শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

বৈশ্বিক অস্ত্র উৎপাদন ও প্রতিযোগিতা

অলোক আচার্য, পাবনা
  ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বৈশ্বিক অস্ত্র উৎপাদন ও প্রতিযোগিতা

অস্ত্র মানেই বিপুল ব্যবসা। একদিকে ধ্বংস আবার অন্যদিকে ফুলে ফেঁপে ওঠা। আবার শক্তিমত্তার নির্ণায়কও এই অস্ত্র। এই বিশ্ব চলছে অস্ত্রের দাপটে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পৃথিবীর রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমরনীতিতে নতুন মেরুকরণ তৈরি করেছে। জোট এবং জোটনীতিতেও নতুন চিন্তা-ভাবনা যোগ হচ্ছে। সেই সঙ্গে বর্তমান পৃথিবীর শক্তিমত্তার অন্যতম নির্ধারক অস্ত্র সমৃদ্ধকরণেও গতি সঞ্চার করেছে। সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়ে নিরাপত্তা জোরদার করার চেষ্টা করছে। জোর দিচ্ছে জোটের ওপর এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর। সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নয় বরং এখন যেন এটাই করতে হচ্ছে। ২০২১ সালের তুলনায় গত বছর সামগ্রিকভাবে অস্ত্র ব্যবসার আয় হ্রাস পেয়েছে সাড়ে ৩ শতাংশ। ২০১৫ সালের পর প্রথমবারের মতো এ খাতের আয় নিম্নগামী হলো। সুইডেনভিত্তিক 'স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি)' বিশ্বের শীর্ষ ১০০ প্রতিষ্ঠান নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে এ চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রেরই ৪২টি প্রতিষ্ঠান জায়গা করে নিয়েছে, যাদের দখলে রয়েছে বৈশ্বিক অস্ত্র-বাণিজ্যের মোট আয়ের ৫১ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠানগুলো গত বছর ৬০ হাজার কোটি ডলার আয় করেছে। প্রথমবারের মতো তুরস্কের বায়কার কোম্পানি তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে, যারা যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোন সরবরাহ করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। গত বছর তুর্কি কোম্পানিটির বিক্রি বাড়ে ৯৪ শতাংশ। সিপ্রি বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ৪২টি কোম্পানি গত বছর আয় করে ৩০ হাজার কোটি ডলারের ওপরে, যা ২০২১ সালের তুলনায় ৭ দশমিক ৯ শতাংশ কম। ইউরোপীয়রা গত বছর ১২ হাজার ১০০ কোটি ডলার আয় করে, যা বছর শেষে কমেছে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ। জার্মানির চারটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে বছর শেষে ১ দশমিক ১ শতাংশ বেশি আয় করে। চীনের আট কোম্পানি তালিকায় স্থান পায়, যাদের তিনটি শীর্ষ দশে। একক দেশ তারা যুক্তরাষ্ট্রের পরেই। গত বছর চীনা কোম্পানিগুলোর আয় ছিল ১০৮ বিলিয়ন ডলার। এদিকে সিপ্রি রাশিয়ার অস্ত্র প্রস্তুতকারকদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য পায়নি। দেশটির মাত্র দুটি কোম্পানির তথ্য তারা সংগ্রহ করতে পেরেছে। সেগুলো হলো রসকেট ও ইউনাইটেড শিপবিল্ডিং যৌথভাবে, যাদের আয় কমেছে ১২ শতাংশ। নিজেদের শক্তিমত্তা বৃদ্ধি করা, হুমকি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা এবং এ উদ্দেশ্যে সামরিক খাতে নতুন নতুন অস্ত্র যোগ করা এবং বিশ্ব প্রতিযোগিতায় নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা এখন প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের প্রবণতা।

এখন বিশ্ব ঝুঁকছে অত্যাধুনিক অস্ত্র যেমন- হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের দিকে। কারণ হাইপারসনিক অস্ত্রই বর্তমানে আধুনিক অস্ত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে মনে করা হচ্ছে। নিরীহ গাঁজাবাসীর প্রাণ কাড়ছে মারণাস্ত্র। অস্ত্রের আঘাতে নিরীহ মানুষের প্রাণ। অস্ত্রই ক্ষমতা। এখন এটাই অন্যতম বড় নির্ধারক। ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পেতে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। এর সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো এই ক্ষেপণাস্ত্র শব্দের চেয়ে নয় গুণ বেশি গতিতে উড়তে পারে। ফলে শত্রম্নর চোখ ফাঁকি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুল আঘাত করতে সক্ষম। আর মাঝপথে ধ্বংস করাও প্রায় অসম্ভব। ইউরোপে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর নিরাপত্তা উদ্বেগ বেড়ে যাওয়ায় হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে বাইডেন প্রশাসন। ক্ষমতাধর বিশ্বের কাছে এই অস্ত্র একটি অত্যাধুনিক সংযুক্তি।

