ইতিহাসের উজ্জ্বল সারথি শেখ হাসিনা
বাংলাদেশে যে নারীর অগ্রগতি এর মূল কৃতিত্ব শেখ হাসিনার। নারী বিষয়ে তার উদারনৈতিক ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি অসাধারণ। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি এবং গণতন্ত্র বিকাশে তার অবদান অপরিসীম ও অতুলনীয়। বাংলাদেশকে তিনি উচ্চতম স্থানে নিয়ে গেছেন। বিশ্বে শেখ হাসিনাই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতাসীন নারী সরকারপ্রধান।
প্রকাশ | ০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
সালাম সালেহ উদদীন
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। ফলে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠনের মাধ্যমে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। আর এই ইতিহাসের উজ্জ্বল সারথি শেখ হাসিনা। তিনি পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে অনন্য রেকর্ড সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন বিশ্ব রাজনীতিতে। বিশ্বে শেখ হাসিনাই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতাসীন নারী সরকারপ্রধান। এরই মধ্যে চার মেয়াদে ২০ বছর সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
দীর্ঘদিন দেশ শাসন করে বিশ্বের শীর্ষ নারী শাসকদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ক্ষেত্রে নারী সরকারপ্রধান হিসেবে দীর্ঘদিন দেশ পরিচালনায় তিনি পেছনে ফেলেছেন ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, যুক্তরাজ্যের মার্গারেট থ্যাচার ও শ্রীলংকার চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার মতো জনপ্রিয় নেতাদের। নারী হিসেবে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা ও বিশ্বে পরিচিতির দিক বিবেচনায় এ তালিকা করা হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতায় ছিলেন। মার্গারেট থ্যাচার যুক্তরাজ্য শাসন করেছেন ১১ বছর ২০৮ দিন। চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুভাবেই ক্ষমতায় ছিলেন ১১ বছর ৭ দিন। আর চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে ১৫ বছরেরও বেশি সময় পার করে ফেলেছেন শেখ হাসিনা। আর এবার পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন তিনি। তার আমলে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। আগে যেখানে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল সাত থেকে আটশ ডলার, কয়েক বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে ২ হাজার ৭৬৫ ডলার। এ সময়ে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করেছে।
নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে নানা নেতিবাচক কথা প্রচলিত রয়েছে। বিরুদ্ধবাদীরা বলে থাকে, নারী জন্মগতভাবে অবলা এবং তুলনামূলকভাবে নির্বোধ। তারা কোনোভাবেই সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। অন্যের কথার দ্বারা তারা অতিমাত্রায় প্রভাবিত, চালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। তারা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে হেন কাজ নেই যা করতে পারে না। নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক তীক্ষ্নতাও কম। কাজেই পুরুষের ওপর তাদের কর্তৃত্ব করা একেবারেই অবান্তর। অন্তত পুরুষশাসিত সমাজ তাই মনে করে। পরিস্থিতি যদি এমন হয় তবে কীভাবে নারীর ক্ষমতায়ন পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রে ঘটবে আর কীভাবেই নারী রাষ্ট্র শাসন করবেন।
একুশ শতকে এসে এ কথার ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না। বহু আগে থেকেই নারী রাজ্যশাসন করছেন, যুদ্ধ ক্ষেত্রে গিয়েছেন, এমনকি রাজ্যের শীর্ষপদ অলঙ্কৃৃত করেছেন। অনেকেই এটাও মনে করেন যে, নারী-পুরুষ প্রাধান্যের আবহে থেকেই রাজ্য শাসক হয়েছেন। তবে যারা নারীকে উচ্চাসনে দেখতে চান না, তাদের মতে-'পুরুষের সঙ্গে মেয়েদের হরমোনজনিত তারতম্য রয়েছে বলেই নারী রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদের যোগ্য নয়। তারা আন্তঃরাষ্ট্রীয় তথা পররাষ্ট্রনীতি বোঝেন না। সত্যিকার কূটনৈতিক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে তা তাদের বোধের বাইরে। এসব মিথ্যা প্রমাণ করেছেন একুশ শতকের নারী শাসকরা। গত দেড় দশকে নারী শাসনের ক্ষেত্রে নবজাগরণ ঘটেছে। পৃথিবীর বহুদেশে এখন নারী শাসক রয়েছে। জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, ভারত, লাইব্রেরিয়া, আর্জেন্টিনা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, কোস্টারিকা, ব্রাজিল, সুইজারল্যান্ড, কসোভো, পেরু, থাইল্যান্ড, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, সেইন্ট লুসিয়া, এন্টিগোয়া অ্যান্ড বারবোডা, আইসল্যান্ড, মাল্টা, ঘানা, লাটভিয়া, পানামা, ফিনল্যান্ড, কিরগিজিস্তান, মঙ্গোলিয়া, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, জর্জিয়া, ইসরাইল, গ্যাবন, ফ্রান্স, বুরুন্ডি, যুক্তরাজ্য, কানাডা, রুয়ান্ডা, শ্রীলংকা, বুলগেরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, পেরু, মেসিডোনিয়া, বারবাডোস, নরওয়ে, পোল্যান্ড, জ্যামাইকা প্রভৃতি রাষ্ট্রে কোনো না কোনোভাবে শাসনক্ষমতায় ছিল নারী এবং বেশিরভাগ রাষ্ট্রে এখনো রয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই হয় নারী প্রেসিডেন্ট, না হয় প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য নারী হচ্ছে, ক্লিওপেট্রা, রানী ভিক্টোরিয়া, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, মার্গারেট থ্যাচার, প্রতিভাপাতিল, অ্যাঞ্জেলা মারকেল, শেখ হাসিনা, জুলিয়া গিলার্ড, দিলমা রুসেফ, ক্রিস্টিনা ফার্নান্দেজ, ইংলাক সুনেত্রা প্রমুখ। তবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রী মাভো বন্দরনায়েক, ইন্দিরা গান্ধী, বেনজির ভুট্টো, চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা, শেখ হাসিনা দীর্ঘ সময় রাজ্য বা দেশ শাসন করেছেন। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের দীর্ঘতম নারী শাসক। পৃথিবীর বহু দেশেই নারী মন্ত্রী ও সচিব রয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি নারী, একাধিক রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী নারী। যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ, পাকিস্তানে নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদে নারী রয়েছে, সচিবও রয়েছে বেশ ক'জন। নারী উপাচার্য পুলিশ ও সামরিক কর্মকর্তাও রয়েছেন। নারী উদ্যোক্তা, ও শিল্পপতিদের সংখ্যাও বাংলাদেশে কম নয়।
নারীর প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে নারীর অন্তর্ভুক্তি তথা উন্নয়নের মূল ধারায় নারীকে সম্পৃক্ত করার উদ্দেশ্যে প্রথম উদ্যোগ ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সরকার গ্রহণ করে। সরকারি চাকরিতে মেয়েদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দিয়ে সব ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ অবারিত করে দশ ভাগ কোটা সংরক্ষণ করা হয়। ১৯৭৩ সালে দুজন নারীকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ১৯৭৪ সালে একজন নারীকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক করা হয়।
সমাজ ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সব ক্ষেত্রেই নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়টিতেও সরকার গুরুত্বারোপ করেছে। আমাদের দেশে সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ ইতিবাচক। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী ও স্পিকার নারী। বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে নারী রয়েছেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নারী বিচারপতি নিয়োগ প্রদানের মধ্যে নারী ক্ষমতায়নের নতুন মাইলফলক যুক্ত হয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি পদে রয়েছে বেশ কজন নারী, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশন ও তথ্য কমিশনে নারী সদস্য কাজ করছেন।
বাংলাদেশে যে নারীর অগ্রগতি এর মূল কৃতিত্ব শেখ হাসিনার। নারী বিষয়ে তার উদারনৈতিক ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি অসাধারণ। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি এবং গণতন্ত্র বিকাশে তার অবদান অপরিসীম ও অতুলনীয়। বাংলাদেশকে তিনি উচ্চতম স্থানে নিয়ে গেছেন। বিশ্বে শেখ হাসিনাই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতাসীন নারী সরকারপ্রধান।
শেখ হাসিনাকে ঘিরে এখন মানুষের মধ্যে অনেক আশা তৈরি হচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে আসলেই দেশের উন্নতি হচ্ছে। এ কথা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই স্বাধীনতার ৫২ বছরে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশকে এখন বলা হয় উন্নয়নের রোল মডেল, বলা হয় এশিয়ার বাঘ। যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশ উন্নয়ন অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়েছে। একাত্তরের বাংলাদেশ আর বর্তমান বাংলাদেশ এক নয়। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, দেশের বিদু্যৎ সংকট সিংহভাগই কেটে গেছে। দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার চ্যালেঞ্জিং ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমান সরকার দেশের ইপ্সিত প্রবৃদ্ধির ভিত্তি রচনা করতে সক্ষম হয়েছে। রেমিট্যান্স প্রাপ্তির হারও অনেক বেড়েছে এবং এক্ষেত্রে বাজেটে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। মাতৃমৃতু্য ও শিশুমৃতু্যর হার কমেছে। তথ্য-প্রযুক্তিতে, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচকে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক ভালো। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ আশাব্যঞ্জক অবস্থানে রয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ক্রীড়াসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় পরিণত করতে 'ভিশন-২০৪১' কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার, এবার নতুনভাবে কাজ শুরু করবে। শুধু দেশেই নয়- আন্তজার্তিক অঙ্গনেও এর স্বীকৃাত মিলেছে। আমাদের এই অর্জন ধরে রাখতে হবে। তবে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা ও অর্থ পাচার মানব পাচার ঠেকানো অনেক কঠিন কাজ। এ জন্য সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ এবং দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব হলে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের বুকে একটি মর্যাদাশালী ও গর্বিত দেশ। এ ক্ষেত্রে নতুন সরকারের অনেক করণীয় রয়েছে। দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করা, মূল্যস্ফীতি কমানো, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি করা, বেকার সমস্যা দূর করা। আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা, গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটানো। উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিরোধী মতকে প্রাধান্য দেওয়া। সর্বোপরি স্মাট বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার পূরণ করতে হবে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাক সমহিমায় তার নিজস্ব উজ্জ্বলতা নিয়ে।
সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক