পস্নাস্টিক ব্যবহারের লাগাম টানতে হবে

প্রকাশ | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

আনোয়ার হোসেন শিক্ষার্থী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
দিন গড়ানোর সঙ্গে নানামুখী চাপে বিপর্যস্ত আজ বাংলাদেশের পরিবেশ। এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স ২০২২-এর এই তথ্যানুসারে পরিবেশ দূষণ রোধে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। বৈশ্বিক মোট পস্নাস্টিক দূষণের ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ বাংলাদেশে হয়। পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন করা হলেও, কার্যকর প্রয়োগের অভাবে পস্নাস্টিক থেকে পরিবেশ দূষণ শুধু অব্যাহতই নয়; বরং উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পস্নাস্টিক, পস্নাস্টিকজাত পণ্য যেমন- টুথব্রাশ, চিরুনি, চশমা, জুতা, স্যান্ডেল, মোবাইল সেট, কলম, স্যানিটাইজারের কনটেইনার, খনিজ পানির বোতল, করোনাকালে ফেসশিল্ড, মাস্ক- এসব পণ্য আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। শুধু ভ্রমণকালেই যে পাতলা পস্নাস্টিকের গস্নাসে পানি, চা, কফি বা গরম কিছু খাওয়া হচ্ছে, তা নয়; ক্রোকারিজ, কাটলারিজ ধোয়ামোছার ভয়ে এখন বাসাবাড়িতে পস্নাস্টিকের ওয়ানটাইম সামগ্রীর ব্যবহার বাড়ছে। সব দেশের সব এয়ার ক্র্যাফটে পস্নাস্টিক প্যাকেটে গরম খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। ম্যাচ এবং আবাসিক হলে পস্নাস্টিকের বোতলে পানি খাওয়া এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে সরবরাহকৃত খাবারের পুরোটাই পলিথিন ও পস্নাস্টিকজাত সামগ্রীর সাহায্যে প্যাকেট করা হচ্ছে। পস্নাস্টিক বর্জ্যসহ ব্যাপকভাবে বর্জ্য ফেলার কারণে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও কর্ণফুলী নদী বাংলাদেশের অন্যতম দূষিত নদীতে পরিণত হয়েছে। পস্নাস্টিক দূষণের কারণে আমাদের বাস্তুতন্ত্র ও ভূমির ব্যাপক দূষণ ঘটায় গাছপালা ও অন্যান্য প্রাণীর অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। গবেষকদের মতে, খাদ্যজালের মাধ্যমে পস্নস্টিকের অতি ক্ষুদ্র কণা প্রতিদিন মানুষের পেটে যাচ্ছে। পস্নাস্টিক উৎপাদনের সময় যে রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, তা মানবদেহের এন্ডোক্রাইন সিস্টেম ব্যাহত করতে পারে এবং শারীরিক বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখা হরমোনের কর্মকান্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পস্নাস্টিকে পাওয়া রাসায়নিক ক্যানসার, হৃদরোগ,অ্যালার্জিসহ আরও নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার সঙ্গে জড়িত। গবেষণায় জানা যায়, প্রতি বছর মাথাপিছু প্রায় ৫ কেজি পস্নাস্টিক দ্রব্যাদি ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে পস্নাস্টিক দ্রব্যাদির বাজার প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের। আর পস্নাস্টিক উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। ২০ লাখেরও বেশি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে জড়িত। ঢাকা শহরে প্রতিদিন এক কোটি ২০ লাখ পলিব্যাগ পরিত্যক্ত হয়ে তা পুকুর, ডোবা, নদী-নালা ও সাগরে গিয়ে জমা হচ্ছে। কৃষকের চাষের জমি, পুকুর, রাস্তাঘাট ভরে আছে পস্নাস্টিক বর্জ্যে। বিবিসি নিউজ বলছে, বিশ্বে প্রতি মিনিটে প্রায় পাঁচ লাখ পস্নাস্টিক বোতল বিক্রি হচ্ছে। পত্রিকার প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, দেশে করোনার প্রথম মাসে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার টন পস্নাস্টিক বর্জ্য; এর মধ্যে শুধু ঢাকায় এর পরিমাণ তিন হাজার ৭৬ টন। পস্নাস্টিক-পলিথিন অন্যান্য জিনিসের মতো সহজে মাটিতে মিশে না। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এক গবেষণায় বলছে, দোকানে মুদিপণ্য বহনের জন্য যেসব ব্যাগ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো প্রকৃতিতে মিশে যেতে ২০ বছর সময় লাগে। চা, কফি, জুস কিংবা কোমল পানীয়ের জন্য যেসব পস্নাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। আর ডায়াপার ও পস্নাস্টিক বোতল টিকে থাকে ৪৫০ বছর পর্যন্ত। মোদ্দা কথা হলো, দামে কম এবং ব্যবহারবান্ধব হওয়ায় পস্নাস্টিকজাত পণ্য দ্রম্নত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং নিত্যনতুন এসব পণ্য প্রতিনিয়ত বাজার দখল করছে। জীবন ধারণের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর ব্যবহার বেড়েই চলেছে। তাই ব্যক্তি, পরিবারিক পর্যায়ে ব্যবহৃত পস্নাস্টিকজাত পণ্যের বিকল্প সামগ্রীর মূল্য কমিয়ে আনতে হবে। তাহলে মানুষ বিকল্প পণ্যগুলো ব্যবহারে আগ্রহী হবে। বাসাবাড়িতে কাচ-টিন-অ্যালুমিনিয়াম-স্টিলের বালতি, গামলা, জগ, কৌটা, শিশির ব্যবহার অনায়াসে চালু করা যায়। পিকনিক, সামাজিক অনুষ্ঠান বা বড় গ্যাদ্যারিংয়ে পস্নাস্টিকের ওয়ানটাইম থালা-বাসন, গস্নাসের ব্যবহার বন্ধ করা যায়। আর বর্জ্য সম্পদে পরিণত করার কথা ভাবতে হবে। অর্থাৎ নষ্ট হয়ে যাওয়া পস্নাস্টিকসামগ্রী রিসাইকেল করে ব্যবহার করা এবং জৈব উপাদান ব্যবহার করে পচনশীল পস্নাস্টিক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া উচিত। সম্প্রতি পস্নাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংক প্রণীত একটি অ্যাকশন পস্ন্যান নীতিগতভাবে গ্রহণের পাশাপাশি জেলা কার্যালয় ও প্রতিষ্ঠানসমূহে 'সিঙ্গেল ইউজ পস্নাস্টিক' ব্যবহার বর্জনের যে নির্দেশনা এবং ২০১০ সালে জুট প্যাকেজিং আইন পাস করা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু তা যেন শুধু কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ না থাকে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক হওয়া এখন সময়ের দাবি।