দেশে শীতের আগমন ঘটেছে অনেক আগেই। শুরুতে শীত স্বস্তির থাকলেও এখন অবস্থা ভয়াবহ। কথায় আছে মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে। কিন্তু পৌষেই শীত যে কাঁপুনি তুলেছে তাতে মাঘের অবস্থা যে আরও বেশি ভয়াবহ হতে চলছে তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। শৈত্যপ্রবাহ আর ঘন কুয়াশায় শীতের প্রকোপটা বেড়েই চলছে। উত্তরাঞ্চলের অবস্থা আরও বেশি বেগতিক। এই অঞ্চলে রাতের তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে অবস্থান করে। উষ্ণ কাপড় আর মোটা লেপ-তোষকেও শীতকে মোকাবিলা করা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবার শীত ধনীদের জন্য আনন্দের হলেও এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ধনী থেকে মধ্যবিত্ত উভয়ের কাছেই শীত এখন অস্বস্তিকর বিষয়। যেখানে ধনী আর মধ্যবিত্তদের নাজেহাল অবস্থা সেখানে বস্ত্রহীন নিম্নবিত্ত আর পথশিশুদের কি অবস্থা ভেবে দেখেছেন কখনো?
ঢাকা শহরের ফুটপাত কিংবা রেল-লাইনে পথশিশুদের দেখা মেলে। কেউ পরিবার থেকে বঞ্চিত, কারো পিতা-মাতা বিকলাঙ্গ, কেউবা পরিচয়হীন। এই শিশুদের বসবাসের জন্য ব্যক্তিগত কোনো ঘর-বাড়ি নেই। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত- এরা পথেই কাটিয়ে দেয়। পথেই এদের বসবাস, পথ থেকেই এদের জীবিকা নির্বাহ হয়। অর্থ সাহায্য, ফুল বা খেলনা বিক্রি কিংবা ধনীদের গাড়ি পরিষ্কার করা অর্থ উপার্জনের মাধ্যম। যার পরিমাণটা অতি নগণ্য। এ অর্থে দিনে এক থেকে দু'বেলা খাবার জোটে। কখনো কখনো সারাদিন না খেয়েই কাটিয়ে দেয়। জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের তথ্য মতে, বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। আর বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, শুধু ঢাকাতেই ৬ লাখ পথশিশু রয়েছে। যারা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে।
পাঁচটি মৌলিক অধিকারের প্রথমটি হলো খাদ্য। যেখানে খাদ্যের জোগান দিতে তাদের হিমশিম খেতে হয় সেখানে শীত বস্ত্রের জোগান আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না। কনকনে শীতের রাতে আমরা যখন গা গরম করা লেপ-তোষকের নিচে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, ঠিক তখনও অসহায় এই পথশিশুদের কাঁটছে নির্ঘুম রাত। অপরাজেয় বাংলা সূত্র মতে, রাজধানীতে থাকা পথশিশুদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ শিশু শীতের রাতে উত্তাপের জন্য বিড়াল, কুকুরের ওপর নির্ভরশীল। আবার অনেকে ময়লা-আবর্জনা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া পস্নাস্টিকের শিট গায়ে জড়িয়ে শীতের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করে। আবার কেউ কেউ ছেড়া কাঁথা, পাটের বস্তা, কিংবা পাতলা কম্বল গায়ে দিয়ে বিভিন্ন মার্কেটের বারান্দা ও ফুটপাতে রাত্রি যাপন করে। যেখানে উষ্ণ মোটা লেপেও শীত আমাদের কাবু করছে সেখানে এই শৈত্য বাতাস প্রবাহিত খোলা স্থানে পাতলা চাদর কিংবা মোটা পলিথিন কতটা কার্যকর হতে পারে তা আমাদের বুঝার বাকি থাকে না। কিন্তু তারপরেও আমরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। খোঁজ রাখি না জীবন সংগ্রামে লড়ে যাওয়া এই পথশিশুদের।
ঢাকার বাহিরেরও একই অবস্থা বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের পথশিশুদের অবস্থা আরও বেশি ভয়াবহ। কারণ দেশের সব থেকে বেশি শীত অনূভূত হয় উত্তরাঞ্চলে। হিমালয়ের নিকটবর্তী অংশ হওয়ায় এখানে শীতের প্রকটতা অনেক বেশি। হিমালয় কন্যার নিশ্বাস ভেসে এসে হিম করে দেয় উত্তরের হাওয়া আর তাতেই শুরু হয় হাড় কাঁপানো শীত। ২০১৮ সালে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে ২.৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। উত্তরাঞ্চলের ছিন্নমূল মানুষ শীত থেকে রক্ষায় খড়-কাঠ পুড়িয়ে তাপ শোষণের চেষ্টা করে। কিন্তু এই তাপ হাড় কাঁপানো শীতের জন্য যথেষ্ট নয়।
অতিরিক্ত শীতের কারণে জ্বর, সর্দি-কাঁশি থেকে শুরু করে ডায়েরিয়াসহ নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এই শিশুরা। এমন পরিস্থিতিতে তাদের সেবা দেওয়ার মতো কেউ নেই। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য এই শিশুদের জন্য আলাদা কোন স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা নেই। সরকারি হাসপাতালগুলোতেও এরা তিরস্কারের শিকার হয়। ফলে প্রকৃত চিকিৎসার অভাবে মৃতু্য হয় পথেই।
সরকারিভাবে পথশিশুদের রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় ঠিকই কিন্তু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে এবং দুর্নীতির কবলে অনেক পদক্ষেপই ফলপ্রসূ হয় না। ছিন্নমূল মানুষদের জন্য বরাদ্দকৃত অংশ উপর মহলেই বণ্টন হয়ে যায়। বাকি যা দেওয়া হয় তা নামমাত্র ছাড়া আর কিছুই না। প্রতিবার দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে শীতবস্ত্র কর্মসূচির আয়োজন করতে দেখা যেত কিন্তু এবার সেই চিত্র চোখে পড়ছে না। দেশের কিছু যুব সমাজ ও স্বেচ্ছাচারী সংগঠনের উদ্যোগে শীতার্তদের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেলেও তার পরিমাণ যথেষ্ট নয়। তাই এই বিশাল সংখ্যার পথশিশুদের জীবন রক্ষায় আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। স্বউদ্যোগে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী পাশে দাঁড়াতে হবে। আক্ষরিক অর্থে ২০ কোটির মানুষের দেশে ১০ লাখ পথশিশুর জীবন রক্ষা করা কোনো কঠিন কাজ নয়। কয়েকজন স্বাবলম্বী মানুষ যদি একটি পথশিশুর পাশে দাঁড়ায় তাহলে অতি সহজেই পথ শিশুদের দুর্ভোগ লাঘব করা সম্ভব। সেই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের মানবিক হতে হবে। ছিন্নমূলের বরাদ্দ যেন সঠিকভাবে বণ্টন হয় সেই দিকে নজর দিতে হবে। এছাড়াও সরকারি উদ্যোগে পথশিশুদের আবাসনের ব্যবস্থা অতীব জরুরি। পরিশেষে একটি লাইন দিয়ে শেষ করতে চাই, মানুষের জন্মই মানব সেবার জন্য আর মানব সেবার মতো শান্তির অনুভূতি আর কিছুতে নেই।