চলতি বছরের চব্বিশ সালের জানুয়ারি মাসের সাত তারিখ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ভোটার তথা জনগণের মাঝে যে জল্পনা-কল্পনা এই নির্বাচন নিয়ে ছিল তা এক প্রকার শান্তিতেই মিঠে গেল মনে হচ্ছে। ভোটকেন্দ্রগুলোতে তেমন কোনো বাড়তি চাপাচাপি দেখা যায়নি। সুনসান নীরবতায় সব যেন সুন্দর আগামীকে আহ্বান করছিল। কেউ হাল ছেড়ে দিল আবার কেউ কেউ নিরুত্তাপ কেবল সংসার জীবন, নিজের ক্যারিয়ার নিয়েই এখন ভাবতে পছন্দ করে, নির্বাচন নয়। সরজমিনে দেখা গেল, মুষ্টিমেয় কিছু লোক রাজনীতি ও নির্বাচনের উন্মাদনায় মত্ত থাকে।
মানুষ এখন বুঝে গেছে নিজের পরিশ্রমে রোজগার করে ভাত ডাল খেতে হবে। নিজেদের চিকিৎসা, ঘর কিংবা সন্তানের পড়ালেখার খরচ নিজেদেরই জোগাড় করতে হবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বাসাভাড়ার উচ্চ দাম আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা, খাওয়া-দাওয়ার খরচা জোগাড়ে এখন মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। ধনী শ্রেণি আরও ধনী হচ্ছে আর গরিবরা হচ্ছে দিন দিন উপায়হীন। মধ্যবিত্তরা দু'টানায় পড়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। সাধারণ মানুষের দেশ কোন দিকে যাচ্ছে, কেন, কী হচ্ছে, কে, কোন ফায়দা লুটতে কোন কায়দায় এগিয়ে যাচ্ছে তারা দেখেও দেখে না। বেশিরভাগ জনতা একদমই অনাগ্রহী দেশ কীভাবে চলছে তার কূটকৌশল জানতে বা শুনতে। জনগণ এখন ভাবতে শিখে গেছে কঠিন বাস্তবতায় চলতে। আদারবেপারীর জাহাজের খোঁজ নিয়ে এখন আর কোনো লাভ নেই। আগে নির্বাচনের সময় গরম নরম খবর শুনতে খুব আগ্রহে মানুষ টিভির পর্দায় তাকিয়ে থাকত, চায়ের দোকানে ধূম ঝড় উঠত আর নারীকূল বসে বসে কাকে ভোট দেবে, কে কতটা দেশের ভালো চিন্তা করে, কোন ব্যক্তি যোগ্য তা ভেবে সুচিন্তিত মতামত দিত। এখন তা মোটেও সাদামাটাভাবে চোখে পড়ে না। শুধু গুটি কয়েকের উচ্ছ্বাস প্রকাশ আরও যেন ম্রিয়মাণ করে দেয় জেতার আনন্দ আর যত আয়োজন। বর্তমানে প্রতিটি নির্বাচন এখন আর আগের মতো জনপ্রিয় ইভেন্ট নয়। টান টান উত্তেজনা নেই। এখন রাত জেগে কেউ বসে থাকে না, কোন দল কয়টা আসনে জয়লাভ করেছে তা শুনতে। সব যেন এখন রিমোট কন্ট্রোলের মতো মানুষের চিন্তাভাবনাও নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে। এখন কেবল একটি ছোট্ট বাক্য শুনি, 'ভালস্নাগে না।'
এই চব্বিশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় হয়েছে। এবার দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ডিউটিতে যাতায়াত ভাতাসহ প্রদান করা হয়, যা নির্বাচন হিস্যায় কম-বেশি সবাই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। বলতে দ্বিধা নেই যে, ন্যায্য পাওনাটা নির্বাচন কমিশন দিয়েছেন- যা আগে কোনোকালে ছিল না। আশা করি, সামনে আরও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হবে এবং মর্যাদার দিক দিয়ে স্তর বিন্যাস আরও সুদৃঢ় উচ্চায়ন হবে। তবে ভোট গ্রহণে এত জনবলকে দায়িত্ব না দিয়ে তা আরও ছোট আকারে নিয়ে আসা উচিত। কেন্দ্র প্রতি এতগুলো লোক ডিউটিতে দরকার আছে বলে মনে হয় না। এতে নির্বাচনে ব্যয় আরও সংকুচিত হতো। দেশ চালানোর মন্ত্রী পরিষদও ছোট আকার হওয়া সমীচীন। এতে পরিশ্রম ও অর্থের সাশ্রয় হতো। দরকার হলে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য। এবং যে ব্যক্তি যে মন্ত্রণালয় চালানোর বিষয়ে ভালো জ্ঞান ও পান্ডিত্যের দখল রাখেন তাকে সেই দপ্তর সম্পাদন করতে দেওয়া উচিত। এক কথায় হৃদয় দিয়ে দেশকে ভালোবেসে দিনরাত খাটার লোকই দরকার দেশের উন্নয়নের জন্য। নরম গালিচায় শুইয়ে দেশের ভাবনা ভাবা যায় না সঠিকভাবে কখনোই। একজন দিনমজুর আর রিক্সাওয়ালার চিন্তা করবে কে বা কারা? তেমন খাঁটি লোকই আমাদের দরকার।
এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত দলের প্রতি জনগণের আগেকার চেয়ে প্রত্যাশা অনেক বেশি। সেজন্যই হয়তো জনগণ নিশ্চিন্তে একই দলকে ফের ক্ষমতায় আসীন করতে সহায়ক হয়েছে। পৃথিবীর মানচিত্রে একটিই দেশ লাল-সবুজের বুকে লাখো শহীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে পাওয়া প্রিয় বাংলাদেশ। এই দেশকে যারা ভালোবাসে তারা খুবই আবেগী ও পাগলপারা বাংলা বলতেই। এদেশের মানুষের কথা সরকারকে তাই সর্বাগ্রে ভাবতে হবে। জনগণ তাদের যে সুযোগ আবারো দিয়েছে তা যেন হেলায় ব্যক্তিগত লাভের মোছায় না ভরে। সেদিকে সরকারকে অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে। বিগত দিনের মতো দেশের উন্নয়নধারা অব্যাহত রাখতে হবে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মের আচার, ব্যবসা বাণিজ্য সর্বোপরি শান্তি আনয়নে সরকারকে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। জনগণের ডোর টু ডোর খোঁজখবর নিতে হবে হযরত ওমর ফারুক (রা.) শাসকের মতো। মানুষ আর ক্ষমতা একদিন চিরতরে বিনাশ হবে। মুঘল সাম্রাজ্য আজ অতীত। তবুও ইটপাথরের দালান, শিক্ষা সংস্কৃতি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় তাদের সেই দাপুটে চিহ্ন পৃথিবীর বহুল জায়গায় স্থাপনায় আঁচড় কেটেছে পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত খোদা চাইলে তা স্বাক্ষর বহন করে যাবে।
বর্তমান সরকারকেও যুগান্তকারী কিছু ভালো কাজ উপহার দিতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার কার্যকরী আমূল পরিবর্তন দরকার, অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কৃষিখাতে বিপুল অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে হবে। যাতে দেশের মানুষ দু'বেলা দুমুঠো ভাত পায়। সৎভাবে অল্প রোজগার করেও যেন মাসে অন্তত দুই-চার বার মাছ মাংস খেতে পারে।
আবাসনে আয় রোজগার অনুযায়ী মাথা গুঁজার ঠাঁই যদি সরকার বিভিন্ন ডরমিটরির মাধ্যমে সর্বসাধারণের জন্য গড়ে দিত তাহলে গাদা গাদা বস্তি এলাকা গড়ে উঠত না, পরিবেশও সুন্দর থাকত আর উচ্চমূল্যের ভাড়া বাসায় জনগণকে থাকতে হতো না। ঋণের বোঝা কমিয়ে এককালীন মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাবার জন্য সরকারের উচিত এখনই এলাকাভিত্তিক খুবই জোরালোভাবে এই কার্যক্রম হাতে নেওয়া। রেশনিং পদ্ধতি চালু করা অত্যাবশক। তাহলেই সরকার মুগলদের মতো শত বছর দেশ শাসন করতে সমর্থ হবে।
জনগণ চায় একটু শান্তিতে নির্ভাবনায় থাকার নিশ্চয়তা, যা রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিয়ে ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
এদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা দুর্নীতি। পাওয়ারফুল মামা, খালুদের দৌরাত্ম্য। দুর্নীতি আসে সব সময় ওপর থেকে। নিচে শ্রমিকশ্রেণির লোকজন এসব কারসাজি জানেই না। ফলে বদনাম হয় পুরো দেশের মানুষের। জনগণ সচেতন হলে দুর্নীতি থাকবে না তা কিন্তু নয়। সরকারি প্রতিটি কাজে সৎ মনোনিবেশই একটি দেশের দুর্নীতি কমাতে পারে। আগে সরকার নিজে শেখাবে দুর্নীতিশূন্য কাজ বাস্তবায়ন করে তারপর জনগণ সেই পথে চলতে বাধ্য থাকবে। আবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে বিবেককে আশ্রয় করলে দেশ এগিয়ে যাবে তরতর করে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো কেবল সততা ও পরিশ্রম এবং অদম্য মনোবলে রিস্ক নিয়ে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে একটি সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত হয়েছে। বিষণ্ন্ন ভগ্নহৃদয়ে বেহাল চিন্তা নয়, বরং ইনোভেটিভ পজিটিভ ভাবনায় এগিয়ে উন্নত জাতি গঠনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
বর্তমান প্রজন্ম এখন চোখে যে ওপেন সিক্রেট দৃষ্টান্ত দেখছে তা ভবিষ্যতের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। অনেকটা নির্লজ্জতা, চোখের শরমও ওঠে গেছে। মনের পর্দা তো উঠেছেই উপরন্ত্তু চোখের সামনেও জঘন্য খোলা ঘোলা পানি দেখছে জাতি। এটা কিছুতেই কাম্য নয়। একমাত্র স্বচ্ছতাই স্বচ্ছতা আনয়ন করতে সক্ষম। আশা করি, এ দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সৎ ও ন্যায়বান হতে শিখবে সরকারের নানামুখী ভালো কার্যক্রম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। সত্যকে সম্মান ও মেনে নেওয়ার টেন্ডেন্সি তৈরি করতে হবে। কথায় আছে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে তা রক্ষা করা কঠিন। ক্ষমতা কারো চিরস্থায়ী নয়। তাই স্রষ্টা ভালো কাজ করার যে সুযোগ দিয়েছেন তা কেবল নিজের জন্য ব্যয় না করে জনগণের জন্য উদার চিত্তে সদ্ব্যবহার করা উচিত।
আমরা বাঙালি বাংলাদেশী এমন একটা জাতি যাদের বছরে বারো মাসই ঝড়, তুফান, বন্যা, খরা, বৃষ্টি, অর্থনৈতিক মন্দাভাব আর জিনিসপত্র দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী, কাঁচামাল, পড়ালেখা সবকিছুতেই উচ্চমানের ঝুঁক্বি ঝামেলা নিয়েই হরহামেশাই লড়াই করে চলছি। তাই দেশের সরকারকে অনুরোধ এমন একটি দেশ গঠনে সহায়ক হোন যাতে দেশের মানুষ তাদের মৌলিক অধিকারগুলোর সুনিশ্চিত বাস্তবায়নে সঠিক রূপ পায়। শুধু কথায় নয় কাজে পরিচয় দিতে হবে। যুগে যুগে যেন বর্তমান সরকারের ভালো কাজগুলো সুঘ্রাণ ছড়ায় এই কামনা করি। হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দেশের মানুষের অসহায় মুখগুলোর দিকে দয়া করে একবার তাকাবেন দিবালোকে। তখনই সঠিক সিদ্ধান্তে দেশ হবে ধন্য ও কল্যাণময়। আসুন, নিজের মাতৃতুল্য দেশকে ভালোবাসি এবং দেশের মঙ্গলে প্রতিদিন গড়ে অন্তত একটি ভালো কাজ জাতিকে উপহার দেই।
পারভীন আকতার : শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক