উন্নয়ন আর অগ্রগতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশের নানা সেক্টরে। উন্নতির প্রশংসা জনগণের মুখে মুখে শুনা যায়। মানুষ ঘরে বসে তাদের সমস্ত রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। ঘর থেকে বের হলেই দোকানে গিয়ে কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্ত ধরনের তথ্য আদান-প্রদান করতে পারছে। ছাত্র থেকে কর্মজীবী সব ধরনের পেশার মানুষ আপনাপন পেশার জন্য যা যা প্রয়োজন সব সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টর থেকে পাচ্ছে। প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টরের সুযোগ-সুবিধা মোবাইল ইন্টারনেটের মাধ্যমে সহসায় ঘরে বসে নিচ্ছে। রাস্তাঘাটের যথেষ্ট অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে। স্থানীয় এবং দূরপালস্নায় যাতায়াতের জন্য পরিবহণ ব্যবস্থা ও যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। তবুও মানুষের মধ্যে তাদের জীবনযাপনে স্বস্তি আসছে না। মানুষের আয় ইনকাম বেড়েছে। কর্মক্ষমতা আছে। কিন্তু ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। আয়ের চেয়ে ব্যয়বৃদ্ধি জনমনে অস্বস্তি। বাজার, মার্কেট ও দোকানে গিয়ে মানুষ তাদের নির্দিষ্ট বাজেটের মধ্যে কিছুই ক্রয় করতে পারছে না। এসব বিষয়ে প্রতিদিন দেশের সংবাদপত্রগুলো সরে জমিনে প্রতিবেদন উপস্থাপন করছে। নতুন সরকার এসেছে সংসদ গঠিত হয়েছে। মন্ত্রী পরিষদ তৈরি হয়েছে। সংসদ অধিবেশন বসছে।
জনগণের বহু প্রত্যাশা ছিল- আছে বর্তমান সরকারের ওপর। গত সরকারের মেয়াদ শেষের দিকে যখন দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি এবং জনগণের উৎকণ্ঠার শেষ ছিল না তখন জনগণ মনে করছিল নির্বাচনের পরে বাজার সিন্ডিকেট বন্ধ হবে। বাজারে স্বস্তি ফিরে আসবে। চাল, ডাল, নুন ও মরিচ অপারপর সমস্ত পণ্যের লাগাম টেনে ধরবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সে আশা নিয়ে অপেক্ষায় ছিল দেশের মানুষ। কিন্তু নির্বাচন হয়েছে, সরকার গঠন করা হয়েছে; মন্ত্রিপরিষদ ও সংসদ অধিবেশন শুরু হয়েছে। বাজার পরিস্থিতির কোনো উন্নতি জনগণ দেখছে না। ইতোমধ্যে কোনো কোনো পণ্যের মূল্য আরও বেড়ে গেছে। চালের মূল্য ব্যাপকভাবে নানা মার্কেটে বেড়ে গেছে। প্রচুর পরিমাণ চাল মজুত দেখা গেলেও মূল্য হু হু করে বাড়ছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের নির্দিষ্টভাবে বেতন ভাতা সুযোগ-সুবিধার ওপর আরও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছে সরকার। ফলে, তাদের জীবনযাপন ভালোই চলছে বলা যায়। বেসরকারি খাতে কর্মরত কর্মকর্তা, শ্রমিক ও দিনমজুরের তাদের বেতন বাড়েনি। নির্দিষ্ট বেতনে নির্দিষ্টভাবে তাদের জীবনযাপন করতে হচ্ছে। তাদের কষ্টের শেষ নেই। বেসরকারি পর্যায়ে সবগুলো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেহাল অবস্থা। জনগণের সাধারণ জীবনযাপন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে। শীতকালীন ভরা এই সবজির মৌসুমে সব ধরনের সবজির চড়া মূল্য। জনগণের বক্তব্য এই সবের পেছনে অনিয়ন্ত্রিত সিন্ডিকেট দায়ী।
