তাহলে পাহাড়ের এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি গৃহযুদ্ধের দিকে অতিক্রম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মারুফ হাসান ভূঞা
মিরপুর, ঢাকা