পাঠক মত
সক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজন
প্রকাশ | ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
ভূঁইয়া শফি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
পুলিশ হচ্ছে একটি দেশের দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত আইন কার্যকর, দেশের সম্পত্তি রক্ষা, সামাজিক অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা এবং জনগণের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী। আমাদের দেশের আইন প্রয়োগকারী একমাত্র সংস্থা হচ্ছে 'বাংলাদেশ পুলিশ'। সংস্থাটি বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত।
পুলিশ প্রাচীন কাল থেকেই বিদ্যমান ছিল। তবে আমাদের দেশে পুলিশ বাহিনীর গঠনের ইতিহাস বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ইস্ট বেঙ্গল পুলিশ নামে একটি আইন রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে আমাদের দেশে পুলিশ বাহিনীর যাত্রা শুরু। পরে এটি পরিবর্তিত হয়ে ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ নাম ধারণ করে। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত এই নামে পুলিশের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তা বদলে নাম হয় 'বাংলাদেশ পুলিশ'।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত এই সংস্থাটি দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে ইতোমধ্যেই। দেশের মানুষের 'জানমাল রক্ষায়, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাংলাদেশ পুলিশ প্রশংসনীয় অবদান রাখছে। অপরাধ দমন, মাদক নির্মূল, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমন ও দেশের শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে পুলিশ বাহিনী বেশ কয়েকটি ইউনিটে বিভক্ত হয়ে কাজ করছে। এগুলো হলো পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স (পুলিশ সদর দপ্তর), রেঞ্জ পুলিশ, মেট্রোপলিটন পুলিশ, বিশেষ শাখা (এসবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন),র্ যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্(যাব), এন্টি টেরোরিজম ইউনিট, রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি), শিল্প পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, পুলিশ ইন্টারনাল ওভারসাইট (পিআইও), পুলিশ বু্যরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, টু্যরিস্ট পুলিশ এবং নৌপুলিশ ইউনিটে বিভক্ত। পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটগুলো বেশ সুনাম ও গর্বের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করছে।
এদিকে অপরাধীরা অপরাধ করতে নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন করছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত করছে তারা। দেশ আধুনিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালস্না দিয়ে অপরাধ ও অপরাধ চক্রের অপরাধের কৌশলও বদলে যাচ্ছে। পুলিশকে ফাঁকি দিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্ভাবনীর মাধ্যমে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো অপরাধ সংঘটিত করছে অপরাধীরা। চোরাচালান, মাদক পাচারে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করছে অপরাধীরা। অপরাধীরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ করলেও বিপরীতে পুলিশের অপরাধীকে ধরার জন্য প্রযুক্তি অনেকাংশেই অপ্রতুল। যার ফলে তাদের সহজে ও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনতে কিছুটা হিমশিম খেতে হচ্ছে আইন রক্ষাকারী বাহিনীকে।
মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশের সুবিধা সহজে পাওয়া গেলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বা উপজেলা শহরের থানাগুলোতে পুলিশের সেবা পেতে অনেক বেগ পেতে হয় সাধারণ মানুষের। প্রয়োজনের তুলনায় পুলিশের সংখ্যা কম ও থানাগুলোতে পুলিশের গাড়ির সংখ্যাও কম থাকার কারণে ওই অঞ্চলে সেবার মানও কমে যায়। দেখা যায়, থানাগুলোতে একটি মাত্র পুলিশের গাড়ি থাকে। একটি থানার প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত থাকেন ওই থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি)। একটি থানার ওসির বিভিন্ন সময় সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও বিভিন্ন ধরনের কাজে যেতে হয়। এদিকে পুলিশের মোবাইল ডিউটি বা জরুরি সেবা দিতে প্রতিদিন একটি টিম রাখা হয় থানাগুলোতে। জরুরি সেবা দিতে বা থানা এলাকা টহল দিতে ওই টিমেরও একটি গাড়ির প্রয়োজন। আবার জেলা আদালতে মামলার ধৃত আসামিদের পাঠানোর জন্যও একটি গাড়ির প্রয়োজন। মফস্বল এলাকাগুলোর থানায় গাড়ি রয়েছে একটি। বিপরীতে প্রয়োজন তিনটি ভিন্ন কাজে তিনটি ভিন্ন গন্তব্যে। এখন থানা পুলিশের গাড়িটি যদি ওসিকে নিয়ে যায়, তাহলে পুলিশের জরুরি সেবার গাড়িটি চলে গেল। এখন থানা এলাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটলে তাহলে পুলিশের টহল টিম বা জরুরি সেবার টিম স্বল্প সময়ের মধ্যে ওই জায়গায় পৌঁছতে পারবে না। যার ফলে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে এতে বহু মানুষের জীবন সংকটে পড়বে, থানা এলাকার শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। আবার রাত্রিকালীন নৈশ ডিউটিতে একটি থানা এলাকার বিভিন্ন স্থানে ডিউটিতে কর্মরত থাকেন পুলিশ সদস্যরা। একটি বৃহৎ থানা এলাকার বিভিন্ন স্থানে পুলিশের টহল ডিউটি থাকে বিপরীতে গাড়ি ওই একটি। তাই মফস্বল থানা এলাকায় দেখা যায়, সাধারণ মানুষের যানবাহন যেমন- ইজিবাইক, অটোরিকশা, ভ্যান, সিএনজি ইত্যাদি ব্যবহার করে পুলিশ। অনেকাংশে দেখা যায়, বরাদ্দ না থাকায় থানা পুলিশ কর্তৃপক্ষ ওইসব সাধারণ যানবাহন চালকদের ভাড়া পরিশোধ করতে হিমশিম খায়। যার কারণে পুলিশের সুনাম অনেকাংশে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আবার এখানে লক্ষ্যণীয় যে, শীতের সময় প্রত্যন্ত অঞ্চলের থানা এলাকায় বিভিন্ন সময় গরু, মহিষ ইত্যাদি চুরির ঘটনা ঘটে। সাধারণত পিকআপ ভ্যান বা কাভার ভ্যানে করে চুরি মালামাল আনা-নেওয়া করে চোরচক্র। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাত্রিকালীন নৈশ টহল ডিউটিতে ইজিবাইক বা অটোরিকশাযোগে ডিউটিরত পুলিশ সদস্যরা কীভাবে পিকআপ ভ্যানে থাকা চুরি যাওয়া গরু উদ্ধার করবে এবং চোরচক্রকে গ্রেপ্তার করবে?
এ ছাড়াও আরও বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন পুলিশ বাহিনী। উপজেলা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ অথবা পৌর এলাকার পৌরসভা কর্তৃক বিভিন্ন সময় সিসিটিভি লাগানো হয়েছে। অপরাধ দমনে সিসিটিভি ক্যামেরার সফলতাও পেয়েছে পুলিশ। কিন্তু বিভিন্ন সময় দেখা যায়, অনেক পৌর এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে। বিভিন্ন অজুহাতে তা আর সংস্কারের প্রয়োজন মনে করে না কর্তৃপক্ষ। প্রত্যন্ত অঞ্চলের থানা এলাকাগুলোতে বিভিন্ন সময় মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। পর্যাপ্ত পরিমাণ স্যাটেলাইট ফোন অথবা ওয়াকিটকি না থাকার কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নভাবে অনেক ঝুঁকি নিয়ে কর্তব্য পালন করতে হয় পুলিশ সদস্যকে। কোনো কোনো থানায় ওয়াকিটকি থাকলেও দেখা যায় নেটওয়ার্ক জটিলতা অথবা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন। এগুলো সংস্কারে উদ্যোগ নেয় না কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়াও প্রত্যন্ত অঞ্চলের থানাগুলোতে যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না থাকার কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নদনদী যেমন- যমুনা, পদ্মা ইত্যাদি নদীর চর অঞ্চলের মানুষের পুলিশি সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয় পুলিশের। চর অঞ্চলে যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না, নেই রাস্তাঘাট। বেশির ভাগ সময় নদীপথেই নৌকা করে যেতে হয়। চর অঞ্চলে ডাকাত বা জলদসু্যর প্রবণতা প্রায়ই দেখা যায়। জরুরি মুহূর্তে পুলিশি সেবার জন্য ওইসব অঞ্চলের মানুষ পুলিশের দারস্ত হলে যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না থাকার কারণে স্বল্প সময়ের মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারে না। যার ফলে জলদসু্য বা ডাকাত দল অপরাধ বা ডাকাতি করে পালিয়ে যাওয়া জন্য যথেষ্ট সময় পায়।
আবার বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানের কল্যাণের ছোঁয়া পেয়েছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি ক্ষেত্রে। বিজ্ঞানের আশীর্বাদ গ্রহণ করেছে 'বাংলাদেশ পুলিশ' বাহিনীও। পুলিশের যাবতীয় কাজ এখন হয়ে থাকে অনলাইনভিত্তিক। ভিকটিমের জিডি থেকে অভিযোগ, সব কিছুই নেওয়া হয় অনলাইনে। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ কম্পিউটার ও প্রশিক্ষিত লোকবল না থাকার কারণে সেখানেও কাজের কাজ হচ্ছে না। মফস্বল এলাকার থানাগুলোতে সংস্থাটির কর্তৃপক্ষ থেকে তেমন আধুনিক কম্পিউটার সরঞ্জাম দেওয়া হয়নি। দেখা যায়, থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শকরা নিজেরাই কম্পিউটার বা ল্যাপটপ কিনে ব্যবহার করছে। প্রশিক্ষণের অভাবে সমস্যা সমাধান হচ্ছে না এতেও। পূর্বে পুলিশ বাহিনী মফস্বল পর্যায়ে কোনো উপ-পরিদর্শক পদের অফিসারদের কম্পিউটার ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা হয়নি। পুলিশের উপ-পরিদর্শকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় কম্পিউটার ব্যবহার জানেন না। এতে করে অনলাইনে তারা পুলিশি সেবা দিতে পারছে না, বরং তারা নিজেরাই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে, থানা এলাকাগুলোতে পুলিশের গাড়ির সংখ্যা বাড়াতে হবে। পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বের ন্যায় প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। স্বল্প সময় মানুষকে সেবা দিতে পুলিশ বাহিনীর আধুনিক কম্পিউটার ও আধুনিক সরঞ্জাম সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। পুলিশের শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। পুলিশের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। পুলিশি সেবা মানুষের দরজায় পৌঁছাতে পুলিশ বাহিনীর সংখ্যা বুদ্ধি ও লোকবল বাড়াতে হবে। মানুষের আস্থা অর্জন করতে পুলিশের মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। অপরাধ দমনে পুলিশকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দিতে হবে। আবার পুলিশকে সরকারের জবাবদিহিতায় আনতে হবে।