সমরক্ষেত্র আধুনিকায়নে ব্যস্ত প্রতিটি দেশ। কেউ অস্ত্র তৈরি করছে আবার কেউ অস্ত্র কিনছে। স্ট্যাটিস্টার সর্বশেষ (১০ মার্চ, ২০২৩) তথ্য অনুযায়ী, শীর্ষ দশ অস্ত্র আমদানিকারক দেশের মধ্যে সবার ওপরে রয়েছে যৌথভাবে ভারত ও সৌদি আরব। বৈশ্বিক অস্ত্র রপ্তানির ১১ শতাংশই কেনে এই দুই দেশ। এরপরেই রয়েছে যথাক্রমে- মিসর (৫.৭ শতাংশ), অস্ট্রেলিয়া (৫.৪%), চীন (৪.৮ শতাংশ), কাতার (৪.৬ শতাংশ), দক্ষিণ কোরিয়া (৪.১ শতাংশ), পাকিস্তান (৩%), সংযুক্ত আরব আমিরাত (২.৮%) এবং জাপান (২.৬%)। আর শীর্ষ ১০ অস্ত্র রপ্তানিকারকদের মধ্যে রয়েছে-যুক্তরাষ্ট্র (৪০%), রাশিয়া (১৬%), ফ্রান্স (১১%), চীন (৫.২%), জার্মানি (৪.২%), ইতালি (৩.৮%), যুক্তরাজ্য (৩.২%), স্পেন (২.৬%), দক্ষিণ কোরিয়া (২.৪%) এবং ইসরায়েল (২.৩%)। উলেস্নখযোগ্য ঘটনা হলো, পাকিস্তানের আমদানির ৭৭ শতাংশই সরবরাহ করেছে চীন। এসআইপিআরআই বলছে, ইউক্রেনে যেসব অস্ত্র যাচ্ছে এর বেশিরভাগই আগে ব্যবহৃত। এর মধ্যে দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্র পাঠিয়েছে ২২৮টি আর্টিলারি ও পাঁচ হাজার গাইডেড আর্টিলারি রকেট। আর ২৮০টি ট্যাংক পাঠিয়েছে পোল্যান্ড। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্য সাত হাজার ট্যাংক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধক পাঠিয়েছে ইউক্রেনে। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র রপ্তানি তীব্রভাবে বাড়লেও, সর্বশেষ বছরে ওয়াশিংটন অন্য চারটি দেশে রপ্তানি বেশি করেছে। ২০২২ সালে ওয়াশিংটন যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র রপ্তানি করেছে তার মধ্যে সবার ওপরে রয়েছে কুয়েত। এরপরে যথাক্রমে রয়েছে, সৌদি আরব, কাতার ও জাপান। ইউক্রেনে যেসব অস্ত্র পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র তার অধিকাংশই কম অত্যাধুনিক ও ব্যবহৃত। আর ওই চারটি দেশে অত্যাধুনিক অস্ত্র, যুদ্ধবিমান ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঠিয়েছে তারা।

২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বে অর্থ রপ্তানির হাত ৪ দশমিক ৬ শতাংশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু ইউক্রেন সংকটের কারণে এখন অস্ত্র রপ্তানি ১৯ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিচার্স ইনস্টিটিউট। আরও জানা যায়, আমেরিকা ও আফ্রিকায় অস্ত্র আমদানি কমলেও ভারত এবং সৌদি আরব আগের চেয়ে বেশি অস্ত্র কিনছে। এরপরই এগিয়ে আছে মিসর। সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে কোনো ঝুঁকি মোকাবিলায় জোটে যোগদান এবং অস্ত্রের আধুনিকায়ন এই মুহূর্তে আরও বেশি অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর থেকেই এ ধরনের উদ্বেগ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক উন্নত দেশ অস্ত্রের আমদানি ও উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের ঘোষণা দিয়েছে। এখানে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের ভেতর গত কয়েক বছর ধরে চলা প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা এবং এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য কিছু শক্তি।

যদি কোনো দেশ কোনো শক্তিশালী দেশ দ্বার আক্রান্ত হয় তখন অস্ত্রই হবে তা প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। ফলে বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে সামরিক খাতে। অথচ মানবিক দিক যেমন সবার জন্য খাদ্য নিশ্চয়তা, শিক্ষা বা চিকিৎসার মতো অতি মৌলিক এবং জরুরি বিষয়গুলোতে নজর দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিটি দেশেরই বহিঃশত্রম্নর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার থেকেই নিজেকে সুরক্ষার প্রচেষ্টা করে। হাইপারসনিক অস্ত্র ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধের সক্ষমতা নিয়ে সহযোগিতায় সম্মত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া। সে ক্ষেত্রে একদাগে বলা যায় যে, পৃথিবীর কাছে এখন মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের চেয়েও নিজেদের আধুনিক অস্ত্রের বড় বেশি দরকার! কিন্তু সত্যিই কি অস্ত্র দিয়ে পৃথিবী শেষ পর্যন্ত রক্ষা করা যাবে? সে প্রশ্নের উত্তরও একদিন বিশ্ববাসী নিশ্চয় পাবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে