গ্যাং কালচার
আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম
কিশোর গ্যাং কালচার সৃষ্টির প্রথম যে পস্ন্যাটফর্ম সেটি হলো রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আধিপত্য বিস্তার। সংশ্লিষ্ট এলাকায় রাজনীতিতে যারা প্রভাব বিস্তার করেন তারা মূলত কিশোরদের ব্যবহার করে থাকেন। কিশোর বয়সের যে আগ্রহ, ইচ্ছার প্রতিফলন সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিরা ফায়দা লুটছে। আর ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ইতিহাস।
প্রকাশ | ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
নাজমুল করিম ফারুক
কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য ঢাকাকেন্দ্রিক থাকলেও এখন দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা শহরে ছাড়িয়ে গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে 'গ্যাং কালচার'। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ধীরে ধীরে সন্ত্রাসী ভাবাপন্ন হয়ে উঠছে। বর্তমানে এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে কোন্দল, চাঁদাবাজি, এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও মাদক সিন্ডিকেটে জড়িয়েছে।
১০ জানুয়ারি বুধবারর্ যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, গ্যাংগুলোতে শুরুতেই সন্ত্রাসী ভাবমূর্তি ছিল না। উঠতি বয়সিদের মধ্যে ক্ষমতার বিস্তারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং তথা গ্যাং কালচার। তারা এলাকায় নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে দল বেঁধে চলাফেরা ও বেপরোয়াভাবে মোটর সাইকেল শোডাউন দেয়। এ ছাড়া তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর চড়াও হয়ে খুনাখুনির ঘটনা পর্যন্ত ঘটায়।
২০১৭ সালে উত্তরায় স্কুলছাত্র আদনান হত্যাকান্ডের মাধ্যমে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি প্রথমে আলোচনায় আসে। পরে উত্তরা, গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় স্কুলছাত্র শুভসহ বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ড ঘটে। তবে সর্বশেষ ২০২৩ সালে কিশোর গ্যাং নিয়ের্ যাব যে পরিসংখ্যান দিয়েছে তা হলো- ২৮ জানুয়ারি রাজধানীর আদাবর থেকে 'বিডিএসকে গ্যাং' গ্রম্নপের প্রধান হৃদয় ওরফে হিটার হৃদয়সহ ৮ সদস্য এবং পরদিন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, শ্যামপুর ও কদমতলী এলাকা থেকে কিশোর গ্যাং লিডার জালাল ওরফে পিচ্চি জালাল বাহিনীর ১৬ সদস্য, ৬ ফেব্রম্নয়ারি আদাবর, মোহাম্মদপুর ও হাজারীবাগ এলাকা থেকে ২০ সদস্য, ২২ মার্চ মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, শেরেবাংলা নগর ও তেজগাঁও এলাকা কিশোর গ্যাংয়ের ৪৩ সদস্য, ২৮ এপ্রিল আশুলিয়ার নবারটেক এলাকা থেকে লিখন হত্যার আসামি কিশোর গ্যাং সদস্য অনিক ও জোবায়ের, ২৬ মে দারুসসালাম, সাভার ও বরিশালের বাকেরগঞ্জের সিয়াম হত্যা মামলার প্রধান আসামি কিশোর গ্যাং লিডার পটেটো রুবেল ও তার সহযোগী রকি, ১৬ জুন ফেনীর রামপুর থেকে নুরু গ্যাংয়ের প্রধান মাহিদুল ইসলাম সুজনসহ ৩ জন, ১৬ জুলাই বনানী থেকে পিচ্চি জয় গ্রম্নপের ৩ জন, ৮ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুর ও বাগেরহাট থেকে কবজি কাটা গ্রম্নপের আনোয়ার, সদস্য মো. রাফাত, তুষার, আহমেদসহ ৭ জন, ২৮ নভেম্বর মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান থেকে ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অতএব, গেল বছরর্ যাবের অভিযানে সারাদেশ থেকে কিশোর গ্যাংয়ের বিভিন্ন গ্রম্নপের ৩৪৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া ২০১৭ সাল থেকে বিভিন্ন অপরাধে কিশোর গ্যাংয়ের ১ হাজার ১২৬ সদস্যকে আটক করা হয়েছিল। তার মধ্যে ৪০ জনকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর, ৩০ জনকে অর্থদন্ড ও ১০ জনকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ তো গেলর্ যাবের পরিসংখ্যান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানগুলোও চোখে পড়ার মতো।
কিশোর গ্যাং কালচার সৃষ্টির প্রথম যে পস্ন্যাটফর্ম সেটি হলো রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আধিপত্য বিস্তার। সংশ্লিষ্ট এলাকায় রাজনীতিতে যারা প্রভাব বিস্তার করেন তারা মূলত কিশোরদের ব্যবহার করে থাকেন। কিশোর বয়সের যে আগ্রহ, ইচ্ছার প্রতিফলন সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিরা ফায়দা লুটছে। আর ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ইতিহাস।
কিশোর গ্যাংয়ের আরেকটি দিক হলো অ্যাপভিত্তিক ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের অবাধ যোগাযোগ, যা অপরাধকে বাড়িয়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। একজন কিশোর বিভিন্ন লাইক-কমেন্ট করে প্রথমে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে কিশোরীদের সঙ্গে। পর্যায়ক্রমে এই সম্পর্ক ভিডিও কলের মাধ্যমে অশ্লীলতায় পৌঁছে যায়। যার কারণে বস্ন্যাকমেইল করে ধর্ষণ ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে টিকটকের 'কিশোর গ্যাং'গুলো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। করোনার মহামারিতে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ ছিল। তৎকালীন সময়ে এসব অসামাজিক ভিডিওতে লাইক কমেন্ট পাওয়ার জন্য একের পর এক অপরাধে জড়িয়েছে কিশোর-কিশোরীরা।
এছাড়াও বিভিন্ন পার্ক, খোলা জায়গায়, ফুটপাত এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে একত্রিত হয়ে ভিডিও কন্টেন্ট তৈরির নামে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, ইভটিজিং, পথচারীদের গতিরোধ, বাইক মহড়াসহ বিভিন্ন অসৌজন্যমূলক আচরণ করে থাকে। গ্রম্নপগুলো একে অপরের ভিডিও কন্টেন্টে 'লাইক' ও 'কমেন্ট' করার আহ্বান জানায়। এক গ্রম্নপ লাইক বা কমেন্ট করার পর অপর গ্রম্নপটি যদি না করে এ নিয়েও গ্রম্নপের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়- যা হাতাহাতি, মারামারি ও খুনাখুনিতে গড়ায়।
এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে, সমাজে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। বর্তমান সমাজে নিজেদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কিশোররা। তাদের আচরণে পরিবর্তন হচ্ছে। এ বয়সে কিশোরদের মধ্যে 'অ্যাডভেঞ্চার ফিলিং' বা 'হিরোইজম' ভাব কাজ করে। তারা এই বয়সে এমন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে বা ফলো করে, সেখান থেকেই তারা অপরাধের দিকে ধাবিত হয়। বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের গ্যাং কালচার গড়ে উঠছে। অনেক ক্ষেত্রে ভিনদেশি সংস্কৃতি ইচ্ছামতো তাদের আয়ত্তে চলে আসায় তাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলে অসৎ অনুষঙ্গের সংস্পর্শের পরিধি ক্রমশ বাড়ছে। তাই এখনি সমাজের শিক্ষক, অভিভাবক, জনপ্রতিনিধি, বিশেষ করে যাদের কথা শুনবে এমন ব্যক্তিদের নিয়ে সমন্বিত উদ্যাগ নিতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উজ্জ্বল ইতিহাস রচনায় এই কিশোর গ্যাং কালচার থেকে বিপথগামী কিশোরদের সুপথে আনার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
নাজমুল করিম ফারুক : কলাম লেখক