জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ইটভাটা আইনের বাস্তবায়ন জরুরি
জলবায়ু, প্রকৃতি ও জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে সনাতন পদ্ধতির অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করা ছাড়া অন্য কানো বিকল্প নেই।
প্রকাশ | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
ভূঁইয়া শফি
বড় বড় দালান থেকে ইমারত, যাই বলা হোক না কেন? সবকিছুই তৈরি হয় ছোট ছোট ইট থেকে। ছোট ছোট ইট একটি আরেকটির ওপর বসিয়ে তৈরি করা হয় উচ্চ দালান, বহুতল ভবন। যে কোনো ধরনের নির্মাণ স্থাপনা তৈরি করতে ইটের প্রয়োজন। আর এসব ইট তৈরি করা হয় ইটভাটায়। তবে অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈধ ইটভাটার কারণে ফসলি জমি ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নের স্বার্থে আমাদের দেশে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে এ আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকার কারণে যেখানে সেখানে যত্রতত্র ইটভাটা স্থাপন করছে ভাটা মালিকরা। ইটভাটাগুলো বিভিন্নভাবে আমাদের বাসযোগ্য পরিবেশের ক্ষতি সাধন করছে। সেই সঙ্গে ইটভাটার দূষণে বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে আমাদের জলবায়ুতে প্রভাব ফেলছে। জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে প্রথমত ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে মোট ইটভাটার সংখ্যা ৭ হাজার ৮৮১টি বা প্রায় ৮ হাজার। যাতে বছরে প্রায় ২১ বিলিয়ন ইট তৈরি করা হয়। এর মধ্যে ৩ হাজার ২৪৮টি (অর্ধেকের কম) ইটভাটা অনুমোদন নিয়ে বৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বাকিগুলো অনুমোদনবিহীন অবৈধ। সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও প্রশাসনের নজরদারির অভাবের কারণে আইনের তোয়াক্কা না করে চলছে এসব অবৈধ ইটভাটা।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ ও সংশোধনী-১৯ বলছে, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নের স্বার্থে আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটা অর্থাৎ জিগজ্যাগ ক্লিন, হাইব্রিড হফম্যান ক্লিন, ভার্টিক্যাল শফট ক্লিন, টানেল ক্লিন বা অনুরূপ উন্নততর কোনো প্রযুক্তির ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। তাছাড়া আবাসিক, জনবসতি, সংরক্ষিত এলাকার বনভূমি ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। এছাড়া সরকারি বনাঞ্চলের সীমারেখা থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বে ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র, জেলা প্রশাসকের অনুমোদন বা লাইসেন্স না নিয়ে ইটভাটা চালু করা যাবে না। আর এ আইন অমান্য করলে ১০ বছরের কারাদন্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
আর এসব ইটভাটা তদারকি করার জন্য জেলা প্রশাসকের নির্দেশে বন বিভাগ, স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নজরদারির অভাবে সারাদেশের ইটভাটা মালিক এসব আইনের তোয়াক্কা না করে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে দেদারসে তাদের অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে এর প্রভাব পড়ছে প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্যের ওপর। সবচেয়ে বড় আঘাত হানছে আমাদের মৌসুমি জলবায়ুর ওপর।
ইটভাটায় সাধারণত কয়লা দিয়ে ইট পুড়ানো হয়ে থাকে। এতে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইডসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকারক গ্যাস তৈরি হয়- যা ইটভাটার ধোঁয়ার সঙ্গে বায়ুতে মিশে বায়ুকে দূষিত করে। এই বায়ু দূষণের ফলে মানুষের শ্বাস-কষ্ট, ফুসফুসে ক্যানসারসহ নানা রোগ হয়। অবৈধ ইটভাটাগুলোর চিমনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উচ্চতায় কম। এতে করে নির্গত হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে কালো ধোঁয়া। বিষাক্ত ধোঁয়ায় ছেয়ে যাচ্ছে ইটভাটার আশপাশের এলাকা, গাছপালা ও বসতি। ফল গাছের ফলমূলসহ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমির ফসল। এদিকে জমির ওপরিভাগের উর্বর মাটি (টপ সয়েল) ইটভাটাগুলোতে দেওয়ার কারণে জমিগুলো পরিণত হচ্ছে জলাশয়ে। যার কারণে চাষের জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। যে জমি থেকে মাটি যাচ্ছে তার উর্বরতা তো নষ্ট হচ্ছেই, সঙ্গে পাশের উর্বর জমিগুলোও ভেঙে পড়ছে। ওই পাশের জমির মালিক এক সময় বাধ্য হয়েই ইটভাটার কাছে মাটি বিক্রি করছে। এতে করে কৃষি আবাদি জমির সংকট দেখা দিচ্ছে। আবার ইটভাটার মাটি, ইট, কয়লা, গাছ বহনের জন্য কৃষিকাজে ব্যবহৃত ট্রাক্টর দিয়ে বানানো মালবাহী ট্রাক্টর ব্যবহার করা হচ্ছে বাহন হিসেবে। এতে ব্যাপক ক্ষতিসাধন হচ্ছে গ্রামীণ সড়কের। যাতায়াতে ভোগান্তিসহ প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। মালবাহী ট্রাক্টর দিয়ে মাটি নেওয়ার সময় অনেক মাটি রাস্তায় পড়ে যায়। হালকা বৃষ্টি হলে এসব মাটি পিচ্ছিল হয়ে রাস্তাকে পিচ্ছিল করে দুর্ভোগ সৃষ্টি করে মানুষ ও গাড়ি চলাচলের। অনেক সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটে।
এছাড়াও আমাদের দেশে বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ইটভাটার দূষণ। ইটভাটা দূষণ আমাদের পরিবেশকে বেশ ভালোভাবে প্রভাবিত করছে। অবৈধ ইটভাটায় বন উজাড় করে গাছ পোড়ানো হচ্ছে- যার ফলে পরিবেশ থেকে গাছপালা ও বনজঙ্গলের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। গাছপালা বায়ু থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। কিন্তু গাছ কেটে ফেলার কারণে পরিবেশে কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ বিভিন্ন গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এদিকে, আবার ইটভাটায় কয়লা পোড়ানো হচ্ছে। কয়লা পোড়ালে সালফিউরিক এসিড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ইত্যাদি গ্যাস তৈরি হয়- যা আমাদের বায়ুতে মিশে বায়ুমন্ডলকে বিষাক্ত করে তুলছে। সেই সঙ্গে বায়ুতে এই কার্বন ডাই-অক্সাইড ও গ্রিন হাউস গ্যাস বৃদ্ধি পাওয়ায় পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে, মেরু অঞ্চলের বরফ ও হিমবাহ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বর্তমান সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইটভাটার দূষণ আমাদের মৌসুমি জলবায়ুর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ইতোমধ্যে আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনাবৃষ্টি দেখা দিয়েছে। গ্রিন হাউস গ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা মতে, গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণের কারণে গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া ক্রমাগত চলতে থাকলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে। এর ফলে, মেরু অঞ্চলের বরফ ও হিমবাহ গলে গিয়ে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়িয়ে দিতে পারে। সমুদ্রের পানির উচ্চতা ১.৫ মিটারের অধিক হলে নিউইয়র্ক, লন্ডন, সিউল, বেইজিংয়ের মতো উপকূলীয় শহর, দ্বীপরাষ্ট্রসমূহ যেমন- মালদ্বীপ, টোকিও শহরসহ উপকূলবর্তী অনেক এলাকা সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যেতে পারে। আশঙ্কার তালিকায় বাংলাদেশেরও অনেক জেলা শহর হয়েছে- যা সমুদ্রের নিচে চলে যেতে পারে। জলবায়ুতে বিরূপ প্রভাব ফেলার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেবে। তাছাড়া জলবায়ুতে প্রভাব ফেলার কারণে ঋতুচক্রের পরিবর্তন ঘটবে। যার ফলে, অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি দেখা দেবে। যে সব অঞ্চলে অতিবৃষ্টি হবে সেসব অঞ্চলে বন্যার কারণে চাষাবাদ সম্ভব হবে না। আবার যে সব অঞ্চলে অনাবৃষ্টি দেখা দেবে সেসব অঞ্চলে খরা হবে। সেখানে পানির অভাবে চাষাবাদ হবে না।
জলবায়ু, প্রকৃতি ও জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে সনাতন পদ্ধতির অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করা ছাড়া অন্য কানো বিকল্প নেই।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের স্বার্থে আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটা অর্থাৎ জিগজ্যাগ ক্লিন, হাইব্রিড হফম্যান ক্লিন, ভার্টিক্যাল শফট ক্লিন, টানেল ক্লিন বা অনুরূপ উন্নততর কোনো প্রযুক্তির ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা স্থাপনে ভাটা মালিকদের উৎসাহিত করতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করতে হবে। ইটের প্রয়োজন মেটাতে ইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধব কংক্রিট বস্নক তৈরিতে উৎসাহ দিতে হবে। কংক্রিট বস্নক তৈরিতে ব্যবহার হয় সিমেন্ট, কুচিপাথর, সিলেটের বালু, সাধারণ বালু ও স্টোন ডাস্ট- যা মাটি ছাড়াই এবং না পুড়িয়ে তৈরি করা হয়। এতে পরিবেশ ও জলবায়ুরও কোনো ক্ষতি হয় না। কংক্রিট বস্নক ব্যবহারের সুফল অনেক। সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে, সনাতন লাল ইটের চেয়ে এর নির্মাণ খরচ তুলনামূলক কম। তাই কংক্রিট বস্নক ব্যবহারে উৎসাহ দিতে হবে। ইটভাটার ক্ষতিকারক প্রভাব নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। সবার মাঝে পরিবেশ ও বায়ুদূষণের প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
ভূঁইয়া শফি : কলাম লেখক