মাদকের সহজলভ্য রোধ করা দরকার

জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মাদকের কালো থাবা থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে এখনই দরকার এর লাগাম টেনে ধরা।

প্রকাশ | ২০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

আরিফুল ইসলাম আকাশ
সর্বনাশা মাদকের ছোবলে প্রত্যহ ঝরে যাচ্ছে তরতাজা প্রাণ, ভেঙে যাচ্ছে সাজানো কুসুমিত সুন্দর সংসার, হরহামেশাই ঘটে যাচ্ছে হররোজ নানান অপরাধ। আমাদের প্রথমেই জানতে হবে মাদক কী? মাদক কারা সেবন করে? মাদকের ভয়াবহতা কী? মাদক সেবন কী রোধ করা আদৌ সম্ভব? মাদক কী? : মাদকাসক্তি কী? এটা জানতে হলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে আসক্তিটা আসলে কী। কোনো কাজ যখন আমার এমনই টানে পরিবর্তিত হয়, আমার স্বাভাবিক কাজ, দৈনন্দিন কাজ, শারীরিক বিষয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখনই আমরা বলি আসক্তি। যখন ওই কাজটা থেকে মানুষ সরে আসতে না পারে এবং দিন দিন সেটি বাড়াতে হয়, তখন একে বলা হয় আসক্তি। যে কোনো জিনিসের ক্ষেত্রে এটি হতে পারে। এটি হলো আসক্তির প্রথম কথা। এরপর আসি মাদকে, মাদক কী? মাদক দ্রব্য হলো এক প্রকার রাসায়নিক দ্রব্য যা গ্রহণে মানুষের স্বাভাবিক, শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব পড়ে এবং যা আসক্তি সৃষ্টি করে। মাদকদ্রব্য সেবনের ফলে তন্দ্রাচ্ছন্নতা, মেজাজ পরিবর্তন, মানসিক, আচ্ছন্নতা রক্তচাপ পরিবর্তন ইত্যাদি। মাদকদ্রব্য গ্রহণ করলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উলেস্নখযোগ্য নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে এবং দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীলতা সৃষ্টির পাশাপাশি দ্রব্যটি গ্রহণের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকে। ব্যক্তির এই অবস্থাকে বলে মাদকাসক্তি এবং যে গ্রহণ করে তাকে বলে মাদকাসক্ত। মাদকাসক্তি বলতে মাদকের প্রতি আসক্তিকে বোঝায়। বিভিন্ন ধরনের মাদক হতে পারে। আর মাদক হলো এক ধরনের ক্যামিক্যাল। সেটা যে কোনো ধরনের ক্যামিক্যাল হতে পারে। যেই ক্যামিক্যাল তার মনের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা, উদ্দীপনা তৈরি করে সাময়িকভাবে। পরে সেটি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং আসক্তিতে রূপান্তর হয়। তখন এটি মাদকাসক্তি হয়। মাদক কারা সেবন করে : একটি বেসরকারি হিসাব অনুসারে, বর্তমানে বাংলাদেশের মাদকাসক্ত রয়েছে ৭৫ লাখেরও বেশি। এদের মধ্যে ৮০ শতাংশ যুবক-যুবতী। ৪৩ শতাংশ বেকার, ৬০ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। ৪০ শতাংশ অশিক্ষিত, ৪৮ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং ৫৭ শতাংশ যৌন অপরাধী। (সূত্র : ইধহষধহবংি২৪) \হকৈশোরকালে মাদক ছড়ায় সবচেয়ে বেশি পরিমাণে। এই সময়টা জীবনের একটা উত্তরকালীন পর্যায়, এই সময়ে মনের মধ্যে নানারকম দুশ্চিন্তা ও হতাশা বাসা বাঁধে। এ সময় বন্ধুবান্ধবের চাপে ও প্রলভনে পড়ে অনেকে মাদক নেওয়া শুরু করে। মাদক প্রথম প্রথম কৌতূহলবসত সেবন করে- যা খুব একটা আসক্তি তৈরি করে না। বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবে এই বিশ্বাসে মাদক নেয়। আর নিজের অজান্তেই মাদকের ওপর তাদের নির্ভশীলতা তৈরি হয়। ডিপ্রেশন, মানসিক চাপ, বিষণ্ন্নতা ইত্যাদি কমাতেও মাদক সাময়িক সময়ের জন্য কাজে দেয়। মাদকাসক্তের বড় অংশ মানসিক চাপে পড়ে মাদক গ্রহণ শুরু করে। আর এভাবেই হাজার হাজার কিশোর-কিশোরীসহ নানা বয়সের মানুষ আটকে পরে মাদকের দুর্ভেদ্য জালে। কিছু কিছু মাদক মনোসংযোগ ঠিক রাখতে সাহায্য করে। স্কুল-কলেজের ছাত্ররা এসব মাদক গ্রহণ করে বেশি। নব্য কলেজে বা ভার্সিটিতে ওঠার পর নিজেকে স্মার্ট প্রমাণ করতে গিয়ে মাদক সেবন শুরু করে। তবে মাদক নিতে নিতে এক সময় দেখা যায় মাদক ছাড়া আর কাজে মন দিতেই পারছে না। মাদকের ভয়াবহতা: মাদকাসক্তিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্র্রতি মানসিক রোগের সঙ্গে চিহ্নিত করেছে এবং এর দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন বলে সুপারিশ করেছে। কেননা, মাদকাসক্ত ব্যক্তি মাদকের কাছে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। মাদক গ্রহণের পর রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে তার মস্তিষ্ক সেভাবে তৈরি হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে আমেরিকান অ্যাডিকশন সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা গেছে, চিকিৎসার পর ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে মাদকাসক্ত ব্যক্তি এক বছরের মধ্যে আবারও মাদকদ্রব্য ব্যবহার শুরু করেন। মাদকের কারণে স্বাস্থ্য খারাপ না হওয়া খুবই অস্বাভাবিক। মাদক সেবনে হতে পারে কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ, স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্তপাত, ফুসফুসে ক্যানসার, মুখে ক্যানসার, এমনকি হতে পারে এইচআইভি পর্যন্ত। গর্ভকালীন মায়ের মাদক সেবনে জন্মের পর সন্তান ঘঅঝ নামক জটিলতায় ভুগতে পারে। কিছু কিছু মাদকের কারণে গর্ভাবস্থায় সন্তানের মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। যার ফলে সন্তান অটিজমে ভুগতে পারে। দুগ্ধদানকালীন সময়ে কিছু কিছু মাদক দুধের সঙ্গে সন্তানের দেহে প্রবেশ করতে পারে। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে নেওয়া হয় বেশ কিছু মাদক। প্রতি ১০ জনে একজন এইডস রোগী ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে আক্রান্ত হন। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণে বেড়ে যায় হেপাটাইটিস -সি এর সংক্রমণও। মাদক গ্রহণ করেই গাড়ি চালানোর কারণে প্রতি বছর গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটে অসংখ্য। মাদকের প্রভাবে আমাদের প্রতিক্রিয়া কাল বেড়ে যায়। সামনে গাড়ি এলে তাকে এড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো একেবারেই উচিত নয় এবং এ কাজটি সম্পূর্ণ অবৈধ। মাদক সেবনের টাকার জোগানের জন্য চুরি, ছিনতাই, মারামারি এমনকি ভাড়াটে খুনির মতন নানান অপকর্মের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে প্রত্যহ। মাদকের টাকার জন্য তারা যে কোনো কাজ নির্দ্বিধায় সহজ সাবলীল, মামুলিভাবে করে ফেলতে পারে। মাদকের ভয়াবহতা এতই বেশি যে, মাদক সেবীর আশপাশে থাকা মাশুষও মাদক সৃষ্ট অসুস্থতা থেকে বাঁচতে পারে না। অন্যের সেবন করা মাদকের ধোঁয়া যদি আপনি গ্রহণ করেন, তখন তাকে বলা হয় পেসিভ স্মোকিং (চধংংরাব ঝসড়পশরহম)। পেসিভ স্মোকিং এর ফলে শিশুদের ব্রঙ্কাইটিস, এজমা, এমনকি নিউমোনিয়াও পর্যন্ত হতে পারে। মাদক সেবন রোধ করা কী আদৌ সম্ভব : একজন তরুণ-তরুণী যখন মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে তখন তথাকথিত এই সমাজ তাদের অপরাধী বলে চিহ্নিত করে। একজন কিশোর যখন মাদকের টাকা জোগাড়ের জন্য অপকর্ম করে বেড়ায় তখন আপাতদৃষ্টিতে অপরাধী মনে হলেও সে তখনও নির্দোষ। একজন কিশোর মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার ক্ষেত্রে তার থেকে তার পরিবারের ভূমিকাই মুখ্য। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মাদকে জড়িয়ে পড়া সিংহভাগ কিশোরা-কিশোরীরাই পিতামাতার থেকে যথেষ্ট সময় না পেয়ে অবসাদে ভুগে। এক সময় জড়িয়ে পড়ে মাদকের দুর্ভেদ্য জালে। মাদক সহজলভ্য হয়ে ওঠেছে ক্ষমতাশীল সরকারের স্থানীয় নেতাকর্মীর মদতে বা তারা নিজেরাই গড়ে তুলতেছেন মাদকের অবৈধ সম্রাজ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানের পরও ধমাতে পারছে না মাদকের সহজলভ্য বিক্রয়। কারণ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এর সঙ্গে জড়িত থাকায় ওপর মহল হতে অভিযানে বাধা প্রদান করা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা সন্তোষজনক হারে আগাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে আবার কেউ কেউ জড়িয়ে যাচ্ছেন অনৈতিক, অবৈধ প্রলোভনে। জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মাদকের কালো থাবা থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে এখনই দরকার এর লাগাম টেনে ধরা। অন্যত্থায় ভবিষ্যতে এটি খুব ভয়াবহ রূপ নেবে। পরিবারগুলোকে হতে হবে সন্তান গড়নে মনোযোগী। আপনার সন্তান কখন বাসা থেকে বের হলো, কোথায় কোথায় গেল, কার কার সঙ্গে মিশলো। স্কুল- কলেজ ফাঁকি দিয়ে কোনো অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে কিনা। সমাজের সচেতন মহলকে হতে হবে আরো উদ্যাগী। মাঠ প্রশাসনকে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অনড় অবস্থান নিতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের ক্যাম্পেই করে জানাতে হবে মাদকের ভয়াবহ পরিণাম, প্রয়োজনে স্কুলে-স্কুলে, কলেজে ক্যাম্পেইন করতে হবে। স্থানীয় সরকারকে সমাজ গড়নে আরো সুদৃষ্টি দিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হতে হবে আরো তৎপর স্কুল-কলেজের সামনে, মহলস্নার অলিগলিতে, পার্কে, ব্রিজে কেউ দল পাকিয়ে কিংবা চোরাগোপ্তাভাবে লুকিয়ে কেউ মাদক সেবনে জড়িয়ে পড়ছে কিনা সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। যদি এভাবে সমাজের সব শ্রেণিপেশার মানুষ এক সঙ্গে মাদকের বিরুদ্ধে আপসহীন হয়, তবেই সম্ভব মাদকের সহজলভ্যতা দূর করা। আরিফুল ইসলাম আকাশ : নবীন লেখক