দ্রব্যমূল্য ও নতুন সরকার
বাজার অস্থির আর উচ্চ মূল্যস্ফিতির কারণে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে। জাতিসংঘ বলছে, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে ও পাকিস্তানে বেড়েছে।
প্রকাশ | ২৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা চতুর্থবারের মতো গঠিত হলো সরকার। বর্তমান সরকারের নবনিযুক্ত মন্ত্রীরা প্রতিশ্রম্নতি দিচ্ছেন নিত্যপণ্যের দাম কমানোর। আসলে তা কতটা সম্ভব তা দেখার বিষয়। কারণ ভরা আমন মৌসুমে চালের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তার কারণ কি? এই কারণটি উদ্ঘাটন করলেই চালের দাম কমানো প্রক্রিয়াটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। ধান থেকে চাল আর এখন প্রান্তিক কৃষকেরা বানান না, চাল বানায় বড় বড় মিলগুলো। কিছুদিন আগেও যে ছোট ছোট চাতাল চাল বানাতো তারাও চাল বানানো বন্ধ করে দিয়েছে। ছোট ছোট চাতাল প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বড় বড় হাসকিং মিলগুলোর সঙ্গে টিকে থাকতে পারছে না। ফলে চালের বাজার হয়ে গেছে মনোপলি। একচেটিয়াভাবে বড় বড় চালকল মালিকরা তা দখল করে নিয়েছে। গুটি কয়েক চালকল মালিকেরা নিজেদের ইচ্ছামতো করে চালের দাম নির্ধারণ করে। তাই চালের দাম বাড়ে। অপরদিকে সরকার সীমিত পরিসরে স্বল্পমূল্যে চাল বিক্রি করছে, তা সামগ্রিক বাজারকে করতে পারছে না নিয়ন্ত্রণ। চালের দাম বাড়ার ফলে প্রান্তিক কৃষকরাও কিন্তু লাভবান হচ্ছেন না। ধান-চালের ব্যবসাটা কোটি কোটি টাকার মালিকেরা নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থ্যাৎ ধান থেকে চাল বানানোর কাজটি করছে বড় বড় কোম্পানির সিস্টার কনসার্ন কোম্পানিগুলো। এই কোম্পানিগুলো বাজার থেকে ফড়িয়া বা পাইকারদের মাধ্যমে ধান কিনে নিয়ে মজুত করে। তারপর একটি নির্দিষ্ট সময়ে চাল বানায়। এক পর্যায়ে নিজেদের নির্ধারিত মূল্যে তা বাজারে ডিলারের (কোম্পানির ডিলার) মাধ্যমে বিক্রি করে। এসব ধনী কোম্পানি তৈরি করেছে এক ধরনের সিন্ডিকেট। এটি এমন এক সিন্ডিকেট এদের ক্ষমতার হাত অনেক লম্বা। এখনকার চাল ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ায় এদের কাছে প্রশাসনও জিম্মি হয়ে পড়ে। বর্তমানে কৃষি ব্যবস্থায় এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, প্রান্তিক কৃষকেরা ধান বিক্রি করে চাল কিনে খান। গ্রামে ঢেকির প্রচলন উঠে গেছে অনেক আগেই। তারপর চাল ভাঙার ডিজেলচালিত পরে বিদু্যৎচালিত মেশিন আসে। বর্তমানে সেগুলোও ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। সুতরাং প্রান্তিক কৃষকরা যেন ধান থেকে চাল বানাতে পারেন, প্রান্তিক কৃষকেরা যেন ধান থেকে চাল বানিয়ে বাজারজাত করতে পারেন, এমন ব্যবস্থা তৈরি করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর এটা করতে পারলে চালের বাজারটা পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক হয়ে যাবে। মনোপলিতা কেউ করতে পারবে না। প্রান্তিক পর্যায়ে চাল উৎপাদন করতে না পারলে মুক্ত করা সম্ভব না। চালের বাজারের সিন্ডিকেট।
বর্তমানে মূল্যস্ফিতির হার কত। বিবিএসের মতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফিতি ছিল ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। কোন সূচকে এই মূল্যস্ফিতিটা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সরকার সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেন ৫০ শতাংশ করে। তখন ৬৮ টাকা লিটারের ডিজেল দাম বেড়ে ১১৫ টাকা হয়ে যায়। তারপর আবার সরকার প্রতি লিটার ডিজেলের দাম পাঁচ টাকা করে কমিয়ে দেন। এখানে মূল্য বৃদ্ধির হিসাবটা কিন্তু হয়ে যায় দু'রকমের, ২০২২ সালের মূল্যবৃদ্ধির হিসাবে দেখা যায় ৫০ শতাংশ। তারপর পাঁচ টাকা কমানোর ফলে দেখা গেলে মূল্য হ্রাস পেল, এই হ্রাসটা অঙ্কের হিসাবে প্রায় ৪ শতাংশের মতো। কোন সূচকের নিরিখে মূল্যবৃদ্ধির হার নির্ণয় করা হয়? অল্প অল্প করে গত ছয় মাসে ১ হাজার টাকার ১৩ কেজি সিলিন্ডারের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে হয়ে গেছে ১ হাজার ৫০০ টাকা। বাস্তবে দেখা যায় ১৩ কেজি সিলিন্ডার গ্যাসের মূল্য বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। তবে বাড়ানোর পদ্ধতিতে দেখলে দেখা যাবে এর মূল্য বেড়েছে, সর্বশেষ হিসাবে মাত্র প্রায় ৭ শতাংশ। প্রশ্ন আসতে পারে মুদ্রাস্ফিতি হলো ৯.৪১ শতাংশ? আর সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বাড়ল ৭ শতাংশ। তাহলে মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি কি অসহনীয় পর্যায়ের রয়েছে? দেশের সমষ্টিক অর্থনীতি নানা সংকটে জড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দেখা যাচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফিতি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, রিজার্ভ কমে যাওয়া, খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে, সেই সাথে বাড়ছে ঋণ অবলোপন, উচ্চ আয় বৈষম্য, সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাওয়া, বাজেট ঘাটতি মিটানোর জন্য ব্যাংক ঋণের নির্ভরতা, টাকা প্রচার, আর এই সব কারণে সামষ্টি অর্থনীতি সংকটের মুখে। তাছাড়া বিশ্ব রাজনীতির মোড়ল আমেরিকার কোপানলে বাংলাদেশ। তাই বৈদেশিক বাণিজ্যে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে দেখা দিচ্ছে নানা সমস্যা, কমছে প্রবাসীদের আয়ও। এ রকম সমস্যার কারণে বাংলাদেশের সমষ্টিক অর্থনীতি এখন রাহুর কবলে। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে দেখা দিচ্ছে তারল্য সংকট। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তারল্যে সংকট অব্যাহত থাকলে দেখা দেবে নানা ধরনের গুজব। আর গুজবকে রটিয়ে সিন্ডিকেট বাহিনী হয়ে উঠবে তৎপর। যার ফলে বাড়বে নিত্য পণ্যর দাম। এই গুজবীয় পদ্ধতিতে পণ্যের দাম বাড়লে প্রশাসন পুলিশ দিয়েও তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
আয় বৈষম্যটা চরম আকারে রূপ নেয়ায়, সরকারের মুদ্রানীতিতে মুদ্রা সংকোচন পদ্ধতিটা কার্যকর হচ্ছে না। অনেকের ধারনা মতে ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরের মতো রূপ নিতে চলেছে নিত্যপণ্যের বাজার। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বাজারে যে কোনো পণ্যের দাম গুজবীয় কারণে হঠাৎ হঠাৎ বেড়ে যেত। ৭৪ এর খাদ্যাভাবটাও কিছু দেশি ও আমেরিকার সৃষ্টি। বর্তমানেও নিত্যপণ্যের বাজারে ওই কালো মেঘের ঘনঘটা পরিলক্ষীত হচ্ছে। কিছু লেবাসধারী ১৯৭৩-৭৪ সালে সরকারের ভেতর ঢুকে ছিল অপরদিকে তাদের নিয়ন্ত্রক আমেরিকা বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অভিগমনের ক্ষেত্রে ব্যঘাত সৃষ্টি করে। যার ফলে ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয়েছিল চরম সংকট। আর এই সংকটের জন্য ১৯৭৫ সালে ঘটে পট পরির্বতন। ১৯৭৫ সালের পট পরির্বতনের ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমেরিকা স্থাপন করে কর্তৃত্ব। বর্তমান সরকারের সবচাইতে উলেস্নখযোগ্য অবদান হলো, কোন দেশের কাছে সরকার নতি স্বীকার করে না। বর্তমান সরকার ভীত না কোন পরাশক্তির হুমকিতে। তাই সরকারের বিরুদ্ধে শ্বেত ষড়যন্ত্র দেশের ভেতরে এবং বাহিরে অব্যাহত রয়েছে। এই শ্বেত ষড়যন্ত্রের অন্যতম কাজ হলো নিত্যপণ্যর মূল্যের ক্ষেত্রে অস্থিরতা সৃষ্টি করা। বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর একটি দেশ। চলতি বছরের আমন মৌসুমে যে ধান উৎপাদন হয়েছে তা লক্ষমাত্রার চেয়ে বেশি। কৃষির অন্যান্য পণ্য সবজি, তৈলবীজ, ডালসহ নানা ধরনের খাদ্য পণ্যের উৎপাদনে কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। তারপরও কেন খাদ্য পণ্যের বাজার অস্থির?
\হবাজার অস্থির আর উচ্চ মূল্যস্ফিতির কারণে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে। জাতিসংঘ বলছে, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে ও পাকিস্তানে বেড়েছে।
এ ধরনের নানা অবস্থার কারণে গুজব বাড়বে। সরকারের মন্ত্রীদের এই বিষয়ে কঠোর নজর দিতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ১৯৭৫ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনার সৃষ্টি হতে পারে।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক