নির্বাচনোত্তর কথকতা

এবার যেসব দল নির্বাচন বর্জন ও ধ্বংসাত্মক পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে নির্বাচন ভন্ডুল করার ব্যর্থ চেষ্টা করে জনগণের সহানুভূতি হারিয়েছে, পরবর্তী নির্বাচনে এর পুনরাবৃত্তি ঘটলে রাজনীতির জগৎ থেকে তাদের হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রকাশ | ২৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

নূরুর রহমান খান

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবি নিয়ে বঙ্গবন্ধু ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের শহর-বন্দর ও গ্রামেগঞ্জে। ৬ দফাকে মুক্তির সনদ হিসেবে বাঙালি গ্রহণ করেছিল এবং তার প্রতিফলন ঘটেছে ভোটের ফলাফলে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় সংসদে ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। এ দেশের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। কারণ ৬ দফার মধ্যে ছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মূলসূত্র। এ নির্বাচনকে বাঙালি স্বাধীনতার পক্ষে ম্যান্ডেট হিসেবে গ্রহণ করেছিল। ফলে পূর্ব পাকিস্তান হলো বাংলাদেশ। চাঁদ-তারা খচিত পতাকা স্থানচূ্যত হয়ে উঠলো লাল-সবুজ পতাকা, 'পাক্‌-সার জমিনে'র বদলে গীত হলো 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' এবং 'জয় বাংলা' ধ্বনিতে প্রকম্পিত হলো বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস। ১৯৭৩-এ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলেও চাঁদের কলঙ্কের মতো প্রশ্নবিদ্ধ ছিল খন্দকার মোশতাকের পশ্চাদ্বার দিয়ে সংসদে প্রবেশ এবং এই শ্বাপদকে বঙ্গবন্ধু প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। জাতির জনককে বুকের রক্ত দিয়ে এর মাসুল দিতে হয়েছে, ফল ভোগ করেছে সমগ্র জাতি। মোশতাক-জিয়া-চাষিদের নীল-নকশা বাস্তবায়িত করেছে ফারুক-রশীদ-ডালিম গং। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসন, স্বাধীনতা-বিরোধীদের নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠন, ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীনের পাশবিক আমল- কোনো সময়েই এ দেশের মানুষ স্বস্তিতে ছিল না। খালেদা জিয়ার দুঃশাসনও দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। ভোটে জুয়া চুরি থেকে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো জঘন্য অপরাধ খালেদা জিয়ার মদতে তারেকের পরিকল্পনাতেই ঘটেছিল। এর পরেও কয়েক দফা নির্বাচন অথবা নির্বাচনের প্রহসন হয়েছে। খালেদা জিয়ার শাসনকালে ২০০৪ সালের মাগুরা-২ উপনির্বাচন এবং মিরপুরের নির্বাচনের নামে জোচ্চোরির ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উঠেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত দুটি নির্বাচনে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। ফাঁকতালে ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীনের ক্ষমতা দখল, সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার, অর্থ সম্পদ লুট- সর্বোপরি পাকিস্তানি স্টাইলে ছাত্র-শিক্ষকদের নিপীড়ন-নির্যাতনে তথাকথিত নিরপেক্ষ সরকারের স্বাদ গণ-মানুষ হাড়ে মাংসে টের পেয়েছে। নাকে খত দিয়ে ঝেড়ে ফেলেছে 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার' নামক আবর্জনা। জিয়া-এরশাদ-খালেদার আমলে স্বাধীনতাবিরোধী '৭১-এর ঘাতক ও তাদের সমর্থকরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে স্বাধীনতার চেতনাকে ধূলিসাৎ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে-সাময়িক সফলতাও পেয়েছিল। ধূর্ত এরশাদ তো বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুককে প্রথমে সাংসদ ও পরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অন্যতম প্রার্থী হতে সহায়তা করেছে। ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচনও কলুষমুক্ত ও গণতন্ত্রের অনুকূল ছিল না। ঢাকা পৌর করপোরেশনের নির্বাচনও ছিল বহুল সমালোচিত। ২০২৪-এর নির্বাচন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। এজন্য অবশ্যই নির্বাচন কমিশন ধন্যবাদার্হ। সরকার তথা শেখ হাসিনারও ধন্যবাদ প্রাপ্য। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। জাতির দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর জিয়াউর রহমান, এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সমাধিস্থ করে সেই গোরের উপর সাম্প্রদায়িকতার চারা রোপণ করে শূকরের শোণিতে সেটিকে পুনর্জীবিত করা হয়েছে। শেখ হাসিনা সেই বিষাক্ত চারাটির মূলোৎপাটন করে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত বাংলাদেশের অন্যতম মূলস্তম্ভদ্বয় অসাম্প্রদায়িকতা এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে বিরামহীন চেষ্টা করেছেন। এখনো সম্পূর্ণ সফল হননি। তবে তার প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতার অভাব নেই। এ জন্য তাকে আরো কঠোর হতে হবে এবং ছদ্মবেশী মোশতাকদের চিহ্নিত করে যথাবিহিত ব্যবস্থা নিতে হবে। ২০২৪-এর নির্বাচন প্রসঙ্গে নির্মোহ মূল্যায়নে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে কয়েকটি ব্যক্তিক্রম ব্যতীত নির্বাচন সুষ্ঠু ও ফলাফল প্রত্যাশিত হয়েছে। ব্যতিক্রমের প্রথমেই আসে রূপগঞ্জের ঘটনা। '৭১-এর বীর মুক্তিযোদ্ধা সেখানে আবির্ভূত হয়েছেন দসু্য দলপতি হিসেবে। তারই ছত্রছায়ায় থেকে ভূমি দখল, মাদক ব্যবসা ও হত্যাকান্ডসহ সর্বাধিক অপরাধে তার লোকজন জড়িত। পত্রপত্রিকায় এ সম্পর্কে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। স্থানীয় অধিবাসী কট্টর আওযামী লীগ সমর্থক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃস্থানীয় একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক জানিয়েছেন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের চেয়েও ভয়ংকর রূপগঞ্জের চিত্র। তবু শুধু দলীয় জার্সি এবং প্রশাসনের নির্লিপ্ত সহযোগিতার বদৌলতে এই দুর্বৃত্ত হয়তো নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যাবে। নৌকা প্রতীকে ২২৩ জন নির্বাচিত সাংসদের মধ্যে এ ধরনের দুষ্কর্মে অভিযুক্তদের সংখ্যা ১০/১৫ জনের বেশী নয়। এদের দল থেকে বহিষ্কার করলে আওয়ামী লীগের ওপর জনগণের আস্থা বহুগুণে বেড়ে যাবে। শেখ হাসিনা ২০২৪-এর নির্বাচনকে 'যুগান্তকারী ঘটনা' হিসেবে উলেস্নখ করে বলেন, 'নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের এত আগ্রহ-উদ্দীপনা আগে কখনো দেখিনি। নির্বাচন যে অবাধ, সুষ্ঠু হতে পারে সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছি। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছে। দেশে বেসরকারী চ্যানেল ও সংবাদপত্রগুলো স্বাধীনভাবে কথা বলতে ও লিখতে পারে। যখন কেউ সমালোচনা করে তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে শোধরানো যায়, আমি এভাবেই দেখি।' এ কারণেই এবারের নির্বাচনে ২০১৪ ও ২০১৮-এর পুনরাবৃত্তি ঘটেনি। নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছে। ফলে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে আগ্রহী হয়েছে। শহরাঞ্চল থেকে তুলনামূলকভাবে মফস্বলে ভোট বেশি পড়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উলেস্নখ করতে হয়। সম্ভবত ১৯৮৪-৮৫ সালে যখন জ্যোতিবসুর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম-এর জয়জয়কার তখন কলকাতার পাঁচটি আসনের মধ্যে সিপিএম একটিতেও জয়লাভ করতে পারেনি। সেবারই প্রথম তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাদবপুর কেন্দ্র থেকে সিপিএম-এর হেভিওয়েট প্রার্থী বর্ষীয়ান নেতা সোমনাথ ব্যানার্জিকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন। কলকাতায় সিপিএম-এর বিপর্যয় সম্পর্কে আমার প্রশ্নোত্তরে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সিপিএম-এর সেক্রেটারি জেনারেল তথা কিংমেকার সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'আমরা সাধারণ মানুষের কাছে প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ যে, তাদের জন্য স্বল্পব্যয়ে মোটা কাপড় মোটা চালের ব্যবস্থা করব যাতে তাদের জীবনযাত্রা সচল থাকে। আমরা প্রতিশ্রম্নতি রক্ষা করতে পেরেছি। সে তুলনায় শহরের ভদ্র লোকদের জন্য হয়তো চেষ্টা সত্ত্বেও তেমন কিছু করতে পারিনি। তাই সাধারণ মানুষ আমাদের পাশে আছে।' গণসমর্থন নিয়ে জ্যোতিবসু একটানা ৩৩ বছর পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যবিধাতা ছিলেন। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে যা হয়, ক্ষমতা দলীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিকে দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে। তারই খেসারত দিচ্ছে বর্তমান সিপিএম দল। এ আবর্ত থেকে সহসা তাদের বেরিয়ে আসার মম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। ঢাকা শহরে ভোটার স্বল্প উপস্থিতির প্রধান কারণ আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত করানোর জন্য আওয়ামী লগি কর্মীদের তৎপরতাও চোখে পড়েনি। ঢাকার চার আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহচর ড. আওলাদ হোসেন। তিনি আওয়ামী ঘরনার বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত কর্মী। তার কর্মদক্ষতা, সততা ও জনপ্রিয়তাকে সম্বল করে আওয়ামী লীগের মূল প্রার্থী এবং জাতীয় পার্টির দু'বারের নির্বাচিত এমপিকে পরাজিত করে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। কিশোরগঞ্জ-২ আসনে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনপুষ্ট বিএনপির সাবেক এমপি মেজর আখতারুকে কুপোকাত করে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী অ্যাডভোকেট সোহরাব উদ্দীন বিজয়ী হয়েছেন। এবারের নির্বাচনের অন্যতম চমক হবিগঞ্জ-৪ আসনে বিজয়ী নির্দলীয় প্রার্থী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন প্রতিবাদী কণ্ঠ, নিপীড়িত আর্তজনের স্বজন হিসেবে বহুল আলোচিত। ক্ষমতায় না থেকেও এলাকার উন্নতির জন্য প্রচুর কাজকর্মে নিজেকে সম্পৃক্ত করে সর্বশ্রেণির সশ্রদ্ধ ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। তার সুকীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ জনসাধারণের সমর্থনে ব্যারিস্টার সুমন ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রতিমন্ত্রীকে ধরাশায়ী করে বিপুল ভোটে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি নির্দলীয় প্রার্থী হলেও আত্মপরিচয় দিয়েছেন, 'আমি প্রোডাক্ট অব আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধুর সৈনিক, শেখ হাসিনা আমার নেত্রী।' ব্যারিস্টার সুমনের আশু লক্ষ্য 'নিজের এলাকাকে যতটুকু পারা যায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার আলোকে' আলোকিত করা। প্রায় প্রত্যেক নির্বাচিত নির্দলীয় ও আওয়ামী ঘরানার বিদ্রোহী নির্বাচিত প্রার্থী অভিন্ন প্রত্যয় প্রকাশ করেছেন। সবারই উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার রূপায়ন। আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার অভূতপূর্ব সাফল্যে চীন, রাশিয়া, ভারত, জাপান, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, নেপাল, ব্রাজিল ও মরক্কো প্রভৃতি দেশ থেকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় শেখ হাসিনাকে অভিনন্দনপত্র পাঠিয়েছেন ভুটানের রাজা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেট্রেঅর্পো এবং সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি বেস্নয়ারও অভিনন্দন জানিয়েছেন। প্রত্যেকেই শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে বিএনপি, সমমনা দলগুলোর অপপ্রচার ও নৌকা প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগের জোটভুক্ত বিপর্যস্ত দল এবং তাদের প্রার্থীদের বক্তব্যও প্রণিধানযোগ্য- কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৌতুককরও বটে। এদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থীদের বক্তব্যের মূল সুরে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। জাতীয় পার্টির সভাপতি জি এম কাদের এখন বলছেন, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। উলেস্নখ্য, তার স্ত্রীসহ জাতীয় পার্টির ২০০ প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। তিনি বেমালুম বিস্মৃত হয়েছেন যে, এখন পর্যন্ত তারা সংসদে যেতে পারছেন শুধু পরিস্থিতির কারণে ও শেখ হাসিনা অপার অনুগ্রহ ও দয়াদাক্ষিণ্যে। অন্যথায় বণিতাবন্ধু প্রতারক পতিত স্বৈরাচারে দল এ দেশের মাটিতে রাজনীতি করতে পারত না। খোদ জাতীয় পার্টির মধ্যেই তার ও জাপার সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে অনৈতিকতার কারণে নির্বাচনে দলের বিপর্যয়ের অভিযোগ উঠেছে। আওয়ামী জোটভুক্ত জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও তার দলের মহারথীরাও বলছেন যে, তাদের দল 'কারচুপির ভোটে' পরাজিত হয়েছে। তারা বিস্মৃত হয়েছেন যে, এতদিন আওয়ামী লীগের জার্সি ও নৌকা প্রতীকেই তাদের বিজয় এনে দিয়েছে। কেউ অভিযোগ করেনি যে দিনের ভোট রাতে হয়েছে। একমাত্র ক্ষোভ আওয়ামী লীগাররা তাদের ভোট দেয়নি। আওয়ামী লীগ কিছু আসনে নৌকা ধার দিলেও তাদের মাঝি-মালস্নাদের ছেড়ে দেয়নি। এমন আশ্বাসও দেয়নি যে, নিজেদের ভোট দিয়ে তাদের জিতিয়ে আনবে। সম্ভবত অতীত কর্মফলই তাদের ভাগ্য বিপর্যয়ের কারণ। একই অভিমত পরাজিত আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তৃণমূল বিএনপির ব্যারিস্টার অন্তরা হুদা যথার্থই বলেছেন, 'দেশের রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাত থেকে ব্যবসায়ীদের করায়ত্তে চলে গেছে।' এটি আমাদের দেশের সব রাজনৈতিক দল সম্বন্ধেই বলা চলে। এককালে রাজনীতি ছিল 'সেবা', এখন হয়েছে 'পেশা' এবং এ সত্য ৯০% বাস্তব ও অনস্বীকার্য। এই পেশা নৈতিকতা বহির্ভূত পদ্ধতিতে বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের পর জীবনের অন্তিম লগ্নে ২০২৪-এ মোটামুটি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের সাক্ষী হলাম। বেঁচে থাকলে হয়তো ২০২৯-এর সূচনায় এরই ধারাবাহিকতায় আরেকটি সুন্দরতর নির্ভেজাল নির্বাচনে ভোট দিতে পারব। এবারের নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে যেতে অনাগ্রহী অনেকের আশঙ্কা কেটে গেছে। নির্বাচনী ট্রেনের যাত্রী হওয়ার উদ্দেশ্যে পরবর্তী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে যদি সব দল অংশগ্রহণ করে তাহলে ৫৫% থেকে ৬৫% পর্যন্ত ভোট পড়তে পারে। পরম করুণাময়ের ইচ্ছায় শেখ হাসিনা সুস্থ থাকলে দলীয় ছদ্মবেশী মোশতাক ও স্তাবকমুক্ত হয়ে ১৯৭০-এর মতো আরেকটি নির্বাচন করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সোনার বাংলা বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হবেন।

 

শেখ হাসিনা এবং নবনির্বাচিত সাংসদদের কাছে দেশবাসীর অনেক প্রত্যাশা। তাদের কাছে আমাদের দাবি: 
১. বঙ্গবন্ধুর অনুমোদিত ১৯৭২-এর সংবিধান কোনোরকম সংশোধন ব্যতীত পুনর্বহাল করতে হবে। সংশোধন প্রয়োজন হলে এই সংসদই তা করবে। 
২. দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করতে হবে এবং একাজটি নিজের ঘর আওয়ামী লীগের মধ্য থেকেই শুরু করতে হবে। 
৩. বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কঠোরতম অবস্থানে যেতে হবে। কোনোরকম দুর্বলতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে এ ধরনের সিন্ডিকেটের হোতাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। 
৪. সনাতন চিন্তাধারার বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নারী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে আসন সংরক্ষণের রেওয়াজ এক সময় প্রয়োজন ছিলে। এখন নারীদের জন্য সর্বত্র আসন সংরক্ষণ অপ্রয়োজনীয়। প্রকারান্তরে এতে তাদের অবমূল্যায়ন ও অপমানই করা হচ্ছে। যে দেশে নারী প্রধানমন্ত্রী, সংসদের উপনেতা, একাধিক মন্ত্রী, বিচারপতি, উপাচার্য, সরকারি কর্মকমিশনের সদস্য, সচিব, ব্যাংক কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নারীÑ সেখানে সংসদে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ নি®প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বহুবিধ কেলেঙ্কারির অবকাশ রয়েছে এবং তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্য এবার সংবিধান অনুযায়ী ৫০টি সংরক্ষিত আসনে নারীদের মনোনীত করতে হবে। বর্তমান সংসদে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণের আইনবাতিল করতে হবে। এর বিকল্প হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছু প্রত্যেক দল থেকে  ১৫% নারীকে মনোনয়ন দান বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। প্রশ্ন উঠবে, বর্তমানে সংরক্ষিত আসনে ৫০ জন নারীসহ সংসদে আসন সংখ্যা ৩৫০ আর নির্বাচনী এলাকা ৩০০। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনী এলাকা ৩০০-এর পরিবর্তে ৩৫০ করলেই বিতর্কের অবসান ঘটবে। প্রয়োজন সদিচ্ছার। এ কাজটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে সহজেই করা সম্ভব। তার ওপর আমাদের ভরসা আছে। এ কাজটির রূপায়ন বাংলাদেশের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। 
এবার সম্ভাব্য ৫০ জন মনোনীত মহিলা সাংসদের মধ্যে সংখ্যানুপাতে অন্তত ৪০ জন শেখ হাসিনার প্রার্থী থাকবেন। আমরা আশা করব, তিনি আত্মীয়তা কিংবা ব্যক্তি সম্পর্ক বিবেচনায় না এনে মোহমুক্ত চিত্তে আওয়ামী ঘরানার যোগ্য মহিলাদের সংসদে নিয়ে আসবেন যারা শুধু শোভা বর্ধন না করে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংসদে প্রাণ সঞ্চার করতে পারবেন। উদাহরণ হিসেবে দুজনের নাম প্রস্তাব করা যায়। ডাকসুর সাবেক নির্বাচিত ভিপি বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর মাহফুজা খানম অদ্যাবধি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতি ও সামাজিক আন্দোলনের অংশীদার। তিনি একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের সেনেট, সিন্ডিকেট এবং গভর্নিং বডির সদস্য ও সভাপতি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন ও করছেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক এবং দুবার নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন। প্রফেসর নাসরিন আহমাদের মাতা ১৯৫০ থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্যা সংসদ সদস্য এবং বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিপরিষদে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী হিসেবে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেন। নাসরিন আহমাদ বীর মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ‚গোল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও পরবর্তী সময়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। সংসদে আমরা শেখ রেহানাকেও দেখতে চাই। আমাদের ধারণা তাদের উপস্থিতিতে সংসদের মর্যাদা ও ঔজ্জ্বল্য বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে অথবা নিজস্ব বিশ্বস্ত জনদের মাধ্যমে শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই যোগ্যতাসম্পন্ন দুর্নীতিমুক্ত ৪০/৪৫ জন বিভিন্ন পেশার উপযুক্ত প্রার্থীর সন্ধান পাবেনÑ যারা তার যোগ্য সহকর্মী হতে পারেন। 
আমাদের শঙ্কা তোয়াজ মোহাম্মদ ও তৈলমর্দন বাবুদের নিয়ে। শেখ হাসিনা যে বঙ্গবন্ধুকন্যাÑ এ তথ্য কে না জানে? যারা প্রতি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা’ ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা’ জিগির করে মুখে ফেনা তোলেন, তাদের অতি ভক্তি সন্দেহের কারণ। শেখ হাসিনা শুধু একটি নাম নয়, একটি প্রতিষ্ঠান। সুতরাং, তাকে অন্য পরিচয় বা বিশেষণে বিশেষিত করা বালখিল্যতার নামান্তর মাত্র। 
আমরা অপেক্ষা করছি, ২০২৮-২৯ এর নির্বাচনী ট্রেনের বংশীধ্বনি শোনার। 
এবার যেসব দল নির্বাচন বর্জন ও ধ্বংসাত্মক পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে নির্বাচন ভÐুল করার ব্যর্থ চেষ্টা করে জনগণের সহানুভ‚তি হারিয়েছে, পরবর্তী নির্বাচনে এর পুনরাবৃত্তি ঘটলে রাজনীতির জগৎ থেকে তাদের হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

ড. নূরুর রহমান খান : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়