রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

রাষ্ট্রের সর্বত্র শৃঙ্খলা থাকা জরুরি

রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টর চলবে স্বাভাবিক নিয়মে, যাতে জনগণ কোনোরকম হয়রানি দুর্ভোগের শিকার না হন এবং তারা স্বাচ্ছন্দ্যে নাগরিক সুবিধা ভোগ করতে পারেন। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে কেন আমরা ওই স্বাভাবিক নিয়মটা দাঁড় করাতে পারলাম না, সে এক বিস্ময়।
সালাম সালেহ উদদীন
  ২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
রাষ্ট্রের সর্বত্র শৃঙ্খলা থাকা জরুরি

স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা গর্বিত ও আশাবাদী। এই দেশ একদিন উন্নত দেশের কাতারে যাবে। এমন স্বপ্ন দেশদরদি জনগণ দেখে, দেখে সরকারও। প্রত্যাশা করা, স্বপ্ন দেখা আর তা বাস্তবে রূপ দেয়া এক কথা নয়। কঠিন সাধনার মাধ্যমে সত্যের মুখোমুখি হওয়া এবং তাকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। পরিকল্পনা, পরিশ্রম ও গঠনমূলক চিন্তা ছাড়া যেমন ব্যক্তি, পরিবার, সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়, একইভাবে সম্ভব নয়, রাষ্ট্রের উন্নয়নও। রাষ্ট্র তা যত ক্ষুদ্রই হোক তার চরিত্র হতে হবে গণমুখী তথা জনকল্যাণমূলক। রাষ্ট্রের সর্বত্র শৃঙ্খলা না থাকলে এটা সম্ভব নয়।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বাংলাদেশকে নিয়ে বিগত পাঁচ দশকে অনেক স্বপ্ন দেখলেও রাষ্ট্রের কাঠামোগত চরিত্র দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি। এজন্য কোনো সরকার সার্বজনীন উদ্যোগ ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বলেও ৫৩ বছর চোখে পড়ছে না। এটা সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের একটি দুর্বল ও দুঃখজনক দিক; হতাশাজনক চিত্র। রাষ্ট্রকাঠামো যদি দুর্বল থাকে, পদ্ধতিগত (সিস্টেম) দুর্বলতা যদি থেকে যায় সে রাষ্ট্র কীভাবে উন্নত দেশে পরিণত হবে- তা কোনোভাবেই যুক্তির মধ্যে পড়ে না। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, উন্নত যোগাযোগ ও ট্রাফিক ব্যবস্থা, নাগরিক সেবা, জননিরাপত্তা, চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা পরিস্থিতি, ভোটাধিকার বা নির্বাচনী ব্যবস্থা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নগরায়ণ, ব্যাংক ব্যবস্থাপনাসহ আর্থিক খাত, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও বাণিজ্য ঘাটতি, নিত্যপণ্যের বাজার, শেয়ারবাজার এমনিভাবে রাষ্ট্রের যে সেক্টরেই দৃষ্টি দেওয়া যাক না কেন, পদ্ধতিগত দুর্বলতা এবং অব্যবস্থাপনার চিত্রই প্রকট।

এর ফলে, জনগণের অর্থ, শ্রম, সময় যেমন নষ্ট হয়- একইভাবে তারা হয়রানি ও দুর্ভোগের শিকার হয়। এটা আর যাই হোক, গণতান্ত্রিক বা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের চিত্র হতে পারে না। রাষ্ট্র হবে গণতান্ত্রিক অথচ তার মধ্যে শৃঙ্খলা থাকবে না, কোনো সুষ্ঠু স্বচ্ছ পদ্ধতি থাকবে না- এ কেমন কথা।

এক শিল্পপতি দেশের ১০০ জন দরিদ্র ব্যক্তিকে নিয়মিত মাসিক সাহায্য দেবেন। নামের তালিকা ও টাকার অঙ্ক নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বললেন, প্রতি মাসের ৫ তারিখে প্রত্যেকের কাছে সাহায্য পৌঁছাবে এর অন্যথা হলে কর্তব্যে অবহেলার দায়ে সবাইকে বরখাস্ত করা হবে। যেহেতু বিষয়টি মানবিক এবং জীবন পরিচালনার জন্য একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর বিষয়। সুতরাং, এ নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটতে পারবে না। ঘটনাটি ৩৫ বছর আগের; কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো অনিয়মের অভিযোগ ওঠেনি। এটা শৃঙ্খলা বা পদ্ধতিগত সফল প্রক্রিয়ার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। একজনের উদ্যোগে যদি এমন কাজ সফলভাবে সুনামের সঙ্গে চলতে পারে, তবে রাষ্ট্র বিশৃঙ্খলভাবে চলবে কেন? আর এর দায়ই বা কে নেবে।

মূল্যস্ফীতি, শেয়ারবাজারে ধস, চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনিয়ম, গ্যাস সংকট, বেকারত্ব, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্য, নারীর প্রতি অবমাননা, খুন-ধর্ষণ, রাজনৈতিক সহিংসতা. দেশের সর্বত্র মাদক ও দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্তার- এসব চিত্র সুখকর নয়। এই চিত্র বদলাতে হবে। রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হলে তার ব্যবস্থাপনাগত স্বচ্ছতা থাকতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সঠিক স্বচ্ছ কাঠামো।

অনেকেই বলেন, বাংলাদেশের বয়স আর কত, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট অতি অল্প বয়সে বিশ্ব জয় করে ফেলেছিলেন, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য মারা গেছেন মাত্র ২১ বছর বয়সে। ৪০ বছরের মধ্যে ব্যক্তি ও রাষ্ট্র নজির স্থাপন করেছে পৃথিবীর বহু অঞ্চলে। আর আমাদের রাষ্ট্রের বয়স ৫২ বছর। আমরা কবে পারব। মৌখিক সাফল্য আর কাজের সাফল্য এক নয়। আমরা চারদিকে যে সাফল্যের কথা শুনি, শুনি উন্নয়নের কথা তা মৌখিক। বাস্তব চিত্র অন্যরকম। মনে রাখতে হবে, কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়নই দেশের প্রকৃত উন্নয়ন নয়। মানুষের মৌলিক অধিকারের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে আমরা দু একটি ক্ষেত্রে সাফল্যের পরিচয় দিয়ে হইচই শুরু করে দিই। অন্যান্য ক্ষেত্রের পাহাড় সমতুল্য ব্যর্থতাকে ঢাকার জন্য। এটা বড় ধরনের রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা।

রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টর চলবে স্বাভাবিক নিয়মে, যাতে জনগণ কোনোরকম হয়রানি দুর্ভোগের শিকার না হন এবং তারা স্বাচ্ছন্দ্যে নাগরিক সুবিধা ভোগ করতে পারেন। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে কেন আমরা ওই স্বাভাবিক নিয়মটা দাঁড় করাতে পারলাম না, সে এক বিস্ময়।

\হএর সঙ্গে চুরি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, কর্তব্যে অবহেলা, ব্যক্তির অযোগ্যতা, ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ এসব বিষয় কম দায়ী নয়। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক হানাহানি অস্থিরতা সহিংসতা তো আছেই। অবাক ব্যাপার, সরকারি কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণ করেও দুর্নীতি রোধ করা যাচ্ছে না।

\হদেশে বিশাল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে অথচ জননিরাপত্তা পরিস্থিতি ভয়াবহ। প্রতিদিন মানুষ খুন হচ্ছে। দেশের কোনো কোনো জনপদে প্রতিদিন মারামারি হানাহানি হচ্ছে। দেশে আইনের শাসন আজ প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা মানবাধিকারের কথা বলি অথচ বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি খুবই হতাশাজনক। সংসদীয় গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। সংসদে কোনো শক্তিশালী বিরোধী দল নেই। নতুন সংসদের বিরোধী দল আরো দুর্বল।

\হদেশের যোগাযোগব্যবস্থা সবচেয়ে বিশৃঙ্খল। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অনায়াসে তো যাওয়া সম্ভবই নয়, এমনকি রাজধানীর এক কিলোমিটার পথ রিকশা, বাসে, গাড়িতে অতিক্রম করতে কখনো কখনো দুই ঘণ্টাও লেগে যায়- তীব্র যানজটের কারণে। নিয়ম মেনে কেউ যানবাহন চালাতে চায় না। নিয়ম ভঙ্গ করতেই সবাই বেশি আগ্রহী। অবশ্য মেট্রোরেল ও এলিভেটেট এক্সপ্রেস ওয়ে চালু হওয়ার কারণে কিছুটা স্বস্তি নেমে এসেছে রাজধানীবাসীর চলাচলে।

দেশের নিত্যপণ্যের বাজার, শেয়ারবাজার বিশৃঙ্খল, ইচ্ছামতো চলছে। শেয়ারবাজারে ধস নামার কারণে দেশের লাখ লাখ পরিবার পথে বসেছে। দেশের শিক্ষা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। তিন-চার ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি থাকায়, শিক্ষা কাঠামো যেমন দাঁড়ায়নি, একইভাবে শিক্ষা নিয়ে সর্বত্রই অতি বাণিজ্য চলছে। নতুন কারিকুলাম নিয়ে চলছে বিতর্ক। কীভাবে অভিভাবকদের গলাকাটা যায়- তাই সর্বত্রই চোখে পড়ছে। দেশের শিক্ষা বিস্তার নয়, চলছে শিক্ষা বাণিজ্য। কোথাও শিক্ষা উপকরণ সহজলভ্য ও সহনীয় মূল্যে নেই। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা অজুহাতে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে, অভিভাবকদের জিম্মি করে। কোথাও কোনো নীতিমালা নেই। তাই শিক্ষার প্রকৃত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

দেশের চিকিৎসা খাতে আরও নৈরাজ্যজনক অবস্থা। একদিকে ডাক্তার ও হাসপাতালগুলো নিচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত টাকা, তারপরও সুচিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে না। বরং ভুল চিকিৎসায় রোগীর জীবন বিপন্ন হচ্ছে। রোগ নির্ণয়ের প্রকৃত পদ্ধতিই আমাদের চিকিৎসা খাতে গড়ে ওঠেনি। ফলে এক রোগ নিরাময়ের জন্য দশ রোগের ওষুধ দেয়া হয়। সামান্য কারণে দেওয়া হয় দশ-বারো রকমের পরীক্ষা। এখন ভুয়া চিকিৎসক ও ডায়াগনসিস সেন্টারের তো আর অভাব নেই। স্পর্শকাতর বস্নাডব্যাংকও এখন ভুয়া। এ যেন রোগ নিরাময় নয়, অর্থ ও মানুষের জীবন নিয়ে খেলা। নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী এসে অবশ্য পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন। দেখা যাক, কী ফল বয়ে আনে।

সরকারি কোনো কাজের জন্য ১০ জায়গায় ধরনা দিতে হয়। ঘুষ দিতে হয় প্রতিটি টেবিলে। তারপরও সময়ের কাজ সময়ে হয় না। দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিসে কাজের পরিবর্তে কীভাবে চুরি দুর্নীতি লুটপাটের মাধ্যমে ধনী হওয়া যায় সর্বক্ষণ সেই চিন্তায়েই ব্যস্ত থাকেন। এভাবে যদি রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্র ধরে ধরে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জায়গায় নিয়ে আসা যায় তবে চরম হতাশা ও নৈরাজ্যজনক চিত্রই চোখে পড়বে। ফলে আশাবাদী হওয়ার আর সুযোগ থাকবে না। এসব কারণে প্রশ্ন ওঠা অসঙ্গত নয়, আমরা কি এমন রাষ্ট্র চেয়েছিলাম। এর জন্য কি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। ভাষা শহীদরা রাজপথে রক্ত দিয়েছিলেন। এর জন্য কি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছিলেন, আড়াই লাখ মা-বোন ইজ্জত হারিয়েছিলেন। এত ত্যাগ, সংগ্রাম আর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সিস্টেমের ভেতর চলবে না, সর্বত্র কেবল অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম, নৈরাজ্য চোখে পড়বে- এটা মেনে নেওয়া যায় না।

অনেক দেরি হয়ে গেছে, এর জন্য এখনই করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। নিতে হবে সুনির্দিষ্ট সুষ্ঠু পরিকল্পনা। মনে রাখতে হবে ক্ষেত্রবিশেষ অগ্রগতি বা সাফল্য আর সামগ্রিক অগ্রগতি সাফল্য এক কথা নয়। দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি না হলে কোনোভাবেই উন্নত দেশের কাতারে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। বিএনপি বলছে, দেশে গণতন্ত্র নেই। প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচন, এটাও তারা বলছে। মানবাধিকার ও আইনের শাসনের ব্যাপারেও তাদের ধারণা নেতিবাচক।

আসলে রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণহীনতার কবলে পড়েছে জনগণ। আর এটা চলছে দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে। এটা দূর করতে না পারলে জনগণের ভাগ্যের যেমন পরিবর্তন হবে না, জনদুর্ভোগ, জননিরাপত্তা ও মানবাধিকারও সঙ্গিন অবস্থায় থাকবে। বাধাগ্রস্ত হবে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা। একই সঙ্গে রাষ্ট্রও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না। এটাও স্মরণে রাখা উচিত, যেনতেনভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা, আর সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে সুস্থ ধারায় সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে যাওয়ার মধ্যে আকাশ-জমিন পার্থক্য। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সম্মিলিত উদ্যোগ এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও পরিকলাপনা গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য নতুন সরকারকে উদার ও সহনশীল হতে হবে। ভিন্ন মতকে দিতে হবে প্রাধান্য। কাজটি অনেক কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়।

সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক ও সাংবাদিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে