দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেক আলেচনা-সমালোচনার পর গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে এবং দলীয় সরকারের অধীনে টানা তৃতীয়বারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা লক্ষ্য করা যায়নি। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে আওয়ামী লীগ এবার কৌশলে নিজ দলের অনুসাীদের ভেতরে স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। তবে এই নির্বাচন নিয়ে বিদেশি পর্যবেক্ষক দল এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
যখন বিএনপি নির্বাচন বর্জন ঘোষণা করল এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা করা হয় তখন জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল পাঠানো থেকে বিরত থাকে। এছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোও একই নীতি অনুসরণ করে। ফলে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তাদের মতামত তুলে ধরে।
গত ১০ জানুয়ারি সংসদ ভবনে নবনির্বাচিত সাংসদরা শপথ গ্রহণ করেছেন কিন্তু সংসদে এখনো বিরোধী দল গঠন হয়নি। কারণ নির্বাচনের পূর্বেই বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে গত ১১ জানুয়ারি ২৫ জন মন্ত্রী ও ১১ জন প্রতিমন্ত্রী বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ করেছেন।
বাংলাদেশ সংবিধানের চতুর্থ ভাগের ২য় পরিচ্ছেদের ৫৫(১) ধারায় বলা আছে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি মন্ত্রিসভা থাকিবে এবং প্রধানমন্ত্রী ও সময়ে সময়ে তিনি যেরূপ স্থির করিবেন, সেইরূপ অন্যান্য মন্ত্রী লইয়া এই মন্ত্রিসভা গঠিত হইবে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে ২২৩টি আসনে, জাতীয় পার্টি (জাপা) ১১ আসনে এবং জাসদ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি একটি করে আসনে জয়ী হয়েছে। আর ৬২টি আসনে জয়ী হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচিত সব প্রতিনিধিরাই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের এমনকি নির্বাচিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের অনুসারী এবং সংসদে আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলবেন বলে তারা মতামত দিয়েছেন। তবে এই যে একদলীয় ব্যবস্থাপনা ও বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন এটা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। কারণ গণতন্ত্র হলো একসঙ্গে কাজ করা, একসঙ্গে চলা। গণতন্ত্র হলো জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা ও ভাবধারার প্রতিফলন। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব একসঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক নয়। বাংলাদেশে সবসময়ই গণতন্ত্র অবহেলিত। গণতন্ত্রের সংকট সবসময়ই বিদ্যমান ছিল। কারণ ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের সেই সময়টা ছিল জঙ্গিবাদ, খুন, হত্যা, সন্ত্রাসের শাসন। নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, এক যোগে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা, আওয়ামী নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করতে ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্রের চোরাচালান, আদালতে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের দ্বারা বিচারক হত্যা ইত্যাদি। এগুলো কখনোই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কর্মকান্ড হতে পারে না।
নব্বইয়ের স্বৈরাচার শাসকের পতনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র টেকসই হওয়ার কথা ছিল। এছাড়া ১৯৯১ সালের নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠত হয়। পরপর তিনটি নির্বাচনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। ২০১১ সালের ১০ মে বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় দেয়। এছাড়াও বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করা হয়। এরপর থেকে দলীয় সরকারের অধীনে টানা তৃতীয়বারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো কেউ কারো অধীনে নির্বাচন করতে ইচ্ছুক নয়।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ১৯৯৯ সালে তার লেখা ডেভেলপমেন্ট অ্যাজ ফ্রিডম বইয়ে লিখেছেন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য ও গোত্রে গোত্রে সংঘাত এড়ানো এবং দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছানোর জন্য কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক। তিনি লিখেছেন, গণতন্ত্রে ঘাটতি রেখে দেশের টেকসই উন্নয়ন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে জরুরি উপাদান হলো বিশ্বাসযোগ্য, গ্রহণযোগ্য ও সর্বজনগৃহীত নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজনীতিবিদের চেয়ে ব্যবসায়ীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি- যা অন্যান্য বারের তুলনায় এবার রেকর্ড সংখ্যক। বিদায়ী সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল ১৮২। তবে সব রেকর্ড ভেঙেছে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন। আগামী ১২তম জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়ে হবে অন্তত ১৯৯ জন- যা মোট সংসদ সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশ। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য যারা কাজ করছেন, তারা মনে করেন জাতীয় সংসদে ও রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের এই ক্রমবর্ধমান আধিপত্য রাজনীতিতে রাজনীতিবিদদেরই কোণঠাসা করে ফেলছে। তাদের মতে, সংসদের মৌলিক চরিত্রই এর ফলে পরিবর্তিত হচ্ছে এবং ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার 'নীতিকাঠামো দখল' করছেন নিজেদের 'অর্থসম্পদ ও ব্যবসা বিকাশের' স্বার্থে। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে যে বিনিয়োগ করছেন, তা করছেন মূলত নিজেদের সম্পদ আরও বাড়ানোর জন্য। মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রার্থীরা যে হলফনামা দিয়েছেন, তা বিশ্লেষণ করে নাগরিক অধিকার সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) জানায়, নির্বাচনে ১ হাজার ৯৪৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ১ হাজার ১৪২ জনই ছিলেন ব্যবসায়ী (৫৮ দশমিক ৭১ শতাংশ)। আওয়ামী লীগের ২৬৫ জনের মধ্যে ১৭০ জন, জাতীয় পার্টির ২৬২ জনের মধ্যে ১৭৩ জন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ৪৩৩ জনের মধ্যে ৩০২ জনই ব্যবসায়ী। সুজনের তথ্য ও নির্বাচন কমিশনের প্রকাশ করা বিজয়ীদের বেসরকারি তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৯৮ আসনে বিজয়ীদের মধ্যে ব্যবসায়ী ১৯৪ জন। তার মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৪৫ জন, জাতীয় পার্টির ৯ জন, জাসদের ১ জন, কল্যাণ পার্টির ১ জন এবং স্বতন্ত্র ৩৮ জন রয়েছেন। সুজনের তালিকার বাইরে আরও অন্তত ৫ জন ব্যবসায়ী নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন বলে প্রথম আলোর বিশ্লেষণে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে ৪ জন আওয়ামী লীগের ও ১ জন স্বতন্ত্র। সব মিলিয়ে অন্তত ১৯৯ জন ব্যবসায়ী এবার জাতীয় সংসদে সদস্য হিসেবে বসতে যাচ্ছেন। এর বাইরে নির্বাচিত যে ৪০ জন নিজেদের রাজনীতিবিদ ও কৃষিজীবী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন, তাদের মধ্যে অনেকের মূল পেশা ব্যবসা। দেশের প্রথম সারির একটি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়, স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকে জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। আইন প্রণেতা হিসেবে ব্যবসায়ীদের এই উত্থানের ফলে সংসদে অন্য পেশা থেকে আসা জনপ্রতিনিধির সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমেছে। আবার কিছু রাজনীতিবিদ রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসাও করছেন। আইনপ্রণেতা হিসেবে ও দেশের রাজনীতিতে আইনজীবীদের এক সময় দাপট ছিল। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে বড় সংখ্যায় তাদের ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। তবে গত ৩০ বছরে বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনজীবীদের অংশগ্রহণ কমেছে, বেড়েছে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ। দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) তথ্যানুযায়ী, ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী ছিলেন ১৮ শতাংশ আর আইনজীবী ৩১ শতাংশ। যদিও রওনক জাহান তার 'বাংলাদেশ পলিটিকস : প্রবলেমস অ্যান্ড ইসু্যজ' বইয়ে লিখেছেন, প্রথম জাতীয় সংসদে ২৮৩ আসনের মধ্যে সাড়ে ২৫ শতাংশ আইনজীবী, ২৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী, ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ কৃষক, শিক্ষক ৯ দশমিক ৮৯ এবং ১২ দশমিক ৩৬ শতাংশ রাজনীতিবিদ ছিলেন।
সুজন ও টিআইবির তথ্য বলছে, ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদে ব্যবসায়ীদের হার বেড়ে ৩৮ শতাংশ হয়। আর ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী ৩০০ জন সদস্যের মধ্যে ৬২ শতাংশই ছিলেন ব্যবসায়ী। বাকিদের মধ্যে আইনজীবী ১৪ শতাংশ, কৃষিজীবী ৪ শতাংশ এবং রাজনীতিবিদ ছিলেন ৭ শতাংশ।
কোভিড মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনীতি কঠিন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছে, দ্রব্যমূল্য সব মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, কর্মসংস্থান বাড়ানোসহ ১১টি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হবে। যার মধ্যে রয়েছে ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানো, বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে নিশ্চয়তার জন্য আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে ভারসাম্য রক্ষা, খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং এ ক্ষেত্রে ব্যাংক যাতে বিধি নির্ধারিত সঞ্চিতি রাখে, তা নিশ্চিত করা। ইশতেহার ঘোষণার অনুষ্ঠানে দুর্নীতি দমনে সরকারের অঙ্গীকারের কথাও তখন তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আগে সংস্কার আনা জরুরি। রাজনীতি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে যোগসূত্র গড়ে উঠেছে, সেটার সুবিধা নিচ্ছেন কিছু ব্যবসায়ী। রাজনীতি বা সংসদে ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী হওয়ার কারণে তারা নিজেদের সুবিধার জন্য নীতি তৈরি করছেন। ফলে এখন যারা ব্যবসা-বাণিজ্যে সিন্ডিকেট করছেন, কিংবা ব্যাংকে অনিয়ম করছেন বা ব্যাংক দখল করছেন, তাদের ধরা যাচ্ছে না। তারা রাজনীতিতে প্রভাবশালী হওয়ার কারণে তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো সংস্কার করা যাচ্ছে না।' দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আরও একবার আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে।
রাজনীতি কাদের জন্য, তা নিয়ে দলের মধ্যেই আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। দল যদি মনে করে যে রাজনীতি রাজনীতিবিদদের জন্য, তাহলে সংস্কার করতে হবে। এই কাজ রাজনীতিবিদদের করতে হবে। নিজেদের স্বার্থে, দলের স্বার্থে ও গণতন্ত্রের স্বার্থে তাদের আয়নার সামনে দাঁড়াতে হবে।
অন্যদিকে অর্থনীতিতে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা মোকাবিলায় বড় ধরনের রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন হবে। আগামী দিনে অনেক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ আসবে। আমাদের কঠিন সংস্কারের পথে যেতে হবে। এটা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে ভূমিকা নিতে হবে। আমাদের এখানে দৃশ্যমান উন্নয়নের কথা বলা হয়। কিন্তু আমরা কিছু দৃশ্যমান সুশাসন দেখতে চাই। গণতান্ত্রিক জবাবদিহি দেখতে চাই।'
জুনায়েদ খান : নবীন লেখক