আব্দুর রশিদ অর্ণব ও নাজমুল হোসাইন

কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে যবিপ্রবি আস্থার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে

বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. এম আর খান মেডিকেল সেন্টারে বিশ্বমানের প্যাথলজি সেন্টার খোলা হয়েছে, যেখানে সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রতিপালনের অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষকে স্বল্পমূল্যে প্যাথলজিক্যাল সেবা দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয় এ মেডিকেল সেন্টারের তত্ত্বাবধানে প্রতি বছর আগস্ট মাসে নিয়মিতভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে এ অঞ্চলের অনগ্রসর ও পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প করা হয়। এছাড়া করোনার অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে খাদ্যসামগ্রী উপহার দেওয়া হয়েছে।

প্রকাশ | ২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
করোনা মহামারির সময় যখন মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছিল না, সন্তান তার পিতা ও মাতা ফেলে পালিয়ে যাচ্ছিল, মানুষ এখানে-সেখানে মৃত শয্যায় কাঁতরাচ্ছিল, তখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। মেডিকেল সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় না হয়েও করোনা ভাইরাস পরীক্ষা, করোনার গতি-প্রকৃতি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তসহ এর জীবন রহস্য উন্মোচন করে প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম গবেষণা ল্যাব জিনোম সেন্টার। পরবর্তীতে বিদেশগামীদেরও করোনা ভাইরাস পরীক্ষা ও সনদ দেয় জিনোম সেন্টার, যা এখনো চলমান রয়েছে। ফলে অত্যন্ত স্বল্প খরচে মানুষ হাতের কাছে সেবা পেয়ে আসছে। বাংলাদেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল আন্তর্জাতিক স্থলবন্দর দিয়ে আমদানিকৃত পণ্যের মান নির্ণয় করতে আস্থার প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে যবিপ্রবির সেন্টার ফর সফিস্টিকেটেড ইনস্ট্রুমেন্টেশন রিসার্চ ল্যাবরেটরি (সিএসআরআইএল)। প্রতিদিনই বিভিন্ন ধরনের পণ্যের মান পরীক্ষায় আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা দখল করে নিয়েছে ল্যাবটি। যশোর অঞ্চলের ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের ডাই বা ছাঁচও তৈরি হচ্ছে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ল্যাবে। যশোর অঞ্চল মাছ চাষ ও পোনা উৎপাদনে অনেক আগে থেকেই পরিচিত। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করা হয়েছে আধুনিক হ্যাচারি ও ওয়েট ল্যাব। সেখানে মাছের পোনা উৎপাদন, কাঁকড়া চাষের মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। পোনা উৎপাদনের পর তা ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রয়ও করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. এম আর খান মেডিকেল সেন্টারে বিশ্বমানের প্যাথলজি সেন্টার খোলা হয়েছে, যেখানে সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রতিপালনের অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষকে স্বল্পমূল্যে প্যাথলজিক্যাল সেবা দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয় এ মেডিকেল সেন্টারের তত্ত্বাবধানে প্রতি বছর আগস্ট মাসে নিয়মিতভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে এ অঞ্চলের অনগ্রসর ও পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প করা হয়। এছাড়া করোনার অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে খাদ্য সামগ্রী উপহার দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা ও গবেষণা খাতেও সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে যবিপ্রবি। মাত্র একযুগে উচ্চশিক্ষায় অনন্য সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। সব ক্লাস, পরীক্ষা ও ফলাফল প্রকাশে একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুসরণ করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট এখন শূন্যের কোঠায়। ফলে একাডেমিক কার্যক্রমে এখন পরিপূর্ণ শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে নেওয়া মেগা প্রকল্পের সব কাজ শেষ। সাম্প্রতিক সময়ে ক্রীড়াঙ্গনে যবিপ্রবি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। বঙ্গবন্ধু আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপ-২০২২ এ যবিপ্রবির নারী ক্রিকেট দল চ্যাম্পিয়ন হয় এবং এই চ্যাম্পে পুরুষ ক্রিকেট দল ১ম রানার্সআপ অর্জন করে। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতা ২০২২-এ নারী দল চ্যাম্পিয়ন হয়, টোকিও অলিম্পিক-২০২১ (অ্যাথলেটিকস) এ খেলেছেন যবিপ্রবি শিক্ষার্থী জহির রায়হান। জাতীয় পর্যায়ে নতুন রেকর্ড গড়েছেন যবিপ্রবির শিক্ষার্থী ১৪তম বারের মতো দেশের দ্রম্নততম মানবী শিরিন আক্তার, জাতীয় অ্যাথলেট জহির রায়হান, সোনিয়া আক্তার এবং আশরাফুজ্জামান রচির রয়েছে স্বর্ণপদক অর্জনসহ বিভিন্ন রেকর্ডের কারিগর যবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের অনুশীলন নিরবচ্ছিন্ন রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপন করা হয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শেখ রাসেল জিমনেশিয়াম। সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে মিরপুরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামের পরেই এর অবস্থান। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে স্বচ্ছতা, মেধা ও যোগ্যতার পরিপূর্ণ অনুসরণ করা হয়। এ জন্য লিখিত, ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। ফলে চাকরির প্রার্থীদের কাছেও এ প্রতিষ্ঠান এখন আস্থার প্রতীক। যার দক্ষ নেতৃত্বে এ সব বিষয় সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হচ্ছে তিনি হলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যলয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন। যবিপ্রবির নিজস্ব অর্থায়নে ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন বায়োসায়েন্স (এফএমবি) বিভাগে ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ মৎস্য সংরক্ষণশালা 'অ্যাকুয়াটিক বায়োডায়ভার্সিটি মিউজিয়াম'। সহজেই মাছের সঙ্গে পরিচিতি, বিলুপ্ত ও বিলুপ্তপ্রায় সব স্বাদু পানির মাছ ও সামুদ্রিক মাছ এবং অন্যান্য জলজপ্রাণি সংরক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণা উন্নয়নে এ মিউজিয়াম তৈরি হয়েছে। এতে সংরক্ষিত আছে প্রায় ৪৭৫ প্রজাতির স্বাদু ও সামুদ্রিকপ্রাণি। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) বাংলাদেশের যশোর শহরের পাশে অবস্থিত প্রথম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বৃহত্তম যশোর জেলার প্রথম ও একমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৭ সালের ২৫ জানুয়ারি এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৮-২০০৯ শিক্ষাবর্ষে এর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। এটি খুলনা বিভাগের চতুর্থ বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০১ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত যবিপ্রবি আইন ২০০১ নামের ওই সালের ৪৪ নম্বর আইনে রাষ্ট্রপতি ১৫ জুলাই তারিখে তার সম্মতি জ্ঞাপন করেন। এরপরে নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে ২০০৪ সালের আগস্টে প্রাক-একনেক সভায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) এবং শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর যৌথভাবে সরেজমিনে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্থান নির্ধারণ করবে, এই মর্মে পুনঃসিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যশোরের জেলা প্রশাসককে আহ্বায়ক করে এবং ইউজিসির একজন প্রতিনিধিকে সদস্য-সচিব করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্বাচনের জন্য ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। ২০০৭ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোর উপজেলার চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের সাজিয়ালী মৌজায় ৩৫ একর জায়গা জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যবিপ্রবির বর্তমান ক্যাম্পাস শুভ উদ্বোধন করেন। এরপরেই গুটি গুটি পায়ে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিয়ে প্রতিষ্ঠার ১৭ বছর উদ্‌যাপন করতে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বর্তমানে ৮টি অনুষদে আছে দেশের দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য সময়োপযোগী ২৬টি বিভাগে পিএইচডি, এমফিল, স্নাতকোত্তর ও স্নাতক পর্যায়ে বর্তমানে ৬ হাজার ২১৩ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছেন। এছাড়াও কয়েক দিন আগেই বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃক এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান (বিএমবি) বিভাগ, ফলিত পরিসংখ্যান ও হিউম্যানিটিস (নন-ডিগ্রি) বিভাগ খোলার অনুমোদন পেয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ে দু'টি ছাত্র ও দু'টি ছাত্রী হল রয়েছে। দু'টির কার্যক্রম পরিপূর্ণ চলমান। অন্য দু'টি উদ্বোধনের অপেক্ষায়। হল দু'টি উদ্বোধন হলে শিক্ষার্থীদের প্রায় কোনো আবাসন সংকটই থাকবে না। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকসহ মোট ৩৪৮ জন শিক্ষক, বিভিন্ন গ্রেডের ১৬৪ জন কর্মকর্তা এবং ৩৩৮ জন কর্মচারী কর্মরত আছেন। যারা নিজেদের মেধা ও শ্রমের মাধ্যমে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি গবেষণা নির্ভর ও আস্থার প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আব্দুর রশিদ অর্ণব ও নাজমুল হোসাইন :দুজনই যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত