শিশুদেরও একটা কোমলমতি মন আছে। তবে সেটা চঞ্চল, সজীব এবং নিষ্পাপ। তাইতো ওরাও মুক্তমনা পাখিদের মতো উড়তে চায়, কিচিরমিচির করে গাইতে চায় আর প্রাণ জুড়িয়ে খিলখিল করে হাসতে চায়। কিন্তু এসব পরিবেশ ওদের জন্য সৃষ্টি করা এবং সেগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা আমাদের দায়িত্ব। আর তা না হলে ওরা কীভাবে চিনবে? কারণ, ওরাতো ছোট্ট শিশু। আর এই দেখানোর অন্যতম একটি মাধ্যম হলো শিশু সাহিত্য। যেই গুরু দায়িত্বটা অবশ্য পড়েছে কবি এবং লেখকদের ওপর। এতকাল ধরে তারাই কিন্তু মূলত দেখিয়ে এসেছেন এবং ভবিষ্যতেও দেখাতে হবে। তাই চলুন, প্রথমে জেনে নেওয়া যাক শিশু সাহিত্যটা কী এবং কীভাবে আসল।
সত্যিকার অর্থে শিশু সাহিত্যকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা একটু কঠিন সাধ্য ব্যাপার। এরপরও বলা যায়, সহজ-সরল ভাষায় হাস্যরস ও অনুভূতি প্রকাশের জন্য শিশুদের নিয়ে যে সাহিত্য রচিত হয়, সাধারণত তাকে বলা হয় শিশু সাহিত্য।
অর্থাৎ, শিশু সাহিত্য রচিত হয় পঠন-শ্রবণের মাধ্যমে শিশুদের আনন্দ বিধান আর শিক্ষাদানের জন্য। এটা মূলত ১৪-১৫ বছর বয়সসীমার মধ্যে শিশুদের মনস্তত্ত্ব বিবেচনা করে রচনা করা হয়। যারা শৈশব ও কৈশোরের খুব কাছাকাছি তাদের জন্যই এই চেষ্টা। এতে থাকে কল্পনা, রোমান্স, জ্ঞানবুদ্ধির উপস্থাপনা, রূপকথা, অ্যাডভেঞ্চার আর ভূত-প্রেতের গল্প।
বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনার মাধ্যমে জানা যায়, বাংলায় শিশু সাহিত্যর সূচনাপর্ব বলা হয় উনিশ শতককে। কথাটা বলার পেছনে বেশ যুক্তিও রয়েছে বটে। যেমন ১৮১৮ সালে কলিকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত নীতিকথা নামক গ্রন্থ, এ ছাড়া রাধামাধব মিত্রের লেখা ১৮৫৬ সালে কবিতাবলী এবং ১৮৬৩ সালের বোধেন্ধুদয় প্রকাশিত হয়। আর যদি বাংলাদেশের কথা বলি তবে বলতে হয়, স্বাধীনতার প্রায় ছয় বছর পর বাংলাদেশে শিশু সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়। এমনকি ১৯৭৮ সালের পর বাংলা সাহিত্যের চর্চা নবরূপে সূচিত হয়। যেখানে বিষয়বস্তুগুলোতে বিভিন্ন বৈচিত্র্যতা লক্ষ্য করা যায়। আর সেই বিভিন্ন বিষয়বস্তুগুলোর আলোকে শিশুতোষ গ্রন্থ প্রকাশ হতে থাকে। যেমন-বিজ্ঞান বিষয়ক সত্যেন সেনের 'আমাদের এই পৃথিবী' ও 'এটমের কথা' এই দুটি গ্রন্থই শিশুদের জনপ্রিয়। সুব্রত বড়ুয়ার 'চাঁদে প্রথম মানুষ' আকাশচারণ-বিষয়ক সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। এভাবেই কিন্তু এগিয়ে চলেছে শিশু সাহিত্য। শিশু সাহিত্য এখন বাংলাদেশে চড়াইউৎরাই পেরিয়ে মোটামুটি একটা অবস্থান করে নিয়েছে। তবে এই খবরটা হয়ত আমাদের সবার জানা নেই। কারণ, সবাইতো আর বই পড়াটা পছন্দ করি না, তাই এর মর্মও বুঝতে পারি না। কিন্তু এই না পড়াটা আর না জানার অনিহাটাই কিন্তু আজ সমাজের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে, এটা কিন্তু বেশ জড় দিয়েই বলা যায়। কারণ, দেখুন শিশুরা কীভাবে মোবাইল আর কম্পিউটারে গেমসের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে! আর এর জন্যই শিশুদের আজ প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব নেই। নতুন নতুন বিষয়ের ওপর জানার আগ্রহ নেই। খেলাধুলার প্রতিও তেমন কোনো পিপাসা নেই বললেই চলে। সবাই শুধু ঘরের ভেতর আবদ্ধ হয়ে পড়ে থাকতে পছন্দ করে! এটা কিন্তু শিশুদের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবেও হুমকিস্বরূপ। তবে এই সমস্যার সমাধানের জন্য শিশুদের শিশুতোষ ছড়া ও গল্পগুলো পড়ার জন্য উৎসাহিত করাটা জরুরি। এখানে বলা বাহুল্য, প্রতিবছর কিন্তু বইমেলায় শিশুদের জন্যও মানসম্মত নতুন নতুন বই আসছে। এসব বই কালেকশন করা যেতে পারে। এ ছাড়া বইমেলা ছাড়াওতো বাজারে বর্তমানে শিশুতোষ বই পাওয়া যায়। এগুলো পড়লে অবশ্যই শিশুরা ফুলকে ভালো বাসবে, গাঁয়ের রাঙা মাটির পথ দিয়ে হাঁটতে চাইবে, নদীর কলতান, পাখির গান ও রাখালের বাঁশির সুর নিশ্চয়ই উপভোগ করতে চাইবে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শিশু সাহিত্যগুলো পাঠ করেও বুঝতে পারবে স্বাধীনতার স্বাদ, গন্ধ ও সুফল। আর এভাবেইতো মনের মাঝে জেগে উঠবে প্রকৃতি ও দেশের জন্য প্রেম। তবে এ ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ের কবি ও লেখকদেরও যুগের সঙ্গে তালমিলিয়ে সময়কে প্রাধান্য দিয়ে বৈচিত্র্যময় আকর্ষণীয় লেখা উপহার দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। শিশু সাহিত্যকে অবহেলা না করে মনে রাখতে হবে, শিশু সাহিত্য রচনায় কলম ধরা এটা আমাদের দায়িত্ব। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের মধ্যে অনেকেই শিশু সাহিত্যকে প্রাপ্য স্বীকৃতিটুকু দিতে চাই না। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কারণ, শিশু সাহিত্যটা সাহিত্যর একটি মূল্যবান অংশ।
এ বিষয়ে আরও বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শামসুর রহমান এবং আল মাহমুদ তারা সবাই কিন্তু শিশু সাহিত্যে সমানতালে অবদান রাখার চেষ্টা করেছেন। তাই কোনোভাবেই শিশু সাহিত্য লেখা এবং পাঠের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করা যাবে না। আর হঁ্যা, শিশু সাহিত্যে হাতটা পাকিয়ে নিতে পারলে আপনিও পরবর্তীতে একজন কবি ও লেখক হয়ে সাহিত্যে অবদান রাখতে পারবেন।
\হআরও একটি কথা কবি এবং লেখকদের মাথায় রাখতে হবে। কোনোভাবেই লেখার ভাষা কঠিনভাবে প্রয়োগ করা যাবে না। শিশুদের জন্য লেখাটা হতে হবে একদম সহজ-সরল ও বোধগম্য। এ ক্ষেত্রে দাঁতভাঙা কোনো শব্দ প্রয়োগ করা মোটেই উচিত নয়। আর এ প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, 'শিশুরা আর যাই হোক, অর্থলোভী জাত নয়, অতএব শিশুপাঠ্য রচনায় যত খুশি ভাটপাড়া সুলভ শব্দ প্রয়োগ করুন। আশঙ্কার কিছু মাত্র কারণ নেই, শিশুরা সে রচনা দেখে গলা শুকিয়ে জলের গস্নাসের দিকে হাত বাড়াবে না।' তবে দিকনির্দেশনা হিসেবে বলা যায়, বর্তমানে বই ছাড়াও শিশুদের বিভিন্ন ম্যাগাজিন এবং জাতীয় পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত শিশু সাহিত্যের পাতায় চোখ রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করা যেতে পারে। তাহলে এভাবে তাদের মাঝ থেকেও ভবিষ্যতে লেখক-কবি বেরিয়ে আসবে- এটাই স্বাভাবিক। শেষ বেলায় বলতে হয়, যেহেতু আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ এবং শিশুরাই আমাদের সব আশা ও ভরসার মূল কেন্দ্রবিন্দু। তাই অবশ্যই এই ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ, বর্তমানে কিন্তু বই প্রকাশনায় খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক ভালো বই প্রকাশনায় আসছে না। এ ব্যাপারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবাইকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। তাহলেই সম্ভব শিশু সাহিত্যের জন্য আরও সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলা। তাহলে আসুন, সবার প্রচেষ্টায় শিশুদের ও সাহিত্যর মঙ্গলের জন্য সর্বোপরি দেশের মঙ্গলের জন্য শিশু সাহিত্য হোক প্রেরণা।
মো. আব্দুর রহমান
বিপিন নগর, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