মানুষের কার্যকলাপের ফলে জলাশয়ে সৃষ্ট দূষণই হলো পানিদূষণ। জলাশয় বলতে হ্রদ, নদী, সমুদ্র, ভূগর্ভস্থ সিক্ত শিলাস্তরকে বোঝায়। স্বাভাবিক পরিবেশে পানিতে দূষণকারী পদার্থ উপস্থিত থাকলে তাকে পানিদূষণ বলা হয়। অপর্যাপ্তভাবে পরিশোধিত বর্জ্যপানি যদি স্বাভাবিক জলাশয়ে জমা হয়, তবে তা জলজ বাস্তুতন্ত্রের পরিবেশগত অবনতি ঘটাতে পারে। এর ফলে, ভাটির দিকে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে জনস্বাস্থ্যের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তারা এই দূষিত পানি পান এবং গোসলের কাজে অথবা সেচের কাজে ব্যবহার করতে পারে। পানিবাহিত রোগের প্রকোপে সারা বিশ্বে যত মানুষ আক্রান্ত হয় বা মারা যায়, তাদের বেশিরভাগই ঘটে পানিদূষণের কারণে।
বহু সময় ধরে ক্রমবর্ধিত কাজের ফলেই দূষণ সৃষ্টি হয়। দূষিত জলাশয়ে থাকা অথবা এর সংস্পর্শে আসা সমস্ত গাছ এবং জীবই এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দূষণের ফলে একক প্রজাতিগুলো ধ্বংস হতে পারে এবং এরা যে স্বাভাবিক জৈব সংগঠনের অন্তর্গত তারও ক্ষতি হতে পারে। পানি দূষণের কারণ হিসেবে প্রচুর রাসায়নিক এবং রোগ-জীবাণুর কথা বলা যেতে পারে; তাছাড়া অনেক ভৌত স্থিতিমাপও রয়েছে। দূষকগুলো জৈব অথবা অজৈব পদার্থের হতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রাও দূষিত পানির কারণ হতে পারে। তাপীয় দূষণের একটি সাধারণ কারণ হলো তাপ বিদু্যৎকেন্দ্র এবং শিল্পোৎপাদন কেন্দ্রে কুল্যান্ট হিসেবে পানির ব্যবহার। উচ্চ জলীয় তাপমাত্রা অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেয়- যার ফলে মাছ মারা যায় এবং খাদ্যশৃঙ্খলের উপাদানও পরিবর্তিত হয়, প্রজাতির বাস্তুতন্ত্র কমে আসে এবং তাপের ফলে সৃষ্ট ব্যাকটেরিয়ার নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয়।
পানির নমুনা বিশ্লেষণ করে পানিদূষণ পরিমাপ করা হয়। ভৌত, রাসায়নিক এবং জৈব পরীক্ষা করা হতে পারে। সঠিক পরিকাঠামো এবং পরিচালনা পরিকল্পনার দ্বারাই পানিদূষণকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। পরিকাঠামোর মধ্যে থাকতে পারে বর্জ্যপানি পরিশোধক কারখানা। বর্জ্যনিকাশী পরিশোধক কারখানা এবং শিল্পজাত বর্জ্যপানির পরিশোধক কারখানা অশোধিত বর্জ্যপানির হাত থেকে জলাশয়গুলোকে রক্ষা করতে পারে। কৃষিখামারের ক্ষেত্রে কৃষিজ বর্জ্যপানি পরিশোধন এবং নির্মাণ স্থানে ভূমিক্ষয় রোধের ব্যবস্থাও পানিদূষণ প্রতিরোধ করতে পারে।
পানিদূষণ রোধের আরেকটি উপায় হলো প্রকৃতিকেন্দ্রিক সমাধান। স্রোতের গতি এবং এর পরিমাণ কমিয়ে শহরের পানি নিকাশী ব্যবস্থার কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পানিদূষণের জন্য সেরা পরিচালনা ব্যবস্থা হিসেবে পানির পরিমাণ কমানো এবং পানির মান উন্নত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পানি যদি মানুষবাহিত দূষক দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে সেই পানিকে দূষিত বলা হয়। এসব দূষণের ফলে এই পানি মানুষের ব্যবহারের যোগ্য হতে পারে না, যেমন পানিপানের অযোগ্য হয়ে যায় অথবা এই পানির জীবগোষ্ঠী ধারণের ক্ষমতাই নষ্ট হয়ে যায়, যেমন মাছ। আগ্নেয়গিরি, শৈবাল পুষ্প, ঝড়, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক ঘটনার ফলেও পানির গুণাগুণে এবং এর বাস্তুতান্ত্রিক অবস্থায় প্রভূত পরিবর্তন দেখা দেয়।
