ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্কের ফাটল নেপথ্যে চীন?

ভারতের ঐতিহাসিক ঘনিষ্ঠ মিত্রকে নিজেদের করে নেওয়াটা চীনের জন্য বৃহৎ কূটনৈতিক সফলতা বলেই বিবেচিত হবে। মালদ্বীপ ইস্যুকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক রাজনীতিতে চীন যে ভারতকে আবার চেকমেট দিতে যাচ্ছে তা সুস্পষ্ট।

প্রকাশ | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

মাহমুদুল হাসান
বেশ কিছুদিন ধরেই এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে ভারত মালদ্বীপ সম্পর্কের টানাপড়েন। স্মরণকালের সবচেয়ে শীতলতম সম্পর্কে অবস্থান করছে দু'দেশ। মূলত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে কটাক্ষ করে মালদ্বীপের তিন মন্ত্রীর করা টুইট নিয়ে শুরু হয় বিতর্কের। নিজ দেশের প্রধাণমন্ত্রীকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য মোটেও ভালোভাবে নেয়নি ভারতীয়রা। ফলে, ভারতীয়রা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বয়কট মালদ্বীপ ট্রেন্ড শুরু করে। ভারতীয় পর্যটক ও এজেন্সিগুলো মালদ্বীপ ভ্রমণ বাতিল করতে শুরু করে। অবস্থা বেগতিক দেখে তিন মন্ত্রীকে সাময়িক বহিষ্কার করে মালদ্বীপ সরকার। কিন্তু দুই দেশের সম্পর্কের টানাপড়েন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে মালদ্বীপের ভারতবিরোধী ও চীনপন্থি রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মুইজুর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে সরে আসার ঘোষণায়। ২০২৩ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন চীনপন্থি এই নেতা। মূলত ভারতবিরোধী ক্যাম্পেইনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় আসেন মোহাম্মদ মুইজু। নির্বাচনে জয়লাভের পরই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল করার ইঙ্গিত দেন নতুন রাষ্ট্রপতি। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে মালদ্বীপের এই ভারতবিরোধী মনোভাবের পেছনে রয়েছে চীনের হাত। মূলত ভারতীয় উপমহাদেশে ভারতের ক্ষমতাবৃদ্ধিকে রুখতে একে একে ভারতের সব প্রতিবেশী দেশকে নিজেদের বলয়ে আনতে কাজ করছে চীন যা চীনের স্ট্রিং অব পার্লস নীতি নামে পরিচিত। এই নীতির নব্য সংযোজন মালদ্বীপ। ১৯৬৫ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই মালদ্বীপের ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশ হিসেবে কাজ করছে ভারত। দেশটিকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম দেশ ভারত। ১৯৭২ সালে সর্বপ্রথম মালদ্বীপে দূতাবাস স্থাপন করে তারা। মালদ্বীপের অর্থনৈতিক ও সামরিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে কাজ করছে ভারত। মূলত ভারতীয় মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের বাণিজ্য নিরাপত্তার স্বার্থে মালদ্বীপকে মিত্র হিসেবে শুরু থেকেই সঙ্গে রেখেছে ভারত। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ভারত মালদ্বীপ সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে। ভারতের সেনাবাহিনীর মালদ্বীপে অনৈতিক অবস্থান মালদ্বীপের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হিসেবে মনে করতে শুরু করেছে সে দেশের জনগণ। যার পরিপ্রেক্ষিতে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে ভারত খেদাও আন্দোলন এই আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করেই মুইজু সরকার ভারতীয় সৈন্যদের আগামী ১৫ মার্চের মধ্যে মালদ্বীপ ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। চীন সফর থেকে এসেই প্রেসিডেন্ট মুইজুর এই ঘোষণা ভালোভাবে নেয়নি ভারতীয় জনগণ। প্রেসিডেন্ট মুইজুর এই সিদ্ধান্তকে চীনের উসকানির ফল হিসেবেই দেখছে ভারতীয়রা। এদিকে, চীন বারবারই মালদ্বীপে ভারতীয় সৈন্যের অবস্থানকে বাহ্যিক অনুপ্রবেশ বলে আসছে। ভারতীয় মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে বেশ কিছু বছর ধরেই তোড়জোড় করছে চীন। একে একে এই অঞ্চলের সব দেশকে নিজেদের বলয়ে আনতে জোর কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা। ভারত মহাসাগরে মালদ্বীপের ভূ-কৌশলগত অবস্থান চীন ও ভারত উভয় দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত মহাসাগরে মালদ্বীপ সি লাইন অব কমিউনিকেশনের সংযোগস্থলে অবস্থিত। বিশ্বের মোট তেল বাণিজ্যের দুই তৃতীয়াংশ পরিবহণ করা হয় এই লাইনের মাধ্যমে। চীনের মোট জ্বালানি আমদানির ৬০ শতাংশ এই বৈশ্বিক রুটের মাধ্যমে পরিবহণ করা হয়। অন্যদিকে, ভারত নিজেদের জ্বালানি আমদানির ৮০% পরিবহণ করে এই রুট ব্যবহার করে। বৈশ্বিক বাণিজ্যের এই হাবে তাই নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে ভারত, চীন দুই দেশই মালদ্বীপকে নিজেদের বলয়ে রাখতে চাইছে। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের আধিপত্য বিস্তারের এই লড়াইয়ে মালদ্বীপের অবস্থান বারবারই রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও ক্ষমতায় পালাবদলে যখনই ভারতবিরোধী কোনো সরকার গঠিত হয়েছে তখনই মালদ্বীপের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে মনযোগ দিয়েছে চীন। ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম মালদ্বীপের ক্ষমতায় আসে ভারতবিরোধী প্রেসিডেন্ট আব্দুলস্নাহ ইয়ামিন আব্দুল কাইয়ুম। এই সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের শীতলতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে মালদ্বীপে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে শুরু করে চীন। চায়নিজ সরকার এ সময় মালদ্বীপে প্রবেশ করে নানা ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট নিয়ে। এই সময়ই মালদ্বীপ চায়নিজ বেল্ট অ্যান্ড রোডস ইনিশিয়েটিভের অংশ হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় আসে ভারতপন্থি প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহ। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আবার কাজ শুরু করে মালদ্বীপ। এ সময় সোলিহ সরকার ভারত ফাস্ট নীতি গ্রহণ করে। আর্থসামাজিক, বাণিজ্যিক, সামরিক সর্বখাতে সোলিহ সরকারের এই ভারত ফাস্ট নীতি মালদ্বীপের জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। দেশজুড়ে শুরু হয় ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেন। মূলত মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহারের জন্যই ছিল এই আন্দোলন। ইন্ডিয়া আউট আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে ২০২৩ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে পিপিএম ও পিএনসি জোট সরকার। প্রেসিডেন্ট হন চীনপন্থি নেতা মোহাম্মদ মুইজু। ক্ষমতায় এসেই ইন্ডিয়া আউট নীতি গ্রহণ করতে শুরু করেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুইজু। ভারতবিরোধী নীতির অংশ হিসেবেই চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজুতকরণে কাজ করছে মুইজু। মালদ্বীপের ইতিহাসে এই প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসার পর প্রথম বিদেশ সফরে ভারত নয় চীন সফর করেছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুইজু। সম্প্রতি গত ৮ থেকে ১২ জানুয়ারি ৫ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে চীনে যান প্রেসিডেন্ট মুইজু। এই সফরে দুই দেশের মধ্যে ২০টি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এ সময় চীনা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে দেখা করে মালদ্বীপে চীনা বিনিয়োগের আহ্বান জানান প্রেসিডেন্ট মুইজু। চীন সরকার মালদ্বীপে প্রায় ১৩ কোটি ডলার আর্থিক সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে।চীন থেকে ফিরেই সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে কড়া ভাষায় বিবৃতি প্রদান করেন প্রেসিডেন্ট মুইজু। ছোট দেশ হলেও মালদ্বীপের ওপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার কোনো দেশের নেই বলে হুংকার জানান তিনি। ভারতকে উদ্দেশ্য করে চীন সফরের পরপরই তার এমন হুংকার যে ভারত মালদ্বীপের ডুবতে থাকা সম্পর্কের কফিনের শেষ পেরেক হতে যাচ্ছে তা আর বুঝতে বাকি নেই। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে মালদ্বীপের এমন শক্ত ভারতবিরোধী অবস্থানের নেপথ্যে সরাসরি কাজ করছে চীন। ভারতীয় মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য অর্জনে চীনের অন্যতম হাতিয়ার এখন মালদ্বীপ। যদিও মালদ্বীপের সাধারণ জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাবই চীনকে মালদ্বীপে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে- তবে চীনের আর্থিক বিনিয়োগ, অবকাঠামোগত উন্নয়নের অংশীদারিত্ব ও সুপরিকল্পিত পররাষ্ট্র নীতি যে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মালদ্বীপের বর্তমান রাষ্ট্রীয় ঋণের ৩৭ শতাংশ চীনা ঋণ। মালদ্বীপের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে চীনের ব্যাপক অংশীদারত্ব স্থানীয় জনগণের মনে শক্ত অবস্থান গড়ে নিয়েছে। এছাড়াও মালদ্বীপের নিরাপত্তা খাতে চীনের আগ্রহ বহুকাল থেকেই। ২০১৭ সাল থেকেই চীনা যুদ্ধজাহাজ মালদ্বীপে ডক করার অনুমতি পেয়ে আসছে। মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সামরিক বাহিনী সরে গেলে যে মালদ্বীপের নিরাপত্তার শূন্যতা পূরণে চীন এগিয়ে আসবে তা অনুমেয়। এমনটা হলে ভারতীয় মহাসাগরীয় অঞ্চলের চীনের কাছে নিজেদের আরেক মিত্রকে যে হারাতে যাচ্ছে ভারত তা বলাই যায়। ভারতের ঐতিহাসিক ঘনিষ্ঠ মিত্রকে নিজেদের করে নেওয়াটা চীনের জন্য বৃহৎ কূটনৈতিক সফলতা বলেই বিবেচিত হবে। মালদ্বীপ ইস্যুকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক রাজনীতিতে চীন যে ভারতকে আবার চেকমেট দিতে যাচ্ছে তা সুস্পষ্ট। মাহমুদুল হাসান : নবীন লেখক