পথশিশুদের সমাজের সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা জরুরি
যখন আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখছি, তখন সেই স্বপ্ন পূরণ করতে হলে আমাদের এই বিপুল পথশিশুকে অবশ্যই লেখাপড়ায় নিয়োজিত করা এবং তাদের আর দশটা শিশুর মতোই বড় করে দেশের কাজে লাগাতে হবে।
প্রকাশ | ১৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
অলোক আচার্য
উন্নত দেশের শর্তের অন্যতম হলো দেশের শিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। কোনো শিশু রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুল বিক্রি করবে না, ভিক্ষা করবে না, পথের ধারে পলিথিনে মুখ দিয়ে নেশা করবে না, রিকশা-ভ্যান ঠেলবে না, লেগুনা বা বাসে কাজ করবে না, হাতে ফুল নিয়ে বড়লোকের গাড়ির কাঁচের সামনে ফুল কেনার আকুতি করবে না, বাদাম বা চানাচুর নিয়ে গলা উঁচু করে ক্রেতা ডাকবে না, ওয়েল্ডিং মেশিন ধরবে না। শিশুর কাঁধে থাকবে স্কুলব্যাগ, ব্যাগের ভেতর বই, মুখে থাকবে হাসি, পেটে ক্ষুধা থাকবে না এমন একটি চিত্রই হলো দেশের শান্তি এবং উন্নয়নের চিত্র হবে। আমরা যে উন্নত দেশের দিকে অগ্রসর হচ্ছি- সেই দেশটা এমনই হবে। সেটা গড়ে তোলার দায়িত্ব সবার। কারও একার না। পরিবারের, সমাজের এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের। শিশুরা ফুলের মতো পবিত্র। তবে সব ফুল সুসজ্জিত বাগানে থাকার সৌভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসে না। এদের ঠাঁই হয় রাস্তায়। মাথার ওপরের নীল আকাশই তাদের একমাত্র ঠিকানা। তারা বড় হয় নোংরা পরিবেশে। সমাজের আর দশটা শিশুর মতো বেড়ে ওঠার সুযোগ তারা পায় না। এদের-ই নাম পথশিশু। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের দেখা মেলে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল, স্বল্পন্নোত বা অনুন্নত দেশগুলোতে এদের দেখা বেশি মেলে। আমাদের দেশেও চারদিকে এ ধরনের শিশুর দেখা মেলে। এই ফুলগুলো অত্যন্ত অবহেলা-অযত্নে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। এদের নিয়ে অনেক সংগঠন, সংস্থা কাজ করে। কিন্তু তাদের জীবনমান খুব বেশি উন্নত হয় না। রাস্তা, ফুটপাত যাদের ঠিকানা। বড়লোকের আহ্লাদে বড় হয়ে ওঠা শিশুদের পাশাপাশি এরাও বড় হয়। অভাব যাদের জীবনে নিত্যসঙ্গী। খোলা আকাশ যাদের মাথার ওপর ছাদ হয়ে থাকে। জন্মের পরপরই তারা পৃথিবীর এক অন্যরকম চিত্র দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠে। ধনী গরীবের ব্যবধান তারা জন্মের পরেই দেখতে পায়। এসব ভাগ্যহীন, পরিচয়হীন শিশুদের আমরা কখনো টোকাই, কখনো পথকলি, ছিন্নমূল বা পথশিশু বলে ডাকি। পথই যাদের আপন,পথই যাদের চূড়ান্ত ঠিকানা। যাদের জন্ম হয় পথে অথবা জন্মের পর ঠাঁই হয় পথে আর জীবন পার হয় পথে এবং শেষও হয় সেই পথেই। এরা পথশিশু। যাদের জন্য সমাজের, রাষ্ট্রের, সুশীল সমাজের আমাদের সবার দায় রয়েছে। এসব পথশিশুরা বঞ্চিত হয় রাষ্ট্র প্রদত্ত মৌলিক অধিকার থেকে। এরা অনেকেই শিক্ষা লাভ করার সুযোগ পায় না, পুষ্টিকর খাদ্য পায় না, পোশাক বা মাথার নিচে ছাউনি পায় না। যদিও রাষ্ট্র থেকে এদের জন্য বিভিন্ন সময় নানারকম পদক্ষেপ নেয়া হয় তবে তা পর্যাপ্ত নয়। কারণ প্রতিনিয়তই এই ধরনের পথশিশুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
জাতিসংঘ শিশু সনদে বর্ণিত ঘোষণা অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সি সবাই শিশু। সে অনুযায়ী আমাদের দেশের একটি বড় অংশই শিশু। দারিদ্র্যতামুক্ত দেশ সব দেশের জন্য কাম্য একটি অবস্থা। বাংলাদেশও ধীরে ধীরে দারিদ্র্যতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি এতটা সহজ নয় যে, হঠাৎ করে কোনো পরিবর্তন সম্ভব। আমাদের সামনে এখনো অনেক বাধা রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো শিক্ষা। শিক্ষার হার বাড়ছে। আমরা শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করেছি। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য এখনো অনেক দূর। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাতে পারে না। এসব পথশিশুকেও আমাদের শিক্ষার আওতায় আনতে হবে। এই কঠিনতম কাজটি আমাদের করতে হবে। আমাদের দেশে ঠিক কত সংখ্যক পথশিশু রয়েছে সে হিসাব করা কঠিন কাজ। তবে সাম্প্রতিক এক জরিপ মতে, দেশে পথ শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে- যা দুশ্চিন্তার। ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর 'সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন-২০২২' শীর্ষক জরিপ প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুসারে, জরিপে রাস্তাঘাটে বসবাসকারী শিশুদের মোট সংখ্যা না থাকলেও ইউনিসেফ বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ সংখ্যা ১০ লক্ষাধিক হতে পারে। এসব পথশিশুর ওপর ভয়াবহ নির্যাতনও হয়। এদের অনায়াসে নির্যাতন করা যায়- কারণ প্রতিবাদ করার কেউ নেই! তাদের অধিকার নিয়ে কথা বললেও সেই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। অথচ মেধাবীর জন্ম কেবল ধনীর বাড়িতেই হয় না, এসব পথের শিশুদের মাঝেও থাকতে পারে। কিন্তু একটি ফলবান গাছ যেমন যত্ন না নিলে তার ফল দেওয়ার ক্ষমতা হারায় তেমনি এসব শিশুও মেধা থাকলেও তা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় না। গ্রাম-বাংলা উন্নয়ন কমিটি'র ২০২২ সালে ঢাকা ও বরিশালের মধ্যে চালানো জরিপের তথ্যে জানা গেছে, পথশিশুদের ওপর সহিংসতার চিত্র ভয়াবহ। ৭৯ শতাংশ পথশিশু জীবনের কোনো একপর্যায়ে মানসিক, শারীরিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। শুধু শারীরিক নির্যাতনের শিকার ৬২ শতাংশ পথশিশু। দৈনিক গড়ে ১০ ঘণ্টা ভিক্ষা করে একটি পথশিশু। ৯৫ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধরনের শিক্ষা গ্রহণ করছে না। ৩৫ শতাংশ শিশু ভিক্ষা করার কথা স্বীকার করেছে। ৪২ শতাংশ শিশু রাস্তায় বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো প্রকাশিত পথশিশু জরিপ-২০২২ এর চিত্র অনুযায়ী, প্রধানত ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ পথশিশু দারিদ্র, ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ বাবা মা শহরে আসার কারণে এবং ১২ দশমিক ১ শতাংশ কাজের সন্ধানে বাড়ি ছেড়ে শহরে এসেছে।
এসব অধিকারবঞ্চিত শিশুকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে তুলতে চাই উপযুক্ত শিক্ষা ও পরিবেশ। সঠিক পরিবেশ আর অযত্ন অবহেলায় যেন তারা শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় সে বিষয়ে যুগোপযুগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে যেসব ভাসমান শিশুদের অবস্থান তাদের জন্য সমন্বিতভাবে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। রাজধানী ঢাকায় পথশিশুর সংখ্যা বেশি এবং এসব পথশিশুর জীবন ও জীবিকা নির্বাহ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এদের অসহায়ত্তের সুযোগ নিয়ে নানা অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করছে সুযোগসন্ধানী মানুষ। একটু ভালো থাকার আশায় না বুঝেই সেসব কাজে জড়িয়ে যাচ্ছে এসব পথশিশুর অনেকেই। তাদের সামনে তো ভালো থাকার বিকল্পও নেই। এভাবে ছোট ছোট অপরাধ থেকে বড় কোনো অপরাধে জড়িয়ে পরাটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে এসব পথশিশুকে বেছে নিচ্ছে মাদক কেনা বেচায়। আমাদের বুঝতে হবে প্রতিটি শিশুই তার মেধাশক্তি নিয়ে জন্ম নেয়। শিশুদের মধ্যেই সুপ্ত থাকে প্রতিভা। তারাই হবে দেশ ও জাতির কান্ডারি। এসব শিশুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে কোনো বৈমানিক, বিজ্ঞানী, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক বা চিকিৎসক। পরিবেশ পরিস্থিতিতে কারো মেধাশক্তি বিকশিত হয় আর কারো বিকশিত হয় না বা হওয়ার সুযোগ পায় না। এই মেধাশক্তি যদি নেতিবাচক কোনো কাজে ব্যবহার করে তাহলে সেটা সমাজের জন্য ভয়ংকর হয়ে ওঠে। তাদের কাজে লাগাতে হলে তাদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। কেবল দারিদ্র্যতার কারণেই পথশিশু বাড়ছে না বরং এর পেছনে আরও অনেক কারণ রয়েছে। পরিচয়হীন, ঠিকানাবিহীন শিশুদেরও আশ্রয় হচ্ছে পথে। বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এসব শিশু পেটের ক্ষুধা মেটাতে নানারকম কাজ বেছে নেয়। এসব কাজের মধ্যে রয়েছে হকার, শ্রমিক, রিকশাচালক, ফুল বিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, হোটেল শ্রমিক, বুনন কর্মী, কুলি, বিড়ি শ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক ইত্যাদি বিভিন্ন রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ- যা আমরা আমাদের চারদিকে তাকালেই এর বাস্তবতা টের পাই। কেবল পেটের ক্ষুধা মেটানোই এদের কাছে মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এদের মধ্যে অনেকেই তাই একটু ভালোভাবে বাঁচার আশায় না বুঝেই অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে পরে। আমরা যদি তাদের জন্য ভালোভাবে বাঁচার সুযোগ রাখি তারা নিশ্চয় অপরাধীদের কথায় প্রভাবিত হবে না। সমাজ থেকে অপরাধের মাত্রা অনেকটা কমে আসবে।
পথশিশুদের জীবন অত্যন্ত কষ্টের ও নির্মম। সমাজের নিষ্ঠুর সত্যের সঙ্গে এরা বাস করে। আরাম আয়েশের ঠিক উল্টো দিকে এদের বসবাস। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্য খাওয়া ও এরকম স্থানে ঘুমানোর কারণে তারা প্রায়ই নানা রোগে আক্রান্ত থাকে। অথচ চিকিৎসার সুযোগ নেই বললেই চলে। মেয়ে শিশুরা দালালচক্রের খপ্পরে পরে যৌনকাজে বাধ্য হচ্ছে। ফলে তারা নানারকম যৌন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এক সময় এরা ভাসমান যৌনকর্মী হিসেবে রোজগারের পথ করে নিচ্ছে। অথচ সমাজে এদেরও একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন ছিল। বাংলাদেশে পথশিশু সংখ্যা যাই হোক না কেন- তা দেশের প্রকৃত উন্নয়নের অন্তরায়। একটা বিরাট অংশ যদি অযত্ন আর অবহেলায় বেড়ে ওঠে তাহলে দেশের প্রকৃত অগ্রগতি ধীর গতির হবে। পথশিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পুষ্টিকর খাদ্য ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা দিতে হবে। আটকাতে হবে তাদের বিপথে যাওয়া থেকে। সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যেন কেউ না জড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পথশিশুর শিক্ষায় অনেক বেসরকারি সংস্থাও কাজ করছে। তবে তা অপর্যাপ্ত। বিভিন্ন কারণে ঢাকা শহর ছাড়াও অন্য বিভাগীয় শহরগুলোতে ভাসমান শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। তবে রাজধানীতে এই সংখ্যা বেশি, কারণ বেঁচে থাকার সুযোগ এখানেই বেশি। এসব পথশিশুদের সমাজের সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রের পাশাপাশি নাগরিক হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। সবাইকে সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে।
যখন আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখছি, তখন সেই স্বপ্ন পূরণ করতে হলে আমাদের এই বিপুল পথশিশুকে অবশ্যই লেখাপড়ায় নিয়োজিত করা এবং তাদের আর দশটা শিশুর মতোই বড় করে দেশের কাজে লাগাতে হবে।
অলোক আচার্য : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক