মিয়ানমারে অস্থিরতা বাংলাদেশের উদ্বেগ

এটা সত্য, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সে দেশের সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর অত্যাচারের মুখে পালিয়ে আসা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ মানবিকতার পরিচয় দিলেও সেই রোহিঙ্গাদের কারণেই চরম সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া। এরপর যদি নতুন করে সংকট তৈরি হয়, তা হবে বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক। এ ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ জরুরি।

প্রকাশ | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
মিয়ানমারের রাখাইনে জান্তা বাহিনী এবং সশস্ত্রগোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। এই সংঘর্ষে উভয়পক্ষ মর্টার শেল, রকেট লঞ্চার, মেশিনগানসহ ভারী অস্ত্র ব্যবহার করছে। এর ফলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্ত এখন বেশ উত্তপ্ত। এর মধ্যে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে দুইজন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন বাংলাদেশি নারী, অন্যজন রোহিঙ্গা পুরুষ। সোমবার বিকাল পৌনে ৩টার দিকে ওই ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামের একটি রান্নাঘরের উপর মর্টার শেলটি এসে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ক্ষেতের কাজের ফাঁকে রোহিঙ্গা শ্রমিকসহ দুপুরের খাবার রান্না করছিলেন হুসনে আরা। এ সময় হঠাৎ বিকট শব্দে মর্টার শেল বিস্ফোরণ হলে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি। আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে রোহিঙ্গা শ্রমিককে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষের জেরে মিয়ানমারে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের লড়াইয়ের মধ্যে গোলাগুলি কিছুটা কমলেও নতুন করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির আরো ৬৩ জন। এ নিয়ে গত চার দিনে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যসহ মোট ৩২৭ জন পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন। অন্যদিকে, ঘুমধুম সীমান্তের অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে মিয়ানমারের ৪০০ চাকমা। পাশাপাশি কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গাও সীমান্তে জড়ো হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, সুযোগ পেলে তারা বাংলাদেশে ঢুকে পড়বে। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালানোর আশঙ্কা দেখছে জাতি সংঘের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়। এখানে উলেস্নখ করা প্রয়োজন, ২০২১ সালে সামরিক অভু্যত্থানে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে মিয়ানমারের ক্ষমতা নেয় দেশটির সেনাবাহিনী। ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষ দিক থেকে মিয়ানমারের তিনটি জাতিগত বিদ্রোহী বাহিনী একজোট হয়ে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ শুরু করে। বাহিনীগুলো হল- তা'আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি-টিএনএলএ, আরাকান আর্মি-এএ এবং মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি-এমএনডিএএ। তারা শান, রাখাইন, চীন ও কেয়াহ রাজ্যে লড়াই চালাচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সামরিক জান্তাবিরোধীরা মিয়ানমারে ৩শ'র বেশি সামরিক চৌকি এবং ২০টি শহর দখল করে নিয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে মিয়ানমারে চলা ওই সংঘাতের আঁচ এসে লেগেছে বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে নিরাপত্তার কারণে সীমান্তের পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণাও করেছিল প্রশাসন। স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়া হচ্ছে। মিয়ানমারের বিরোধী সশস্ত্র দলে জাতিগত ২০টি গোষ্ঠীর এক লাখ ৩৫ হাজার সদস্য, ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট-এনইউজির আওতায় পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের ৬৫ হাজার সদস্য এবং সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্ট মুভমেন্টের অধীনে প্রায় দুই লাখের মতো কর্মী রয়েছে। স্বায়ত্ত শাসনের জন্য লড়ছে এমন কয়েকটি জাতিগত গোষ্ঠীর সঙ্গে ২০২২ সালে জোট গঠন করেছে এনইউজি। এদের এর প্রায় দুই লাখ সেনার একটি বাহিনী রয়েছে- যা আরো বাড়তে থাকবে। এটি জেনারেল মিন অং লাইংয়ের বাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট। অন্যদিকে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতে প্রায় চার লাখ সেনা রয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট ফর পিস-এর তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতে প্রায় দেড় লাখের মতো সেনা রয়েছে। এর মধ্যে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বা কমব্যাট রেডি ৭০ হাজার সেনাও অন্তর্ভুক্ত। মিয়ানমারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বিদ্রোহী বাহিনীর। বর্তমানে সামরিক বাহিনী এমন সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছে- যা এর আগে মিয়ানমারের ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। সামরিক বাহিনীর মধ্যেও নজিরবিহীন আত্মসমর্পণের ঘটনা দেখা গেছে। সামরিক বাহিনীর নেতারা সামরিক পরাজয় মানতে বাধ্য হয়েছেন। প্রতিরোধ আন্দোলন সফল করার জন্য এটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এবং কাঠামোগত বাধা ও তেমন কোনো আন্তর্জাতিক সমর্থন ছাড়াই এটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। সংস্থাটি বলছে, টানা দুই বছর ধরে ছোট ছোট সফলতা পাওয়ার পর এই আন্দোলন ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে সুসংগঠিতভাবে দেশজুড়ে সামরিক অভিযান পরিচালনা শুরু করেছে- যা এখন আসলেই জান্তা সরকারের শাসনকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এর জের হিসেবে, গত তিন বছরে দেশটির ২৬ লাখ মানুষ শরণার্থীতে পরিণত হতে বাধ্য হয়েছেন। সেনা অভু্যত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের অর্থনীতিও টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে। গত বছর অন্তত তিন দফায় জ্বালানি সংকট হয়েছে এবং পণ্যের দামও তিন দফায় বেড়েছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনী আবার চীনের আশির্বাদপুষ্ট। বরং এটা চীনের একটি সুনিপুন কৌশলও হতে পারে। আরাকানে ভূ-রাজনৈতিক কৌশল ও ভূ-রাজনৈতিক অর্থনীতিবিষয়ক বিপুল স্বার্থ রয়েছে চীন ও ভারতের। এ বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, গত ছয় বছর জনবহুল বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের চাপ সহ্য করছে। মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেয়ার অর্থ এই নয় যে, তাদের আজীবন রাখতে হবে। এটা এখন বাংলাদেশের জন্য বিরাট বোঝা। বাংলাদেশ চায় সুষ্ঠু সুন্দর ব্যবস্থাপনায় নাগরিক মর্যাদায় তাদের পূর্ণ অধিকার দিয়ে ফেরত নেয়া হোক। তারা যেন ঠিকভাবে তাদের বাড়িঘরে গিয়ে উঠতে পারে, চাষবাস শিক্ষার পূর্ণ নাগরিক অধিকার যেন তারা ভোগ করতে পারেন, রাষ্ট্রীয় নানা সুবিধা ও নাগরিক মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারে। বাংলাদেশের নাগরিক ও সরকারের সেটাই কাম্য। আমরা আশা করব, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দ্রম্নত হোক। আর কত সময় ক্ষেপণ? মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে এখন নানা ধরনের ঝামেলায় পড়েছে। উলেস্নখ্য, ২০১৭ সালের আগ পর্যন্ত ৩ লাখের মতো রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নেন কক্সবাজারে। টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে থাকছিলেন তারা। ২০১৭ সালের অগাস্টে রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশ সীমান্তে নামে রোহিঙ্গাদের ঢল। সব মিলিয়ে এখন ১১ লাখের মতো রোহিঙ্গা রয়েছে বাংলাদেশে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, তাদের নিরাপত্তা, নিজের সম্পত্তির মালিক হয়ে বাসভূমিতে ফিরে যাওয়া এই বিষয়গুলো নিশ্চিত হয়নি বলেই আস্থার অভাবে রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফেরত যেতে চাচ্ছে না। এটা সত্য, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সে দেশের সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর অত্যাচারের মুখে পালিয়ে আসা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ মানবিকতার পরিচয় দিলেও সেই রোহিঙ্গাদের কারণেই চরম সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, পুলিশ আক্রান্ত, ডাকাতি বা ডাকাতির প্রস্তুতি, হত্যা, মানবপাচার ও অন্যান্য অপরাধে রোহিঙ্গা অপরাধীদের বিরুদ্ধে গত তিন বছরে ৭৩১টি মামলা হয়েছে। যাতে আসামি হয়েছেন এক হাজার ৬৭১ জন রোহিঙ্গা। এর মধ্যে ৫৩টি খুন, ৪১০টি মাদক, ২৮টি মানবপাচার, ৫৯টি অস্ত্র, ৩৫টি ধর্ষণ ও ১০টি ডাকাতি এবং ১৬টি অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের মামলা উলেস্নখযোগ্য। ২০১৭ সালে নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ছিল ৭৬টি আর আসামি হন ১৫৯ জন। ২০১৮ সালে ২০৮ মামলায় আসামি হয়েছেন ৪১৪ জন। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৬৩টি আর আসামি হন ৬৪৯ জন। এরপরও কয়েক হাজার মামলা হয়েছে। এটা সত্য, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সে দেশের সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর অত্যাচারের মুখে পালিয়ে আসা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ মানবিকতার পরিচয় দিলেও সেই রোহিঙ্গাদের কারণেই চরম সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া। এরপর যদি নতুন করে সংকট তৈরি হয়, তা হবে বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক। এ ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ জরুরি। সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক