বর্তমান বিশ্ব বিস্ময়কর প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্ব। প্রযুক্তির সংশ্লেষ ছাড়া বর্তমান বিশ্বের মানুষ এক মুহূূর্তও ভাবতে পারেন না। অর্থাৎ প্রযুক্তি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনাচারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। প্রযুক্তির উন্নতি, বিকাশ ও ব্যবহারের দক্ষতার ওপর বর্তমানে জাতীয় উন্নতিকে পরিমাপ করা হয়। যে জাতি যত বেশি প্রযুক্তিতে দক্ষ সে জাতি তত বেশি উন্নত হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ, আগামীর পৃথিবী হবে আণুবীক্ষণিক প্রযুক্তির বিশ্ব। তাই প্রতিটি দেশ নিজেদের প্রযুক্তির উন্নয়নে যারপরনাই তৎপর। প্রযুক্তি উন্নয়নের রূপকল্প হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অগ্রযাত্রায় শামিল হয়ে বর্তমানে স্মাট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অগ্রসরমান। বাংলাদেশের ডিজিটাল যুগে পদার্পণের শুভ সূচনা হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ১৫টি সংস্থার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্য পদ লাভ করে। আর্থসামাজিক জরিপ, আবহাওয়ার তথ্য আদান-প্রদানে আর্থ-রিসোর্স টেকনোলজি স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম বাস্তবায়িত হয় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। বঙ্গবন্ধুর ডিজিটাল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রথম সূত্রপাত ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৪ জুনে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইটের আর্থ-স্টেশন উদ্বোধনের মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করা হয়, ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ 'ডিজিটাল বাংলাদেশে' পরিণত হবে। ২০২৩ সালে ঘোষিত হয় স্মার্ট বাংলাদেশের রূপকল্প-২০৪১। মূলত ৯০-এর দশকে বাংলাদেশে প্রথম মোবাইল ফোনের আগমন ঘটলেও তার বিপস্নব ঘটে ২০০৫ সালে। বর্তমান স্মার্ট বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ইন্টারনেট, গুগল, ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রামসহ প্রযুক্তি জ্ঞানের অভাব নেই। সবাই এখন ব্যক্তিগত, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক কর্মসম্পাদনে প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। বিটিআরসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ৬১ লাখ ৪০ হাজার। এর মধ্যে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার জন। সরকারি সেবা, করপোরেট সেবা, শিক্ষা-দীক্ষা, চিকিৎসা, অনলাইন শপিং, লেনদেন, ব্যবসাবাণিজ্য ও পেশাগত দায়িত্বপালন সর্বক্ষেত্রে আমরা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছি। এই প্রযুক্তিনির্ভরতা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনকে যেমন সহজলভ্য করেছে, ঠিক তেমনি জীবনকে করছে দুর্বিষহ, জঞ্জালময় ও নিরাপত্তাহীন।
বিশেষত প্রযুক্তি এক বিশাল তথ্যভান্ডার সৃষ্টি করলেও এই তথ্যের নিরাপত্তাব্যবস্থা খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। মানুষের তথ্যের গোপনীয়তার ক্ষেত্রেও তৈরি হচ্ছে নানান ধরনের সমস্যা। ফোন সিগন্যাল ইন্টারসেকশন, ইমেইল হ্যাকিং, ওয়েভ-সার্ভার হ্যাকিং, এআই'র ডিপফেইক প্রযুক্তি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা নষ্ট করছে। বাংলাদেশ সরকারের একটি ওয়েবসাইট থেকে দেশের অনেক নাগরিকের নাম, ফোন নম্বর, ই-মেইল ঠিকানা এবং জাতীয় পরিচিতি নম্বরসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ বা ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়েছিল ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রম্নয়ারি। তখন একটি ম্যালওয়্যারের মাধ্যমেই নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়ে হ্যাকাররা। মূলত ওয়েবসাইটের দুর্বলতার কারণে এরকম ঘটনাগুলো ঘটেছে। দেশে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হলো তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনে প্রতারণা ও গুজব। ইতোমধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ই-কমার্সের নামে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ ১০টির বেশি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অনলাইনভিত্তিক মাধ্যম এমটিএফই লাখ লাখ বাংলাদেশি গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। যদিও এ ধরনের অ্যাপ চালানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কোনো অনুমোদন ছিল না। দেশে অবৈধ ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে অনলাইনের সব কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে অ্যাপসভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি। হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে যে পরিমাণ অর্থ গায়েব করেছে, এর চেয়ে ১০ গুণ বেশি টাকা ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে লুট করেছে অ্যাপভিত্তিক এই অনলাইন ট্রেডিং গ্রম্নপ 'মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই)। প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতারণার মধ্যে- ফেসবুক, ইউটিউব বা অনলাইন পোর্টালে ই-কমার্সের নামে লোভনীয় অফারের ফাঁদ পেতে মাঠে সক্রিয় বহু চক্র। এসব চক্র লোভনীয় অফারে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া ছাড়াও ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করে অর্থ আত্মসাৎ, বিট-কয়েনসহ বিভিন্ন ধরনের কার্ড ব্যবহার করে লেনদেনের আড়ালে অর্থ আত্মসাৎ করছে। বিদেশে নেওয়া, বিশেষ দামি গিফট বা পুরস্কার পাঠানো, জিনের বাদশাসহ আরও বহুভাবে প্রতারণা করা হচ্ছে। বাল্ক এসএমএসের ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাচ্ছে এলাকাভিত্তিক, শহরভিত্তিক হাজার হাজার ফোন নম্বর। মুঠোফোন নম্বর দিয়ে ব্যক্তিকে পাওয়া যায়, প্রযুক্তি ব্যবহার করে তার শারীরিক গতিবিধিও অনুসরণ করা সম্ভব। আর সম্ভব বিভিন্ন চটকদার ক্ষুদে বার্তা দিয়ে প্রতারণা করা। প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলা গুজবের মধ্যে- প্রশ্ন ফাঁস, গণমাধ্যম নিয়ে মিথ্যাচার, পুঁজিবাজার, চলচ্চিত্র, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অসুস্থতা, বিয়ে ও মৃতু্য, ধর্মীয় উসকানি, মসজিদ-মন্দির ভাঙা বা হামলা, নানা বিষয়ে মিথ্যা ও ভুয়া পোস্ট দিয়ে গুজব ছড়ানোর সংখ্যা সব থেকে বেশি। এর বাইরে নিষিদ্ধ উগ্র ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীও গুজব প্রচারণার কাজে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার শুরু করেছে। জঙ্গি অপরাধ পরিচালনা, সন্ত্রাসী কার্যক্রমে, বোমা তৈরি থেকে বিস্ফোরণেও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির মাধ্যমে অনায়াসেই অন্য ব্যক্তির মুখাবয়ব হুবহু নকল করা যায়। এই 'ডিপফেইক' প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতারণা করছে প্রতারকরা। রয়টার্স সূত্রের খবর, উত্তর চীনের এক বাসিন্দা 'ডিপফেইক' প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাঁচ কোটি টাকার প্রতারণা করেছেন।
প্রযুক্তির কারণে অনেক ক্ষেত্রে ঘটছে মূল্যবোধের অবক্ষয়। সংঘটিত হচ্ছে বিভিন্ন অপরাধ। ঘটছে যুবসমাজের নৈতিক স্খলন। এর জন্য দায়ী টিকটক, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম।
ফেসবুকে নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক করে অশ্লীলতা প্রচারসহ বস্ন্যাকমেইলিংয়ের ঘটনা ঘটছে অহরহ। অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো ভিডিও করছে এবং পরে সেই ভিডিওগুলো বন্ধুদের দেখাচ্ছে, ইন্টারনেটে শেয়ার করছে। এছাড়াও আছে হাই-টেক ফোন, ভিডিও ফ্যাসিলিটি এবং পর্নোগ্রাফির ছড়াছড়ি। ছাত্রছাত্রী, কিশোর, যুবক দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১২ ঘণ্টাই অনলাইনে ফোনে দিনরাত পার করে দিচ্ছে। সারা রাত ধরে কথা বলছে, ক্ষুদে বার্তা আদান-প্রদান করছে। এতে তাদের যেমন সময় ও অর্থের অপচয় হচ্ছে তেমনি মেধারও অপচয় হচ্ছে। ভার্চুয়াল অন্তর্জালের দুনিয়ায় যুক্ত হয়ে তারা প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে শৈশব-কৈশোরের আমেজ, উদ্দীপনা ও আনন্দ-বেদনার পরাবাস্তবতার অনিন্দ্য জীবনকে, হারাচ্ছে সামাজিকতা, মানবিকতা ও নৈতিকতা, ডুবছে বোধবুদ্ধিহীন নিরেট মেকি জগতের অন্ধকার তিমিরে, নিঃসঙ্গতার অতল গহ্বরে। প্রযুক্তির মোহনীয় জগতের আড়ালে মানুষের মধ্যে বাড়ছে দূরত্ব, নষ্ট হচ্ছে হৃদ্যতা, আত্মীয়তা, বাড়ছে সামাজিক দূরত্ব; ঘটছে বিচ্ছেদ, ভাঙ্গছে পরিবার, নষ্ট হচ্ছে সম্পর্ক; অন্ধকারে ডুবছে সমাজ। তাছাড়া প্রযুক্তির কারণে মানুষ দিনকে দিন হয়ে পড়ছে অলস ও নিঃসঙ্গ। বাংলাদেশে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা প্রাইভেসি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। তার জন্য যুগোপযোগী আইন করা জরুরি। ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ করা নিয়ে কাজ করা সংস্থা, ডেটাবেজ, ওয়েব-সার্ভারসহ যে কোনো উৎস থেকে তথ্য ফাঁস হলে শাস্তির বিধান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাখা উচিত। অনলাইনে সব ধরনের প্রতারণার জন্য কঠোর শাস্তিযোগ্য আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। অনলাইনে প্রতারণার উদ্দেশ্যে লোভনীয় বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করতে ও যেসব গ্রাহক অনলাইন বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের প্রতিরোধেও আইন করা দরকার। ফেসবুকসহ অনলাইনে ব্যক্তিগত শত্রম্নতাবশত হোক বা বস্ন্যাকমেইলিংয়ের উদ্দেশ্যে হোক কারো বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো, চরিত্র হনন ও ব্যক্তিগত আক্রমণ রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন জরুরি। এর সঙ্গে স্মার্টফোনের ব্যবহার সীমিত করা উচিত। বিশেষ করে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের এর ব্যবহার থেকে বিরত রাখা, বিদ্যালয়ে, চলমান যানবাহনে, রাস্তাঘাট পারাপারে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন করা উচিত। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সর্বপ্রকার ক্ষতি ও বিপদগামিতা থেকে সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য।
অমল বড়ুয়া : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট