দু'দেশের পারস্পরিক স্বার্থকে এগিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্র আগামীতে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করার প্রতীক্ষায় আছে, সাংবাদিকদের এমনটিই জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং কমনওয়েলথ মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড। এছাড়া নতুন সরকার গঠনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের অভিনন্দন পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। অর্থাৎ যারা বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে নিয়ে প্রশ্ন তুলে পশ্চিমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন ইতোমধ্যে তারা পশ্চিমাদের বিবৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে অবগত হয়েছে এবং এর ফলে, বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়।
কূটনৈতিক সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদি ভিত্তিতে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। বিশেষ করে দু'টি দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের দৃঢ়তাকে মজবুত করার ক্ষেত্রে কূটনীতিকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কূটনীতিকরা সাধারণত দু'টি দেশের মধ্যকার শিক্ষা, সংস্কৃতি, বাণিজ্য, অর্থনীতি, শিল্প ও অন্যান্য সমসাময়িক ইসু্য নিয়ে দু'টি দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কাজ করে থাকে- যেখানে মূলত সহযোগিতার ভিত্তিতে দু'দেশের জনগণই উপকৃত হয়ে থাকে। প্রকৃত অর্থে বিশ্বায়নের যুগে পুরো পৃথিবীকে একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার লক্ষ্যে সাধারণত কূটনীতিকরা কাজ করে থাকে। এ কথা স্বীকার করতেই হবে পৃথিবী এমন একটি পর্যায়ে এসেছে যেখানে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রগুলো পরিচালিত হয়ে থাকে। সে কারণেই কূটনীতিকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা বিশেষ করে দায়িত্বশীল ভূমিকা পৃথিবীর শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে কাজ করে থাকে।
আমরা সবাই ইত্যবসরে জেনে গেছি, পৃথিবীর এক অংশে আগুনের লেলিহান শিখায় প্রজ্বালিত হলে অন্য অংশে আগুনের প্রভাব দেখা যায়। কারণ পৃথিবী ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। সেই অর্থে ইউক্রেন-রাশিয়ার চলমান যুদ্ধে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই ভুক্তভোগী এবং এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মানুষের জীবনযাত্রায়। তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ যুদ্ধের দামামার কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ততার মুখোমুখি হয়েছে এবং ক্ষতির রেশ কাটিয়ে ওঠা অনেকাংশে কঠিনই বলা চলে। কেননা, যুদ্ধ এখনো চলমান এবং যুদ্ধের শেষ অবধি ক্ষতিগ্রস্ততার ভয়াবহতা কতটুকু হতে পারে সেটা কোনোভাবেই বলা যাচ্ছে না। তার জন্যই বলা হয়, কূটনীতিকদের সঠিক দায়িত্ব পালন দু'দেশের সম্পর্ককে যেমন মজবুত করতে পারে ঠিক তেমনিভাবে দায়িত্বহীন ভূমিকা বিশ্বাসের জায়গায় প্রশ্নের দেয়াল তুলে দিতে পারে। বাংলাদেশের নির্বাচনপরবর্তী সময় থেকে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা যেভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে, কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে- আমার মনে হয় চতুর্থ শিল্পবিপস্নবের চ্যালেঞ্জকে বাস্তবায়নে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কগুলোকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগাতে পারবে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক পরিসরে গবেষণা কার্যক্রমকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া, একাডেমিক কার্যক্রমকে বেগবান করা, বিভিন্ন ইসু্যতে ওয়েবিনারের উদ্যোগ, অনলাইন সেমিনার, অনলাইন প্রজেক্ট ও কোর্স সম্পাদন, অনলাইন ডিগ্রি প্রদান ইত্যাদি সংক্রান্তে ব্যাপকভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি সুযোগ সৃষ্টি করার অবকাশ রয়েছে কূটনৈতিক সম্পর্কের বরাতে।
কূটনীতিকদের শুভেচ্ছা জানানোর মধ্য দিয়ে একটি বিষয় হচ্ছে তারা তাদের নিয়মিত কার্যক্রমগুলো অব্যাহত রাখবেন এবং অন্যটি হচ্ছে নতুন সম্পর্ক সৃষ্টির ক্ষেত্রে আরও কীভাবে ভূমিকা রাখা যায়, সে সংক্রান্ত উদ্যোগ গ্রহণ করবে মর্মে আশ্বস্ত থাকা যায়। আমরা প্রত্যেকেই জানি এবং বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে একদিকে যেমন অর্থনীতির চাকা সচল থাকে, অন্যদিকে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। সঙ্গতকারণেই সামাজিকভাবে উন্নয়নের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পায় এবং রাষ্ট্রীয় সহনশীলতা তৈরি হয়। আমরা দেখেছি, কোনো ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতামূলক কর্মকান্ড ছাড়াই বাংলাদেশে যেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগের উত্তম পস্নট হিসেবে বাংলাদেশকে গণ্য করবে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে যেভাবে দ্রম্নত রিটার্ন পাওয়া যায়, পৃথিবীর অন্য দেশে তেমন নজির একদম নেই বললেই চলে। কাজেই বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীরা পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করবে এবং নতুনরাও বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবে।
তাছাড়া চলমান যে কাজগুলো রয়েছে সেগুলোর নিষ্পত্তি হলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আরও সমৃদ্ধ হবে এবং পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যাপক কর্মযজ্ঞ প্রতিষ্ঠিত হবে। নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ইত্যবসরে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং বিনিয়োগের উত্তম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নেওয়ার কারণগুলো কূটনীতিকদের অবগত করেছে। আমরা মনে করি এবং বিশ্বাস রাখি, বিশ্ব মন্দার সময়েও বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে সচল ছিল সেটি একটি দৃষ্টান্ত হয়ে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করেছে। কেননা এখানে বিনিয়োগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই কিংবা বিনিয়োগকারী রাষ্ট্রসমূহ পূর্বে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন ঘটনা ঘটেনি। বিগত ১৫ বছর ধরে কূটনৈতিক দক্ষতায় বাংলাদেশ সরকার বিদেশিদের আকৃষ্ট করে বিনিয়োগবান্ধব একটি পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ইকোনমিক জোন স্থাপিত হয়েছে এবং আরও কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে। সব প্রোগ্রাম এবং প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে গেলে বিদেশিদের বিনিয়োগের রাস্তা আরও প্রশস্ত হবে। নির্বাচনের পূর্ববর্তী সময়ে মিডিয়ার কল্যাণে জানা গেছে, পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত কোম্পানি অন্য দেশে ব্যবসা গুটিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মাঝখানে নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি চক্রান্তের হেতু বিনিয়োগকারীরা একটি দ্বিধার মধ্যে ছিল এটা স্বীকার করতেই হবে। এখন অন্ধকারের ঘোর কেটেছে, শঙ্কা ছাড়াই নির্বাচনের পরিসমাপ্তি হয়েছে। এ ব্যাপারগুলো বিনিয়োগকারীদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করবে এবং সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের ক্ষেত্র তৈরি করবে।
তাছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়ায় উপযুক্ত জনশক্তি তৈরি হওয়ায় বিদেশিরাও তাদের ব্যবসাকে বাংলাদেশে সহজেই সম্প্রসারণ করতে পারে। বিগত ১৫ বছরে দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার যে সম্প্রসারণ ও উন্নতি হয়েছে তাতে করে ব্যবসাবান্ধব একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগটিকে বিদেশিরা কাজে লাগিয়ে অন্য দেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে তারা বাংলাদেশে তাদের ব্যবসার বসতি স্থাপন করতে চাচ্ছে। তাছাড়া মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর বাংলাদেশে পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা এবং এর জন্য বিদেশি বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি। সরকার বিদেশিদের আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে ইতিপূর্বে গৃহীত পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে নতুনভাবেও উদ্যোগ গ্রহণ করে পুরো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতকে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে কাজ করে যাবে-এমনটি মনে করে এ দেশের জনগণ।
আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস রাখি, আমাদের যে কূটনৈতিক সুদৃঢ় অবস্থান এটিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশে ব্যাপক বিনিয়োগ হবে। দেশের কয়েক জায়গায় গ্যাস ক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়ার তথ্য জানা গেছে, সব ধরনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে, প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনে স্থায়ী ভিত্তিতে একটি ব্যবস্থা চালু করতে পারলে বিনিয়োগকারীরা প্রবলভাবে আকৃষ্ট হবে।
খেয়াল রাখতে হবে, প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে অর্থনীতির অগ্রসরতামানকে ধরে রাখতে গ্যাস ও বিদু্যতের অপচয় রোধে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। পত্রিকার পাতায় দেখা যায়, গ্যাস-বিদু্যতের সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হয়। হলফ করে বলতে পারি, গ্যাস-বিদু্যতের অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে এর ঘাটতি অনেকটাই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মজবুত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে সুশাসনের অনুশীলন সম্ভব হলে কূটনৈতিক পারঙ্গম ও বিনিয়োগে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে বাংলাদেশে।
মো. সাখাওয়াত হোসেন : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়