একুশের পথ ধরেই অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা
ইউরোপের প্রতিটি উন্নত জাতি, এশিয়ায় চীন, জাপান, মধ্যপ্রাচ্যে আরবি ভাষাভাষী প্রতিটি জাতি যদি রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ব্যবসাবাণিজ্য এবং সামাজিক জীবনে নিজ নিজ মাতৃভাষা ব্যবহার করে উন্নতির চরম শিখর স্পর্শ করতে পারে, তা হলে বাঙালি কেন সর্বক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার করবে না? এবারের একুশের প্রতিজ্ঞা হোক, আসুন আমরা সেই আলোকোজ্জ্বল পথে মাতৃভাষা বাংলাকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত করি।
প্রকাশ | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আর কে চৌধুরী
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র। বাঙালি মুসলমানরাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু পাকিস্তান অচিরেই ভারত থেকে আসা উদ্বাস্তু উর্দুভাষী রাজনীতিক, আমলা ও সেনাপতিদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। পাকিস্তানের শতকরা ৫ ভাগ মানুষ উর্দুভাষী না হলেও তারা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে না নেওয়ার ধৃষ্টতা দেখায় পাকিস্তানের ক্ষমতাদর্পী শাসকরা। বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। '৫২-এর ২১ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায় পাকিস্তানি পুলিশ। একুশের শহীদদের রক্তদান বাঙালি জাতিকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সাহস জোগায়। এ সাহসই ছিল '৭১ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের অনুপ্রেরণা। '৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধেও তা বিবেচিত হয়েছে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে। একুশের পথ ধরেই অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে বন্দি ছিলেন। 'বঙ্গবন্ধু ১৯৫০ সালে গ্রেপ্তার হন। বন্দি থাকা অবস্থায়ও ছাত্রদের সঙ্গে সবসময় তার যোগাযোগ ছিল। জেলে থেকেই তিনি তার অনুসারী ছাত্র নেতাদের গোপনে দিক-নির্দেশনা দিতেন। তিনি 'জেল থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা দিতেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারির ঘটনা; সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হয়। তারা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্স্নোগান দিতে থাকে এবং পূর্ব বঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যদের ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতকে বিবেচনা করার আহ্বান জানাতে থাকে।
পুলিশ অস্ত্র হাতে সভাস্থলের চারদিকে প্রাচীর তৈরি করে। বিভিন্ন অনুষদের ডিন এবং উপচার্য সে সময় উপস্থিত ছিলেন। বেলা সোয়া ১১টার দিকে ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামতে চাইলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস বর্ষণ করে ছাত্রদের সতর্ক করে দেয়।
কিছু ছাত্র এই সময়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে দৌড়ে চলে গেলেও বাকিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং পুলিশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। উপাচার্য তখন পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগ করতে বলে। কিন্তু ছাত্ররা ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সময় পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করা শুরু করলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। দুপুর ২টার দিকে আইন পরিষদের সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ছাত্ররা তাদের দাবি উত্থাপনের দাবি জানায়।
কিন্তু পরিস্থিতি নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে যখন কিছু ছাত্র সিদ্ধান্ত নেয় তারা আইন সভায় গিয়ে তাদের দাবি উত্থাপন করবেন। ছাত্ররা সেই উদ্দেশ্যে রওনা করলে বেলা ৩টার দিকে পুলিশ দৌড়ে এসে ছাত্রাবাসে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশের গুলিবর্ষণের কিছু ছাত্রকে ছাত্রাবাসের বারান্দায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। আব্দুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আবুল বরকত সে সময় আহত হন এবং রাত ৮টায় প্রয়াত হন। ওই দিন বর্তমান যেখানে শহীদ মিনার সেখানের দেওয়াল টপকাতে গিয়ে আমার পরনের শার্ট ও প্যান্ট ছিঁড়ে যায়। হাত পা ছুলে আহত হই।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় আমি পুরান ঢাকার কে এল জুবলি স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। তখন আমাদের ক্লাশ শিক্ষক ছিলেন কামরুজ্জামান স্যার। তিনি পরবর্তী সময়ে যুক্তফ্রন্ট থেকে মনোনয়ন নিয়ে এমপি হয়েছিলেন। পরে কে এল জুবলি স্কুল কলেজে রূপান্তরিত হলে তিনি কলেজেরও প্রিন্সিপাল হন। তিনি সারা দেশের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন। কামরুজ্জামান স্যার ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আমি ক্লাশ ক্যাপ্টেন হওয়ায় স্যারের সঙ্গে আমার সখ্যতা ছিল ভালো। স্যারের নেতৃত্বে আমরা একাধিকবার মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলাম। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারিতেও আমরা মিছিল সহকারের ভাষা আন্দোলনের জনসভায় যোগ দিয়েছিলাম।
বাংলা ভাষা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষায় মর্যাদা পেয়েছে। আমাদের দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শহর-নগর-গ্রাম-বন্দর সর্বত্র একুশে উদযাপিত হয়। শিক্ষার মাধ্যমও এখন বাংলা (উচ্চ শিক্ষার কতিপয় ক্ষেত্র বাদে)। সরকারি কর্মকান্ডের ভাষাও বাংলা।
কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, বাংলা ভাষা এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা পায়নি। প্রকৌশল, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। উচ্চ আদালতেও পুরোপুরি বাংলার ব্যবহার হচ্ছে না। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার পর্যায় পর্যন্ত শুদ্ধরূপে বাংলা ভাষা লেখা ও বলার ক্ষেত্রে যে দুরবস্থা বিরাজ করছে, তা কেবল লজ্জাজনক নয়, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধও বটে।
ইউরোপের প্রতিটি উন্নত জাতি, এশিয়ায় চীন, জাপান, মধ্যপ্রাচ্যে আরবি ভাষাভাষী প্রতিটি জাতি যদি রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ব্যবসাবাণিজ্য এবং সামাজিক জীবনে নিজ নিজ মাতৃভাষা ব্যবহার করে উন্নতির চরম শিখর স্পর্শ করতে পারে, তা হলে বাঙালি কেন সর্বক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার করবে না? এবারের একুশের প্রতিজ্ঞা হোক, আসুন আমরা সেই আলোকোজ্জ্বল পথে মাতৃভাষা বাংলাকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত করি।
আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও ভাষা সংগ্রামী, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