এই সিন্ডিকেট কাদের সেটি কম বেশি সবাই অবগত। যারাই ক্ষমতায় রয়েছেন সিন্ডিকেট তাদেরই হাতে। বর্তমান সরকারের সংসদ ও মন্ত্রিপরিষদ বেশিরভাগই ব্যবসায়ী শিল্পপতি এবং পুঁজিপতিদের। ওরাই দেশের জনগণ এবং অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সমস্ত ধরনের ভোগ্যপণ্যের মার্কেট তাদের হাতে। তারাই আমদানি-রপ্তানিকারক; তারাই মার্কেট জাত করছে। বাজার থেকে অধিকমূল্যে জনগণের পকেট কাটছে তারাই। তাহলে বাজার মনিটরিং-সিন্ডিকেট ব্যবসা আমদানি-রপ্তানি সবকিছুর মালিক মুষ্টিময় মানুষই। তারা যদি চায় বাজারকে জনগণের নাগালের মধ্যে আনতে পারবে ও রাখতে পারবে। আর তারা যদি না চায় তাহলে জনগণকে খেয়ে না খেয়ে দুঃখে দুঃখে মরতে হবে। সিদ্ধান্ত সরকার প্রশাসনের। সরকার যদি কঠোর হস্তে সেসব সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে জনগণ কিছুটা স্বস্তি ফেলতে পারে।
উন্নয়নের নামে দেশের সিংহভাগ অর্থ লুটপাট হচ্ছে। মন্ত্রী ও আমলা থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিদের সম্পদের হিসাব দেখলে বুঝা যায় কি পরিমাণ সম্পদ তাদের হয়েছে। জনপ্রতিনিধি থাকার পূর্বে কি ছিল এবং পরে কি পরিমাণ তাদের অর্থ আয় হয়েছে সেই সব হিসেব থেকে দেশের মন্ত্রী- আমলা-জনপ্রতিনিধিদের সম্পদের শেষ নেই। একদিকে জনগণ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, স্বল্পসংখ্যক সরকারি জনপ্রতিনিধি ক্ষমতাকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে কয়েক বছরের মাথায় শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে। সরকারি দলের পদ-পদবি ব্যবহার করে তাদের অসংখ্য নেতাকর্মী গাঁ- গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত শত শত কোটি টাকার মালিক। এসব অর্থ জনগণের দেশের। উন্নয়নের অর্থ জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করে তারা সম্পদের পাহাড় গড়েছে। এসব বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় দেশ ও সরকার চলে। এর মধ্যেও উন্নয়নের জন্য সরকার বিদেশি দাতা সংস্থা থেকে লাখ লাখ টাকার ঋণ নিয়েছে। এই ঋণের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রেখেছে। সেই উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ লুটপাট করে দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক লিডার জনপ্রতিনিধি অর্থের পাহাড় গড়েছে। কতিপয় আমলারাও দুর্নীতির অর্থে অসংখ্য গাড়ি বাড়ি তৈরি করেছে, অর্থ পাচার করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে যেই ঋণ সরকার নিয়েছে সেই ঋণের বোঝা দেশের সমস্ত জনগণের ওপর। জনগণকে একদিকে উন্নয়ন দেখাচ্ছে অপরদিকে উন্নয়নের সিংহভাগ দুর্নীতির মাধ্যমে পকেটে যাচ্ছে। কিন্তু সমস্ত ঋণের বোঝা জনগণের কাধে এবং তাদেরই তা শোধ করতে হবে। পরিষ্কার করে দুর্নীতির সমস্ত অপরাধের বিচার করতে হবে। দুর্নীতি ও পাচারকৃত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করতে হবে। দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতা-আমলা সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। তবেই জনগণ সন্তুষ্ট। দুর্নীতি ছাড়া উন্নয়ন জনগণ সমর্থন করে। উন্নয়নের নামে দুর্নীতি লুটপাট অর্থ পাচার মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের কাছে প্রত্যাশা দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়তে যা যা করা দরকার জনগণ তার বাস্তবায়ন চায়।
মাহমুদুল হক আনসারী : সংগঠক, গবেষক ও কলামিস্ট