দেশের প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। দীর্ঘদিনের জ্বালানি সমস্যাসমূহের মধ্যে অন্যতম সমস্যা গ্যাস সংকট। পর্যাপ্ত পরিমাণে জোগান না থাকায় মানুষ কম-বেশি ভোগান্তির মুখোমুখি হয়ে আসছে বরাবরই। কিন্তু সম্প্রতি এনএলজির দুটি টার্মিনাল অচল হয়ে যাওয়ার কারণে গ্যাসের সংকট যেন মহামারির রূপ ধারণ করেছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দিনের বেলায় গ্যাস থাকছেই না। গভীর রাত ও ভোরে কিছুটা পাওয়া গেলেও এর পরিমাণ এত কম যে, সময় মতো রান্না করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। এমনও আছে যে, গ্যাসের সংযোগ থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন বাসাবাড়িতে মাসের পর মাস চুলা জ্বলে না। এ ছাড়া আরও উদ্বেগের বিষয় হলো- শিল্প কারখানাতেও গ্যাস সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। কোনো কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনের অর্ধেকও গ্যাস পাচ্ছে না। মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। ইতোমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে বলেও জানা গেছে। ফলশ্রম্নতিতে প্রতিষ্ঠানগুলো শর্তাধীন সময় পণ্যও জোগান দিতে পারছে না। এসবের সর্বোপরি ক্ষতিটা দেশে অর্থনীতিতে গিয়ে পতিত হচ্ছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য পাঁচটি ঝুঁকির মধ্যে জ্বালানি স্বল্পতাকে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে উলেস্নখ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্লেষকদের মতে, গ্যাস সংকটের কারণে নিজস্ব জ্বালানির উৎপাদন কমেছে, আমদানি নির্ভরতা বেড়েছে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। পেট্রোবাংলার পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদু্যৎ, শিল্প, সার-গৃহস্থালি, সিএনজিসহ সাতটি সেক্টরে মোট জ্বালানি চাহিদা পড়বে ৩,৭১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বর্তমানে গ্যাসের ঘাটতি দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। স্থবির হতে থাকে এমন অর্থনীতিতে যেখানে গ্যাসের সংকট উদ্বেগজনক এরপরও এখনো এমন কিছু এলাকা বা আবাসিক স্থান আছে, যেখানে সংকটের তুলনায় ভালোই গ্যাস সরবরাহ থাকে। এসব বাসাবাড়িতে গ্যাসের অপচয় হয়- এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। পানি ফুটাতে দীর্ঘ সময় জ্বালিয়ে রাখাসহ কাপড় শুকানো এমনকি একটি দিয়াশলাই এর কাঠি বাঁচাতে চুলা জ্বালিয়ে রাখে অনেকে। শীতের সময় গৃহ তপ্ত রাখার জন্য অনেকে চুলা চালিয়ে রাখে। এসব বেখেয়াল মানুষের অপব্যবহার সে সংকটকে আরও হুমকির মুখে ফেলেছে।
গবেষণা অনুসারে বাংলাদেশের অপচয় হওয়া গ্যাসের ৮৭ শতাংশ আসে বাসাবাড়িতে সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে। আমাদের বর্তমান সংকট উত্তরণে গ্যাসের অপচয় বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। আমরা অনেকে চুলায় উচ্চ তাপমাত্রা দিয়ে রান্না করি। চুলার বাইরে যে আগুনটা যায়, তা কিন্তু অপচয় ছাড়া কিছুই হয় না। সে ক্ষেত্রে চুলার আঁচ মধ্যমমানে রেখে রান্না করলে পুরো আগুনটা পাতিলের নিচে থাকবে এবং অপচয়ও হবে না। এ ছাড়া পানি দীর্ঘক্ষণ না ফুটিয়ে ফিল্টার ব্যবহার করে শোধন করে পান করতে পারি। ঘন ঘন যাদের চা খাওয়ার অভ্যাস আছে, তাদের দেখা যায় বারবার চুলা অন করতে হয় এবং বারবার পানি গরম করতে হয়। এটা না করে চায়ের পানি বেশি করে গরম করে ফ্লাক্সে সংরক্ষণ করে রাখা যায় এবং প্রয়োজনমতো ব্যবহার করলে অপচয় হ্রাস পাবে। এ ছাড়া অনেক সময় দেখা যায়, পাতিল ধোয়ার পর কিছুটা পানি থেকে যায়। সে ক্ষেত্রে পাতিল কিছুক্ষণ আগে ধুয়ে ভালোভাবে শুকিয়ে এরপর চুলায় বসান, তাহলে পানিটা শুকাতে চুলা জ্বালিয়ে যে গ্যাসের অপচয়টা হতো সেটা আর হবে না। বিজ্ঞানের কল্যাণে রান্নাতেও আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহার সম্ভব হয়েছে। গ্যাস বাঁচানোর জন্য প্রেসার কুকার ব্যবহার করা একটি উত্তম পদ্ধতি। তেমনি রাইস কুকারও রয়েছে। প্রেসার কুকার ও রাইস কুকার ব্যবহার করে সহজেই রান্না করা সম্ভব। এর ফলে অনেকটা গ্যাসে বেঁচে যাবে। রান্না শেষে অবশ্যই চুলা জ্বালিয়ে রাখা যাবে না। অবচেতন হয়ে যে গ্যাসের অপচয় হচ্ছে, এতে ভোগান্তিতে পড়ছে গোটা দেশের মানুষ। একটু একটু করে অপচয় করার দরুন সর্বোপরি সবাই সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। প্রত্যেকে সচেতনতার সঙ্গে সতর্ক হয়ে ব্যবহার করলে সংকটের এই সময় অন্তত দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হলেও সংকট বাড়বে না। সংকট যাতে আর না বাড়ে, সেই লক্ষ্যে আমাদের সচেতন হতে হবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে। সবার কথা ভেবে, অর্থনীতির সচলাবস্থার কথা ভেবে আমাদের গ্যাস ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে হবে এবং অপচয় বন্ধ করতে হবে। তবেই আমরা গ্যাসের এই তীব্র সংকট থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাব। কেননা, অপচয় বন্ধ না হলে যতই উৎপাদন হোক সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না এবং ভোগান্তির তীব্রতাও দূর হবে না।