ভাষার মাস ও বইমেলা
প্রকাশ | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ ঢাকা
ভাষার মাস, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হওয়ার মাস। তাই তো বাঙালি জাতি নানা আয়োজনের মাধ্যমে পুরো ফেব্রম্নয়ারি মাসজুড়ে ভালোবাসা জানাবে ভাষা শহীদদের প্রতি। 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা' পাকিস্তান সরকারের এমন ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয়। জাগে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি। তাই বাংলাভাষার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রম্নত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি এই আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে নিহত হন সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকসহ নাম না জানা আরও অনেকে।
এরপর পথ পরিক্রমায় রক্তের বিনিময় বাঙালি জাতি পায় মাতৃভাষার মর্যাদা এবং আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। সেই পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং একাত্তরে ৯ মাসব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
ভাষার জন্য বাংলার দামাল সন্তানদের আত্মত্যাগ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। এদিন ইউনেস্কো ২১ ফেব্রম্নয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' ঘোষণা করে। এর মধ্য দিয়ে একুশে ফেব্রম্নয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালন করা হয়। কেননা, পৃথিবীর একমাত্র জাতি হিসেবে বাঙালিই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল। আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ও জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ডা.এম এম মাজেদ...
ইতিহাস কখনো পুরনো হয় না, বার বার ফিরে আসে, নতুন করে তার অস্তিত্ব জানান দেয়। তেমনি ফিরে এলো ফেব্রম্নয়ারি, ঐতিহাসিক ভাষার মাস, গৌরবের মাস।
১৯৫২ সালে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেকে বুকের তাজা রক্তের বিনিময় মাতৃভাষাকে রক্ষা করেন। মায়ের ভাষা কেড়ে নেওয়ার এই সংগ্রামে সেদিন ছাত্র-জনতা একসঙ্গে রাজপথে নেমে পড়েছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষা নিয়ে এমন আন্দোলন আর কোথাও হয়নি। সে জন্য ফেব্রম্নয়ারি শুধু ভাষার মাস নয়, আত্মপ্রত্যয়ে উজ্জীবিত হওয়ারও মাস, বাঙালির গর্ব-অহংকারেরও মাস।
শুরুটা ১৯৪৭ সালের পর থেকেই। পাকিস্তান কৌশলে বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভাষার ওপর প্রথম আঘাত হানে। মায়ের ভাষায় কথা বলাও তারা বন্ধ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করে। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চায় উর্দুকে। কিন্তু বাংলার মানুষ সেই ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করতে একবিন্দু পিছু হটেনি। মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে প্রতিদিন রাজপথে চলতে থাকে মিছিল-সমাবেশ। শুরু হয় বাংলাভাষা রক্ষার আন্দোলন। আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অনেক চড়াই-উতরাই পার করে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি। হানাদারদের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশের গুলিতে প্রাণ ঝরে ছাত্র-জনতার। বায়ান্নর আগুনঝরা সে দিনগুলো বিশ্বের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।
মূলত সেই দিনগুলোর মধ্য দিয়েই বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আরও বেগবান হয়। এরই সূত্র ধরে এসেছিল ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ।
এই মাসের প্রথম দিন থেকে ধ্বনিত হয় সেই অমর সঙ্গীতের অমীয় বাণী 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...'। বাঙালি জাতি পুরো মাসে ভালোবাসা জানাবে তাদের, যারা ভাষার জন্য অকাতরে প্রাণ দিয়েছিলেন।
ভাষার জন্য এই আত্মত্যাগ পৃথিবীতে বিরল। এই আত্মত্যাগ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। এদিন জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো ২১ ফেব্রম্নয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' ঘোষণা করে। এরপর থেকে ২১ ফেব্রম্নয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।
ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রম্নয়ারির প্রথম দিন থেকেই শুরু হচ্ছে বিভিন্ন আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বীর সন্তানদের স্মরণ করবে জাতি।
ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রম্নয়ারির প্রথম দিন থেকেই শুরু হচ্ছে নানা কর্মসূচি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আবার হয়ে উঠবে জমজমাট। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এই মাসে আয়োজন করবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের।
২০২৪ সালের বইমেলার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, 'পড়ো বন্ধু গড়ো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ'। প্রসঙ্গত, ২০২৪ সাল অধিবর্ষ (লিপইয়ার) হওয়ার জন্য এবারের বইমেলা ২৯ দিনের। বইপ্রেমী পাঠক, লেখক, প্রকাশক সবপক্ষের জন্যই খুশি হওয়ার মতো বিষয় এটি।
এবার লিটল ম্যাগ চত্বর নিয়ে আসা হয়েছে মুক্তমঞ্চের পাশে। টিএসসির দিকের গেট দিয়ে মেলায় প্রবেশ করলে হাতের ডানে একেবারে শুরুতেই পাওয়া যাবে এই চত্বর। বাঁ দিকে এবার কোনো স্টল থাকছে না। অন্যদিকে মন্দিরের ফটক দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করলেই পাওয়া যাবে শিশু চত্বর। বইমেলা এলাকায় নিখুঁত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বিগত বছরের মতো সব ব্যবস্থা নিয়েছে। ডিএমপির মতে মেট্রোরেলে দুর্বৃত্তরা নাশকতা চালানোর চেষ্টা করছে- এমনটি লক্ষ্য করায় মেট্রোরেল পরিষেবা একটি নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে, তবে বইমেলা মাঠের ভেতর ও বাইরে ডিএমপি ইউনিফর্ম এবং সাদা পোশাকে পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হবে এবং মেলার আশপাশের সবকিছু পর্যবেক্ষণের জন্য একটি ওয়াচ টাওয়ার এবং ফায়ার টেন্ডার স্থাপন করা হবে।
এ ছাড়া মেলার মাঠ ও এর আশপাশ সিসিটিভি ক্যামেরা ও ড্রোন দিয়ে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হবে বলে জানান ডিএমপি কমিশনার। ডিএমপির টিম পুরো ঘটনাস্থল ঝাড়ু দেবে এবং গুজব ঠেকাতে সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং করা হবে।
প্রতিবছরের মতো এবারও মেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে পাওয়া যাবে নতুন বইয়ের খবর। মেলা চলাকালে প্রতিদিন থাকবে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা সভা। 'লেখক বলছি' মঞ্চে থাকছে বই নিয়ে লেখক-পাঠকের মতবিনিময়।
১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারি ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির গেটে চট বিছিয়ে বই বিক্রি শুরু করেন মুক্তধারা প্রকাশনীর মালিক চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭৭ সালে তার সঙ্গে আরও অনেকে যোগ দেন।
১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে এই বইমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। পরের বছর মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি।
১৯৮৩ সালে মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকার সময় 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা' নামে এই মেলা আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও তা করা যায়নি। পরের বছর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সূচনা হয় 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা'র।
মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের মাস ফেব্রম্নয়ারিজুড়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের এই বইমেলা এখন বাঙালির মননের মেলায় পরিণত হয়েছে।
১৯৮৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা' নাম দিয়ে ধারাবাহিকভাবে মেলা পরিচালনা করছে।
২০২০ সালের মেলার উদ্বোধন পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে 'গ্রন্থমেলা'র পরিবর্তে 'বইমেলা' শব্দটি ব্যবহার অধিক শ্রম্নতিমধুর ও পাঠকপ্রিয় হবে বলে মত প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায়কে সাদরে গ্রহণ করে ২০২১ সালে বইমেলার প্রাতিষ্ঠানিক নামকরণ হয় 'অমর একুশে বইমেলা'।
কোভিড ভাইরাস সংক্রমণের বিধিনিষেধের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতাকে গুরুত্ব দিয়ে ২০২১ সালে শুরু হয় মার্চে; আর পরের বছর ১৫ ফেব্রম্নয়ারি পর্দা ওঠে বইমেলার। এরও আগের বছর ২০২০ সালে মেলা শুরু হয়েছিল এক দিন পিছিয়ে। প্রতিবছর ১ ফেব্রম্নয়ারি পর্দা উঠলেও সেবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ভোট থাকায় তা এক দিন পিছিয়েছিল। কয়েকবারের ওই বিভ্রাট বাদ দিলে ফেব্রম্নয়ারির প্রথম দিনই বইমেলার উদ্বোধন হয়ে আসছে।
পরিশেষে বলতে চাই, ফেব্রম্নয়ারি মাস একদিকে শোকাবহ হলেও অন্যদিকে আছে এর গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। কারণ, পৃথিবীর একমাত্র জাতি বাঙালি ভাষার জন্য এই মাসে জীবন দিয়েছিল। আর তাই দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও স্বীকৃত। একুশের মাসের সবচেয়ে বড় কর্মযজ্ঞ মাসব্যাপী বইমেলা।