সরকারের প্রথম উদ্যোগ হোক নিত্যপণ্যের লাগাম টানা
ছোট্ট দেশ। জনসংখ্যাও বেশি। মানুষ বাড়ছে। চাহিদাও বাড়ছে। ফলে আমদানি বেশি করতে হচ্ছে। ডলার সংকটে আমদানির ওপর প্রভাব ফেলছে। ফলে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছেন। অথচ এসব পণ্য আমাদের দেশে উৎপাদন করা যায়।
প্রকাশ | ১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শহীদুল ইসলাম শুভ
নিত্যপণ্যের দাম দিন দিন আকাশচুম্বী হয়ে উঠছে। নিত্যপণ্যের দাম আগেও বেড়েছ, কিন্তু সপ্তাহে সপ্তাহে নয়। রাতারাতি চোখে পড়ার মতো দাম হয়নি। একটা সময়ে নির্ধারিত পরিমাণে বেড়েছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের নতুন বছরেও যে চড়া দাম তা নিতান্তই দুঃখজনক। কেউ নেই দেখভালের জন্য। ব্যবসায়ীরাও ঝুপ বুঝে কোপ মারছে। তারা সুযোগ সন্ধানী। সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। ফলে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সব স্তরের মানুষ বাজার দর দেখে অবাক হয়ে যায়। রাতারাতি একটা পণ্যের দাম এত বাড়তে পারে তা নিজ চোখে না দেখলে কেউ হয়ত-বা বিশ্বাস করবে না। ব্যবসায়ীরা পারে জোট বেঁধে দাম বাড়াতে। কিন্তু জোট বাঁধতে পারে না সাধারণ মানুষ। পারে না নিত্যপণ্যকে বয়কট করতে। কারণ এগুলো আমাদের জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। ফলে, দাম বাড়লেও চোখ বন্ধ করে বেশির জায়গায় অল্প করে হলেও কিনতে হয়।
নির্বাচন এলে সরকারকে এক বেকায়দায় পড়তে হয়। সবার কথা রাখতে হয়, শুনতে হয়। এই সময় যে কাউকে কঠো কথা বলা, বা কারো বিরুদ্ধে সত্যটাও বলা যায় না। যাদের কথা সরকারকে শুনতে হয়, তাদের মধ্যে একটা শ্রেণি হলো ব্যবসায়ী। নির্বাচনের সময় তারা সরকারের কাঁধে চড়ে বসে। দেশে বিশৃঙ্খলা হওয়ার ভয়ে কিছুটা হলেও তাদের কথা রাখতে হয়। সরকারও নিজের পক্ষে ভোট থাকার জন্য কিছু সুবিধা দেয় ব্যবসায়ীদের। যে সুবিধা সরকার দেয় এবং নেয় ব্যবসায়ীদের থেকে, মধ্যে থেকে ভোগান্তি হয় সাধারণ মানুষের। তারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে নেয়। সাধারণ মানুষ হয় বলির পাঁঠা। তারা অসহায়ের মতো চেয়ে থাকে। বোবা হাসি হাসে। প্রহসন দেখে। মুখে হাসি থাকলেও ভেতরে ভেতরে আর্তচিৎকার তাকে তিলে তিলে মারে। সংসারের খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হয়। ফলে তাকে বাড়তি আয়ের জন্য ভিন্ন কাজ করতে হয়। শুধু বাড়তি কাজই নয়, কিছু টাকা আয়ের জন্য খাবারের তালিকা এবং খাবারের পরিমাণও কমিয়ে দেয়।
যে-ই বাজারমূল্য একদিন আগেও যে দাম ছিল একই বাজারমূল্য পরের দিন দিগুণ হয় কীভাবে? দেশে কি কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত, নাকি কোনো দুর্যোগ চলছে। দুর্যোগ বা যুদ্ধ বিধ্বস্ত হলেও মানবতায় এত চড়া মূল্য হয় না। ভারত রপ্তানি না করলে কি দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে? মানুষ না খেয়ে থাকবে? আমাদের দেশ খাদ্যের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পথে। কিন্তু আজও নিত্যপণ্য ও মসলা জাতীয় পণ্যগুলোর উৎপাদন দেশে তেমন দেখা যায় না। ফলে আমদানির ওপর ভরসা রাখতে হয়। তাই বলে এত চড়া দামে বিক্রি করা কতটা যুক্তিযুক্ত। নির্বাচন এলে সরকার একটু সুযোগ নেওয়ার জন্য এত বড় বড় অন্যায়গুলো আশ্রয় না দিলেও পারে। এতে করে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ সরকারের ওপরও পড়ে।
মসলা আমাদের জীবনে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তরকারির মধ্যে মসলা না দিলে তরকারি হয় না। সেই তরকারি খাওয়ার উপযুক্তও হবে না। কিন্তু এই মসলা এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবী, উচ্চ শ্রেণির লোকরা কিছুটা খেতে পারলেও খেটে খাওয়া মানুষের কাছে মসলা ক্রয় করা এখন বিলাসিতা। তরকারির জন্য মসলা কিনে আনা একজন শ্রমিকের পক্ষে এখন সম্ভব হয় না।
চাল, ডাল, তৈল এগুলো তো উচ্চমূল্যই। মাছ, মাংস ও সবজিও উচ্চমূল্য। সঙ্গে মসলা- পেঁয়াজ, রসুন, এলাচি, লবঙ্গ, আদা, হলুদ, দারুচিনি, জিরা, ধনিয়া, তেজপাতা, শুকনো মরিচ ইত্যাদির চড়ামূল্য। অথচ এগুলো একটা পরিবারের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
টিসিবি (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) বাজারের তালিকানুযায়ী বাজারে মসলার কেজি প্রতি যে দাম বেড়েছে তা চোখ কপালে উঠার মতো। এক বছরে মসলার দাম দিগুণ হয়েছে। অথচ গত বছর থেকে অর্থবছরের আমদানিও বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানিকৃত মসলার পরিমাণ ১ লাখ ৪৬ হাজার টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানিকৃত মসলার পরিমাণ ১ লাখ ৭৬ হাজার টন। তাও আবার পেঁয়াজ, রসুন ও আদা বাদে। এত বেশি আমদানি করেও পূর্বের তুলনায় দাম এত বেশি! গত বছর মসলাট দাম সহনীয় পর্যায়ে ছিল। যদিও এ বছরের তুলনায় আমদানি কম ছিল। গত বছর জিরা প্রতিকেজি ছিল ৫০০-৫৭০ টাকা। বর্তমান মূল্য ৯৫০-১১০০ টাকা। শতকরা বৃদ্ধি পেয়েছে ৯২%। ছোট এলাচ গত বছর ছিল ১৬০০- ২৮০০ টাকা। বর্তমান বাজার মূল্য ২২০০-৩০০০ টাকা। যা শতকরা ১৮% বৃদ্ধি। লবঙ্গ প্রতিকেজি গত বছর ছিল ১৩০০-১৪০০ টাকা। বর্তমানে ১৭০০-১৮০০ টাকা। ধনে ১৩০-১৬০ টাকা কেজি ছিল। বর্তমানে ২৩০-২৬০ টাকা। এমন মূল্যবৃদ্ধি হলে মানুষ কী করে তরকারি রান্না করবে? শ্রমিক কি পারবে তার উপার্জন দিয়ে ভালোমন্দ খেতে। কিংবা কোনো আত্মীয়কে আপ্যায়ন করতে? যেখানে দেশি পেঁয়াজ কেজি প্রতি ৩০-৪০ টাকা হওয়ার কথা, (গত বছর ছিলও) সেই দেশি পেঁয়াজ কেজি প্রতি ৮০/৯০-১০০ টাকা। রসুন (বিদেশি) আগে ছিল ১১০-১৩০ টাকা এখন এটার বাজার ধর ২২০ -২৬০ টাকা। আদা (বিদেশি) আগে ছিল ৯০-১৫০ টাকা, বর্তমানে ২০০-২৫০ টাকা। পেঁয়াজ, রসুন, আদা ছাড়া কি কোনো তরকারি কল্পনা করা যায়? অথচ এগুলোর দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। শুধু আদা, রসুন, পেঁয়াজ, এলাচ, জিরাই নয়, বাড়তি শুকনো মরিচ (দেশি), হলুদ (দেশি) দারুচিনি, ইত্যাদি।
শুকনো মরিচ গত বছর ছিল ৩৭০-৪০০ টাকা বর্তমানে ৩৯০-৪৫০ টাকা। হলুদ ছিল ২২০-২৫০ টাকা, বর্তমানে ২৮০-৪৫০ টাকা। দারুচিনি ছিল ৪৩০-৫২০ টাকা- যা বর্তমান বাজার দাম ৪৫০-৫৪০ টাকা। সবজির মূল্য শীতকালীন কম হওয়ার কথা। কিন্তু এখন চিত্র উল্টো। শীতকালীন সবজিই এখন চড়া দামে কিনতে হয়। লাউ ৫০-৬০ টাকা। ফুলকপি ও বাঁধাকপি ৬০-৭৮ টাকা কেজি। শিম কেজি ৭০-৮০ টাকা। অথচ শীতের সময় এগুলো নিতান্তই কম হওয়ার কথা।
ছোট্ট দেশ। জনসংখ্যাও বেশি। মানুষ বাড়ছে। চাহিদাও বাড়ছে। ফলে আমদানি বেশি করতে হচ্ছে। ডলার সংকটে আমদানির ওপর প্রভাব ফেলছে। ফলে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছেন। অথচ এসব পণ্য আমাদের দেশে উৎপাদন করা যায়।
\হপ্রাচীন পদ্ধতিতে এখনো মানুষ গ্রামাঞ্চলে চাষাবাদ করে। ফলে, না পারে তাদের চাহিদা মেটাতে, না পারে দেশের চাহিদায় অবদান রাখতে। তাদের একটা বড় অংশ কৃষক। তাদের সচেতন করতে পারলে আমাদের আমদানির ওপর নির্ভর থাকতে হবে না। যথাসময়ে যথানিয়মে তাদের ট্রেনিং দেওয়াতে পারলে আমাদের আমদানির নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানিমুখী হওয়া সম্ভব। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে চাওয়া থাকবে, নির্বাচনের পরপরই সরকার নিত্যপণ্যের দিকে মনযোগ দেবেন। সাধারণ মানুষের স্বস্তি ফিরিয়ে আনবেন। সাধারণ কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদের ট্রেনিং এবং সরঞ্জাম দিয়ে সাবলম্বী করে তুলবেন।
শহীদুল ইসলাম শুভ : কলাম লেখক