পারিবারিক ও সামাজিক গন্ডি থেকে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে মানুষ। একঘেয়েমি জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে এক একটি জীবন। আর এ ধারাকে গতিশীল করে তুলেছে স্মার্টফোন এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। পালস্না দিয়ে স্মার্ট ফোন কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ছেন শিশু-কিশোরসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। তবে এসব মাধ্যম থেকে প্রজন্ম কতটা সুফল অর্জন করতে পারছে, তা নিয়ে বির্তক রয়েছে। আর এ বির্তকের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়েছে শর্ট ভিডিও শেয়ারিংয়ের চীনা অ্যাপ টিকটক।
এই অ্যাপের মাধ্যমে ব্যক্তি থেকে শুরু করে সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে মাদক, নগ্নতা ও অশ্লীলতার মতো ভয়াবহ দিকগুলো। আর এ কারণে বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ হচ্ছে টিকটক। শুধু নিষিদ্ধ নয়, এই সস্তা বিনোদনের পস্ন্যাটফর্মটির বিরুদ্ধে অনেক দেশ মামলাও করেছে। তারপরও কর্র্তৃপক্ষ এসব বিষয় তোয়াক্কা না করে আপন মনে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কার্যক্রম।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া অঙ্গরাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল ব্রেনা বার্ড মামলা করেছেন টিকটকের বিরুদ্ধে। টিকটকে মাদক, নগ্নতা ও অশ্লীল কনটেন্টের ছড়াছড়ি নিয়ে মিথ্যা বলার জন্য টিকটক এবং এর মূল চীনা কোম্পানি বাইটড্যান্সকে অভিযুক্ত করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। মামলাটি করা হয়েছে অঙ্গরাজ্যের পোল্ক কাউন্টির একটি আদালতে। 'টিকটক বাবা-মা'দের অন্ধকারে রেখেছে' এ বিষয়ে নজর দেওয়ার সময় এসেছে উলেস্নখ করে মামলায় বলা হয়, টিকটক শিশুদের সামনে বিভিন্ন গ্রাফিক কনটেন্ট যেমন যৌনতা, আত্মঘাতমূলক, মাদকের অবৈধ ব্যবহারসহ আরও খারাপ বিষয়বস্তু তুলে আনছে। গ্রাহকের সঙ্গে এমন প্রতারণার অভিযোগে আর্থিক জরিমানার দাবিও করা হয়।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া অঙ্গরাজ্যই নয়; এর আগেও টিকটকের বিরুদ্ধে অঙ্গরাজ্য উতাহে গত অক্টোবরে মামলা হয়েছে। আসক্তি এবং অস্বাস্থ্যকর সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্টে শিশুদের অভ্যাস করানোর জন্য টিকটকের বিরুদ্ধে এ মামলা করা হয়। গত বছরের শুরুতেই টিকটক নিষিদ্ধ করে মন্টানা। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নেও নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে চীনা অ্যাপটি। টিকটকের কনটেন্টগুলো 'সামাজিক সম্প্রীতির জন্য ক্ষতিকর' উলেস্নখ করে গত নভেম্বরে নেপালেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় টিকটিক। এছাড়া ভারতসহ আরও অনেকে দেশেই নিষিদ্ধ হয়েছিল ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপটি। চলতি মাসের ৩১ জানুয়ারি টিকটক সিইও শউ জি চিউয়ের মার্কিন সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটির সামনে অনলাইনে শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়ন বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়ার কথা রয়েছে।
এ তো গেল ভিনদেশের কথা। বাংলাদেশের অবস্থা তুলে ধরছি নিজ জেলা কুমিলস্নার একটি ঘটনা দিয়ে। কয়েক মাস আগে 'বুঝো নাই ব্যাপারটা' নামের টিকটক আইডির মালিক আতিক একটা স্কুলের মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার ভিডিও নিজ আইডিতে শেয়ার করে। ভিডিওতে দেখা যায়, আতিক অকথ্য ভাষায় ওই মেয়েকে গালাগাল দিতে থাকে। অবশেষে মেয়েটি পুলিশের শরণাপন্ন হলে আতিক বলে, আমি শুধু জাস্ট মজা করার জন্য ভিডিও করেছি। আবার 'অপু ভাই' নামে এক ছেলেকে রাস্তায় মারধর করা অবস্থায় পুলিশ ধরেছে। কারণ সে টিকটক করার সময় পথচারীদের গায়ে হাত তোলে। অতি কাছের প্রিন্স মামুন ও লায়লার ঘটনা। দুইজনে যা ঘটিয়েছে সেখান থেকে হাস্যরস ছাড়া আর কিছুই প্রাপ্তি নেই আমাদের।
বাংলাদেশে টিকটকের নেতিবাচক প্রভাব লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়েছে। টিকটকের প্রভাবে নানা গান ও সংলাপের সঙ্গে তরুণ-তরুণীরা ঠোঁট মেলাচ্ছেন, অদ্ভুত সব নাচের মুদ্রা রপ্ত করছেন। স্বল্প সময়ে তারকাখ্যাতি অথবা দ্রম্নত নিজেকে ভাইরাল করতে উচ্ছৃঙ্খলতাই বেছে নিচ্ছেন বাংলাদেশের টিকটকরা। গেল বছরের ভারতের বেঙ্গালুরুতে ২২ বছরের এক বাংলাদেশি তরুণীকে বিবস্ত্র করে শারীরিক নির্যাতনের পর দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল। ওই ঘটনায় টিকিটকার হৃদয়সহ ১১ বাংলাদেশিকে সাজা দেন আদালত। পরে জানা যায়, টিকটক পস্নাটফর্ম ব্যবহার করে তারা বাংলাদেশ থেকে ভারতে নারী পাচার করত, যাদের বিভিন্ন পতিতালয়ে বিক্রি করে যৌন কর্মে সম্পৃক্ত হতে বাধ্য করত।
এসব ভিডিওতে শুধু সস্তা জনপ্রিয়তার জন্যই নীতিনৈতিকতার খোলস ছেড়ে বেপরোয়া নাচ-গান তৈরি করা হয়। সমাজের প্রতিটি গোড়ায় জেঁকে বসে আছে এ বিষাক্ত জাল। ব্যক্তি থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ মিডিয়ার ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ছে। এণ সব ভয়াবহ দিক নিয়ে এখনই চিন্তা করতে হবে; বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বেড়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কেননা, আজকের প্রজন্ম; দেশের জন্য আগামীর মানব সম্পদ।