খাদ্যেই এখন বিষের ভয়
খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে সরকারিভাবে কৃষকদের স্বাস্থ্যসম্মত আধুনিক চাষাবাদ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদানসহ সচেতন করতে হবে। যথাযথ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ছাড়া ফসলে কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
প্রকাশ | ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
দিন বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলাচ্ছে মানুষের খাদ্যাভাস। এক সময় বাংলার মানুষের পাতে পান্তা ভাত, কাঁচা মরিচ সঙ্গে একটি পেঁয়াজ হলে এক বেলার খাওয়া হয়ে যেত। কিন্তু দিন বদলানোর সঙ্গে বদলে গেছে মানুষের রুচি, বদলে গেছে মানুষের খাদ্যাভাস। মানুষের জীবন হয়ে গেছে সহজ ও আধুনিক। এখন মানুষ বিভিন্ন ধরনের দেশি ও বিদেশি খাবার খায়। হাটবাজারে- হোটেল-রেস্টুরেন্টে বিভিন্ন ধরনের বাহারি খাবার তৈরি করা হয়। আর এখন আধুনিক যুগের মানুষ সেই খাবার খায়। কিন্তু বিভিন্ন সময় দেখা যায়, অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে খাবার বিক্রি করছে ব্যবসায়ীরা। যা আস্ততে আস্ততে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
আমাদের দেশের অনেক মানুষ এখনো দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। আমাদের দেশের বিভিন্ন হাটবাজার, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, পাড়ার দোকানে ও মোড়ে ইত্যাদি স্থানে বিভিন্ন সময় ছোট বড় হোটেল ব্যবসা করে ব্যবসায়ীরা। এসব হোটেলে অনেক সময় দেখা যায় একদিনের খাবার তারা আরেক দিন গরম করে বিক্রি করছে। রুটি, ডালপুরি, সিঙ্গারা ইত্যাদি বানাতে ভেজাল তেল ব্যবহার করছেÑ যা খেয়ে বাচ্চা শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এসব খাবার খাওয়ার ফলে পেটব্যথাসহ বমি হওয়া, মাথাঘোরা, ডায়রিয়া, শরীরে ঘাম বেশি হওয়া এবং শরীর দুর্বল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা সৃষ্টি হয়। আবার আমাদের দেশের উচ্চ শ্রেণি বা যারা ধনী তারা খাচ্ছে বিভিন্ন নামিদামি হোটেল, রেস্টুরেন্টে। সেখানে তৈরি হয় কাচ্চি বিরিয়ানি, মোরগ পোলাও, হাইদ্রাবাদী বিরিয়ানি, তেহারিসহ বিভিন্ন বাংলা ও চাইনিজ খাবার। বিভিন্ন পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায়, বেশি মুনাফা লাভের আশায় হোটেল ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা কুকুরের মাংস, বাসি-পচা মাছ-মাংস ইত্যাদি রান্না করে। আবার চাইনিজ খাবারে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের রং ও কেমিক্যাল মেশানো হয়। একে ফুড কালার রাসায়নিক পদার্থ বলে। ফুড কালার হলো একটি রাসায়নিক পদার্থ এবং কৃত্রিম রং যা প্রক্রিয়াজাত খাবারের রং ও স্বাদ বাড়ায়। খাবারের রং ও কেমিক্যাল মিশ্রিত খাবার মানুষের শরীরে প্রবেশ করার ফলে অ্যালার্জি ও ক্যানসারের কারণ হতে পারে। বাসি-পচা মাংসে রান্না করা খাবার খেলে ডায়রিয়া, পেটব্যথাসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ হতে পারে।
আবার আমাদের দেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মিষ্টান্ন ও মিষ্টি জাতীয় দ্রব্যের বেশ ভালো চাহিদা আছে। বিভিন্ন সময় দেখা যায়, মিষ্টান্ন দোকানগুলো রাস্তার পাশে বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মিষ্টি বানায়। মিষ্টান্নতে স্বাদ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। আবার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন ধরনের রং মেশানো হয়ে থাকে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি ও খোলা জায়গায় রাখার ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মিষ্টান্নগুলোর হাঁড়ির উপর মাছিসহ বিভিন্ন ধরনের পোকা ঘুরাফেরা করতে দেখা যায়। মাছির পায়ে বিভিন্ন ধরনের রোগ জীবাণু মিশে থাকে। এসব খাবার খেলে বিভিন্ন ধরনের রোগের সৃষ্টি হয়।
এদিকে মিষ্টি বানাতে প্রয়োজন দুধের। এই দুধও ভেজাল প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয়। বিভিন্ন ধরনের কোম্পানিতে কৃত্রিমভাবে দুধ তৈরি করা হয়। বাচ্চারা মিষ্টি ও দুধ খেতে খুবই পছন্দ করে। কিন্তু দুধে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল মিশিয়ে কৃত্রিমভাবে দুধ তৈরি করা হয়Ñ যা শিশুদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। কেমিক্যাল ও রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে কৃত্রিমভাবে তৈরি এসব দুধ খেলে শিশুদের পেট ফাঁপা ও ব্যথা, বমি বমি ভাব হওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, ওজন কমতে থাকাসহ নানা রকম সমস্যা হতে পারে।
আবার ফল আমাদের জন্য একটি প্রয়োজনীয় খাদ্য। ফল খেলে আমাদের শরীরে বহু পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, পাশাপাশি ফলে থাকা বহু পুষ্টি উপাদান শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমনÑ ফুসফুস, লিভার, কিডনি সুস্থ রাখতে ভ‚মিকা রাখে। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে হাটবাজার থেকে কিনে আনা ফল খেলে কিডনি, লিভার, ফুসফুস ভালো থাকার চেয়ে তা বিকল ও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার ও ফলমূল আকর্ষণীয় করতে ও দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার জন্য ক্ষতিকর কার্বাইড, ইন্ডাসট্রিয়াল রং, ফরমালিন, প্যারাথিয়ন ব্যবহার করা হয়। এগুলো গ্রহণের ফলে কিডনি, লিভার ফাংশন, অ্যাজমাসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। অসাধু ব্যবসায়ীরা ফলকে দীর্ঘ সময় টিকিয়ে রাখতে ফলে ফরমালিন ব্যবহার করে। ফরমালিন একটি কেমিক্যালÑ যা মৃত দেহ সংরক্ষণে কাজ করে। যা মানব দেহে কোনোভাবে প্রবেশ করলে মানুষের ক্যানসার হতে পারে। এছাড়াও ফলকে বিভিন্ন ধরনের পোকার সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে বিভিন্ন প্রকার কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে আমাদের দেশের গ্রাম বাংলার চাষাবাদেও কিটনাশকের ব্যবহার হয়। শাকসবজি ফলমূল ফলানোর সময় কৃষি জমিতে বিপুল পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। কীটনাশক মেশানোর ফলে এ সবজি ও ফলমূলগুলোতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কীটনাশকের বিষক্রিয়া কার্যকর থাকে। যা রান্না করার পরও অটুট থাকে। যে বিষ মানব শরীরে প্রবেশ করে ¯েøা পয়জনের মতো কাজ করে এবং ধীরে ধীরে মানুষকে মেরে ফেলে। এই কীটনাশক মিশ্রিত খাবারগুলো আমাদের আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় আরেকটি খাবার হলো ডিম। দরিদ্র ও নি¤œ আয়ের মানুষের ছেলেমেয়েদের পুষ্টি ও আমিষের চাহিদা পূরণের অন্যতম ভ‚মিকা পালন করে ডিম। তবে ডিম এখন আর মুরগির দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। বড় বড় কোম্পানিগুলোতে কৃত্রিমভাবে রাসায়নিক ক্যামিক্যালের সাহায্যে হাজার হাজার ডিম তৈরি হয়। যা পরে আবার কোম্পানি থেকে বাজারে। বাজার থেকে প্লেটে। দেখতে আসল ডিমের মতোই। কিন্তু প্লাস্টিক ও বিভিন্ন রাসায়নিক মিশ্রণে তৈরি করা ডিম আমাদের শরীর বিভিন্ন ক্ষতি করছে। ডিমের কথা মাখায় এলো মুরগি। আমাদের দেশের মুরগির বেশ ভালো চাহিদা আছে। তবে দেশি মোরগ বা মুরগি পর্যাপ্ত পরিমাণে বাজারে মিলে না। তাই আমাদের দেশে ফার্মের পল্টি মুরগির বাজার বেশ জমজমাট। ফার্মের পল্টি মুরগিগুলো স্বল্প সময়ে বড় করতে মুরগিকে হরমোন ইনজেকশন দেয় অসাধু খামারিরা। এর ফলে, সময়ের আগেই মুরগিগুলো ওজনে বেড়ে যায় । এসব মুরগি খেলে মানুষের শরীরে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে বাচ্চা মেয়েরা খেলে। সময়ের আগেই তাদের শরীরের পরিবর্তন দেখা দেয়। ১০ বছর বয়সেই তাদের মধ্যে যৌবন দেখা দেয়। এর ফলে তাদের ঋতুচক্রে নানারকম প্রভাব ফেলে। এছাড়াও পল্টি ফার্মের মুরগির মাংসে উচ্চ মাত্রায় কোলিস্টিন নামক এক প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, এই অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাবে মানুষের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের কার্যক্ষমতা দিনে দিনে হ্রাস পেতে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় হয়তো অধিকাংশ অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধই মানব শরীরে কোনোরকম ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঠেকাতে পারবে না। এছাড়াও প্লাস্টিকের চাল, ভেজাল তেল, ভেজাল মধুসহ বাজারে বিভিন্ন ধরনের ভেজাল খাদ্য। বাজার থেকে কিনে আনা প্রতিটি খাদ্যেই দেখা যায় ভেজাল।
খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে সরকারিভাবে কৃষকদের স্বাস্থ্যসম্মত আধুনিক চাষাবাদ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদানসহ সচেতন করতে হবে। যথাযথ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ছাড়া ফসলে কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। খাদ্যের মান অক্ষুণœ রাখতে সরবরাহকারীকে কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। ভোক্তা অধিকার আইন ও নিরাপদ খাদ্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে পারলে খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার দুষ্টচক্র থেকে দেশকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। শহরের দোকান ও রেস্টুরেন্টে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে খাদ্যকে ভেজালমুক্ত করতে হবে। খাদ্যে ভেজালকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে ভেজাল খাদ্য নিয়ন্ত্রণে দেশের প্রধান খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) কে আরও সতর্ক ও সক্রিয় হয়ে ভেজাল খাদ্য নিয়ন্ত্রণে ভ‚মিকা হবে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, পরিবহণ, বিক্রয় ও ভোক্তার খাদ্য গ্রহণ প্রতিটি স্তরে খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিতে হবে। যাতে বেশি সময় ধরে আর বেশি এলাকার বাজারসমূহ মনিটরিং করা যায়। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য পণ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, সরবরাহ ও বিপণন প্রতিটি পর্যায়ে সচেতনতা প্রয়োজন। ভেজালরোধে ছোটবড় ব্যবসায়ীদের নৈতিকতাবোধ, উৎপাদক, বিপণনকারী, ভোক্তা সবার মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সংবাদ মাধ্যম, সেমিনারের মাধ্যমে নিজ নিজ উদ্যোগে প্রচারণা চালিতে ভোক্তা বিক্রেতার মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। লিফলেট, পোস্টার, নাটক, জারিগান, কার্টুন ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জনসচেতনতার ব্যবস্থা করে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
ভ‚ঁইয়া শফি : কলামিস্ট