মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উপযুক্ত সম্মান পাওয়া উচিত
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা মানমর্যাদা, সম্মানই চান দেশ-জাতির কাছে, ভাতা, সুযোগ-সুবিধা নয়। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর জীবন সায়াহ্নে উপনীত হওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহেল রানার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উপযুক্ত সম্মানের জন্য আকুতি দেশ ও জাতিকে লজ্জায় ফেলেছে।
প্রকাশ | ০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
জহির চৌধুরী
'বিজয়, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ একদিনের বিষয় নয়, এটা সারাজীবন মনে রাখার বিষয়। কিন্তু এখন আমরা শুধু বিশেষ দিন এলেই এ বিষয়ে কথা বলি। এ সময়ের অধিকাংশ মানুষ এই দিবসের মাহাত্ম্য বোঝে না। তখন সময়ের প্রয়োজনে দেশের জন্য যেটা করা দরকার ছিল, আমরা সেটা করেছি। দেশের জন্য করেছি। তার জন্য দেশের মানুষ বুকে টেনে নেবে, দুটো ভালো কথা বলবে, আমি শুধু এতটুকুতেই সন্তুষ্ট। তবে একদিনের জন্য সম্মান বা ভালোবাসা চাই না। এসবের জন্য যুদ্ধ করিনি আমরা। আর মুক্তিযুদ্ধ তো শুধু আমার একার নয়। তখন প্রত্যক্ষ, পরোক্ষভাবে যারা যুদ্ধ করেছে, এটা তাদের সবার। সেই সাত কোটি মানুষের। তাদের সবার চাওয়া, উপযুক্ত সম্মান। আমরা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম বলেই আমাদের মুক্তিযোদ্ধা উপাধি দেওয়া হয়েছে। এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে গিয়ে আমরা উপযুক্ত সম্মান পাই না। এ ছাড়া আমাদের যে সনদ দেওয়া হয়েছে, সেখানেও লেখা সাময়িক। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি তালিকা অনুযায়ী, আমাদের একটা ভাতা দেওয়া হয়। কিন্তু ভাতা কি হিসেবে আসে? আমরা তো দেশের জন্য চাকরি করি না। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উপযুক্ত সম্মান চাই, কোনো ভাতা নয়।' কথাগুলো চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব বীরমুক্তিযোদ্ধা সোহেল রানার। তার এ কথাগুলো গত ১৮.১২.২৩ দৈনিক ইনকিলাব-এ 'মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উপযুক্ত সম্মান চাই- সোহেল রানা' শিরোনামের প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে।
সোহেল রানার কথাগুলো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উপযুক্ত সম্মান না পাওয়ার দুঃখ থেকে বলা মনে করি। সোহেল রানা বীর মুক্তিযোদ্ধাই শুধু নন; মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরিতে গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করেছেন যারা তাদেরও একজন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক শুরুর আগ থেকেই ছাত্র সমাজের একটা অংশ বিশেষ করে ঢাকার ছাত্র সমাজের একটা অংশ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভ্রূণ ছাত্র সমাজের একটা অংশের মধ্যেই জন্মেছিল। সোহেল রানার প্রকৃত নাম মাসুদ পারভেজ। চলচ্চিত্রে প্রবেশের পর মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা নাম ধারণ করেন। মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা) ষাটের দশকের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালে ছাত্রলীগের প্রভাবশালী সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সহসভাপতি (ভিপি) ছিলেন। ছাত্রলীগের যে অংশ স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে ষাটের দশকের গোড়া থেকে গোপনে তৎপর ছিল সে অংশের ঘনিষ্ঠ ছিলেন মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা)। বাংলাদেশ সৃষ্টির পটভূমির বহু ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সোহেল রানা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই অংশ নেন।
\হসবাই জানেন, দুনিয়ার কোথাও মুক্তি বা স্বাধীনতা যুদ্ধের আকস্মিক উদ্ভব ঘটেনি; বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও নয়। বিজয় দিবসের মাহাত্ম্য বুঝতে হলে মুক্তিযুদ্ধের মাহাত্ম্য বুঝতে হয় আগে। মুক্তিযুদ্ধ রাইফেল/বন্দুকের গুলি ফুটিয়ে, বোমা ফাটিয়ে মজা লুটার খেলা না। মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত দেশ গড়তে প্রতিটি নাগরিকের মুক্তিযুদ্ধের মাহাত্ম্য বুঝা অতীব প্রয়োজন। প্রশ্ন হলো, মুক্তিযুদ্ধের মাহাত্ম্য আমরা কি আদতেই বুঝি, বুঝলেও কয়জন বুঝি? মুক্তিযুদ্ধের মাহাত্ম্য যদি আদতেই বুঝতাম তাহলে স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছাত, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার নিয়ে কারো মধ্যে হতাশা দেখা যেত না। পরাধীন অবস্থার বৈষম্য, শাসন-শোষণ, অন্যায়-অবিচার, বঞ্চনা থেকে মুক্ত হয়ে বৈষম্য-শোষণ, অনাচার-অবিচার মুক্ত দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে করা যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধ বলা হয়। মুক্তিযুদ্ধ ছেলে খেলা নয়। বৈষম্য, শোষণ, অন্যায়-অবিচার মুক্ত দেশ সৃষ্টির যুদ্ধই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। দুর্ভাগ্যজনক যে, স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই বৈষম্য, শোষণ, অন্যায়-অবিচারমুক্ত দেশের প্রত্যাশা কর্পূরের মতো উবে গেছে।
স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ ৫২ বছরে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, জুলুম-অবিচার, বৈষম্যের অবসান কতটা হয়েছে, গণতান্ত্রিক- মৌলিক অধিকার, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন কতটা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়েছে তা খতিয়ে দেখলেই আমজনতার কাছে স্বাধীনতা/ মুক্তিযুদ্ধ/বিজয়ের মাহাত্ম্যের স্বাদ কেমন তা বুঝাতে বাকি থাকবে না। স্বাধীনতা/ মুক্তিযুদ্ধ/বিজয়ের মাহাত্ম্য বাজারে বিক্রিত বটিকা নয়। বাজার থেকে স্বাধীনতা/ মুক্তিযুদ্ধ/বিজয়ের 'মাহাত্ম্য বটিকা' কিনে খেয়ে মুক্তিযুদ্ধ/ স্বাধীনতা/বিজয়ের মাহাত্ম্য বুঝার সুযোগ নেই। বিজয় তথা মুক্তিযুদ্ধের মাহাত্ম্য না বুঝার দায় এ সময়ের মানুষের ওপর এককভাবে চাপানোর সুযোগ নেই। বহু বীরমুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতার পরপরই সদ্য স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের মানমর্যাদা, ভাবমূর্তি বিনষ্টের চক্রান্ত রুখে দেওয়ার, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করেছেন। তবে খুব একটা সফল হননি কোটারি স্বার্থন্বেষীদের দাপট-দৌরাত্মের কারণে। দুর্বৃত্তায়নের অর্থনীতি-রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের মাহাত্ম্য বুঝার অন্তরায় হয়ে আছে ৫২ বছর ধরে বলা যায় নির্দ্বিধায়।
\হমুক্তিযোদ্ধাদের পর্বতসম সম্মান দেশের মানুষ দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজের, পরিবারের জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতা করেছে দেশের মানুষ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের মানমর্যাদার সামন্যতমও কমতি ছিল না। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান-মর্যাদা হারানো/কমতির শুরুটা হয়েছে স্বাধীন দেশে। স্বাধীনতার পর সদ্য স্বাধীন দেশে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মানমর্যাদা ক্ষুণ্ন্নের সূচনা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার সম্মান, মানমর্যাদা কমতির জন্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টি বহুলাংশে দায়ী। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত ছিল দলমতনির্বিশেষে সব মুক্তিযোদ্ধার। বাস্তবতা হলো, হাতগোনা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। আজতক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা 'উৎপাদন' বন্ধ না হওয়ায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মানমর্যাদা নিয়ে টিকে থাকা কঠিন থেকে কঠিনতরই হচ্ছে।
স্বাধীন দেশে যদি একজন বীরমুক্তিযোদ্ধাকে উপযুক্ত সম্মান মুখ খুলে চাইতে হয়- তাহলে সে দেশ-জাতির লজ্জায় মাথা নিচু হওয়া উচিত। মুক্তিযোদ্ধারা জাতীয় বীর। জাতীয় বীরের মর্যাদা-সম্মান যে জাতি দেয় না বা দিতে জানে না সে জাতিকে মৌলিকভাবেই গোলামের জাত বলতে দ্বিধা নেই। বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহেল রানা উপলব্ধি করছেন তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উপযুক্ত সম্মান পাচ্ছে না। অনেকেই বলতে পারেন, মুক্তিযোদ্ধারা মোটা অঙ্কের ভাতা, নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন- এটা কি সম্মানের নয়? প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নিজের প্রাপ্তির আশায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন না। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা দেশ-জাতি, প্রজন্মের জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেন। দেশ-জাতি, প্রজন্মের চাওয়া-পাওয়াই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার চাওয়া-পাওয়া। দুনিয়ার কোথাও ভাতা, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা লাভের আশায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার নজির নেই। বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহেল রানা যথার্থই বলেছেন, 'আমরা তো দেশের জন্য চাকরি করি না। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উপযুক্ত সম্মান চাই, কোনো ভাতা নয়।'
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা মানমর্যাদা, সম্মানই চান দেশ-জাতির কাছে, ভাতা, সুযোগ-সুবিধা নয়। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর জীবন সায়াহ্নে উপনীত হওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহেল রানার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উপযুক্ত সম্মানের জন্য আকুতি দেশ ও জাতিকে লজ্জায় ফেলেছে।
জহির চৌধুরী : কলাম লেখক