পানিদূষণ একটি বিশ্বব্যাপী গুরুতর সমস্যা। এর জন্য সর্বস্তরে পানিসম্পদ নীতির মূল্যায়ন এবং পুনর্মূল্যায়ন জরুরি। মনে করা হয়, বিশ্বে যত রোগ ও মৃতু্য হয়, তার মুখ্য কারণ হলো পানিদূষণ। বৈশ্বিক সামুদ্রিক পরিবেশগত সমীক্ষা নামক সংস্থার মতে পানিদূষণ হলো অন্যতম প্রধান একটি পরিবেশগত সমস্যা- যেটা পরবর্তী দশকগুলোতে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বকে সংকটে ফেলে দিতে পারে। ফাইটোপস্ন্যাঙ্কটন যেগুলো ৭০% অক্সিজেন উৎপন্ন করে এবং পৃথিবীর কার্বন ডাই-অক্সাইডের একটি বড় অংশ শোষণ করে, পানি দূষণ তাদের জন্য একটি অন্যতম সমস্যা।
উন্নয়নশীল দেশে চূড়ান্ত পানি দূষণের পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোও কিন্তু দূষণজনিত সমস্যা নিয়ে লড়াই করে চলেছে। ভূ-পৃষ্ঠতলীয় পানিদূষণের মধ্যে রয়েছে নদী, হ্রদ এবং সমুদ্রের দূষণ। ভূ-পৃষ্ঠতলীয় পানিদূষণের একটি বিভাগ হলো সামুদ্রিকদূষণ। সমুদ্রে দূষিত পদার্থের আগমনের একটি সাধারণ পথ হলো নদীর পানি। এর একটি উদাহরণ হলো, নর্দমার পানি এবং কারখানার বর্জ্য সরাসরি সমুদ্রে গিয়ে ফেলা। উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই বিশেষ করে এই ধরনের দূষণ দেখা যায়।
পস্নাস্টিক আবর্জনা সমুদ্রের বড় বড় বলয়ের মধ্যে আটকে পড়ে। পস্নাস্টিক আবর্জনাগুলো সামুদ্রিক দূষণে সৃষ্ট বিষাক্ত পদার্থগুলোকে শোষণ করে নেয়- যার ফলে সামুদ্রিক জীব এগুলো খেয়ে ফেললে তাদের শরীরেও বিষ প্রবেশ করতে পারে। এসব দীর্ঘজীবী পদার্থগুলো অনেক সময়েই শেষমেষ সামুদ্রিক পাখি এবং প্রাণীদের পেটে চলে যায়। এর ফলে তাদের হজমের পথ আটকে যায়। যার ফলে তাদের খিদে কমে যায় অথবা এর থেকে তারা অনাহারেও ভুগতে পারে। মূল দূষক ছাড়াও, অনেক ধরনের অপ্রত্যক্ষ প্রভাব থাকে। যেমন ভূপৃষ্ঠে পানির স্রোতে পলি ভেসে থাকলে পানিস্তম্ভের মধ্যে দিয়ে সূর্যরশ্মি প্রবেশ করতে পারে না এবং এর ফলে জলজ উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
পানিদূষণকারী নির্দিষ্ট পদার্থগুলো রাসায়নিক, রোগসংক্রামক জীবাণু এবং ভৌত পরিবর্তন যেমন উচ্চ তাপমাত্রা এবং বিবর্ণতার মতো বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। রাসায়নিক এবং অন্যান্য পদার্থ যেমন ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ প্রভৃতি পদার্থ প্রকৃতিতে তাদের ঘনত্ব দ্বারা বোঝা যায়, তারা পানির স্বাভাবিক উপাদান নাকি দূষক। প্রাকৃতিক উপাদানের উচ্চ ঘনত্ব জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর ওপরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেওয়া পদার্থের মধ্যে প্রাকৃতিক বস্তু থাকতে পারে, যেমন উদ্ভিদের অংশ, আবার মনুষ্যসৃষ্ট রাসায়নিক পদার্থও থাকতে পারে। অন্যান্য প্রাকৃতিক এবং অ্যানথ্রোপোজেনিক পদার্থ পানিতে টার্বিডিটি সৃষ্টি করতে পারে যা আলো প্রবেশে বাধা দেয়, উদ্ভিদের বৃদ্ধি ব্যাহত করে এবং মাছের কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে ফুলকাকে আটকে দেয়।
পানির ভৌত রাসায়নিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য দায়ী যেসব বিষয় তা হলো অম্স্নত্ব, বৈদু্যতিক পরিবাহিতা, তাপমাত্রা এবং ইউট্রোফিকেশন। ইউট্রোফিকেশনের মাধ্যমে একটি বাস্তুতন্ত্রে রাসায়নিক উপাদানগুলোকে বাড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে বাস্তুতন্ত্রটির প্রাথমিক উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়। ইউট্রোফিকেশনের মাত্রার ওপর পরিবেশের নেতিবাচক প্রভাব নির্ভর করে যেমন এর ফলে অ্যানোক্সিয়া হতে পারে এবং পানির মান গুরুতরভাবে হ্রাস পেতে পারে- যার ফলে মাছ এবং অন্যান্য প্রাণিকুলের ক্ষতি হয়।
রোগসৃষ্টিকারী অণুজীবগুলোকে রোগ সংক্রামক জীবাণু বা প্যাথোজেন বলা হয়। এসব জীবাণুগুলো মানবদেহে বা প্রাণীদেহে পানিবাহিত রোগ সৃষ্টি করতে পারে। কলিফর্ম ব্যাকটিরিয়া পানিবাহিত রোগের প্রকৃত কারণ না হলেও এদেরই পানিদূষণের একটি ব্যাকটেরীয় মানদন্ড হিসেবে সাধারণভাবে ব্যবহার করা হয়। রোগ সংক্রামক জীবাণু সেই নির্দিষ্ট স্থানটির শৌচব্যবস্থা অথবা অপর্যাপ্তরূপে শোধিত নিকাশী পানি থেকে অধিক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে। পুরনো শহরের পুরনো পরিকাঠামোর নিকাশী ব্যবস্থায় অবাঞ্ছিত বহির্গমনের ফলে নর্দমার দূষিত পানি বাইরে চলে আসতে পারে। কিছু শহরে সংযুক্ত নিকাশী ব্যবস্থা আছে যেগুলোর দূষিত পানি ঝড় বৃষ্টির সময় অপরিশোধিত অবস্থাতেই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। গৃহপালিত পশুসংক্রান্ত কাজকর্ম যেখানে চলে সেসব জায়গা খারাপভাবে পরিচালিত হলেও রোগজীবাণুর সংক্রমণ হতে পারে।
জৈব পানি দূষকের মধ্যে যেগুলো পড়ে তা হলো: ডিটারজেন্টস, রাসায়নিকভাবে জীবাণুমুক্ত পানীয়জলের মধ্যে থাকা জীবাণুধ্বংসকারী উপজাত পদার্থ যেমন: ক্লোরোফর্ম, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণজাত বর্জ্য, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে অক্সিজেনের চাহিদাযুক্ত পদার্থ, চর্বি, গ্রিজ, কীটনাশক এবং ভেষজনাশক, বিভিন্ন ধরনের অর্গ্যানোহ্যালাইডস এবং অন্যান্য রাসায়নিক যৌগ, পেট্রোলিয়াম হাইড্রোকার্বন, যেমন জ্বালানি এবং পিচ্ছিলকারক তেল, উদ্বায়ী জৈব যৌগ, ক্লোরিনযুক্ত দ্রাবক, পলিক্লোরিনেটেড বাইফিনাইল, ট্রাইক্লোরোইথিলিন, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি দ্রব্য এবং প্রসাধনী দ্রব্যে উপস্থিত বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগ, ড্রাগদূষণ- যার মধ্যে রয়েছে ওষুধ এবং তাদের বিপাকজাত দ্রব্য। এসব অণুগুলো এতই ক্ষুদ্র যে দামি ও উন্নত শোধক কারখানা ছাড়া এদের মুক্ত করা বেশ জটিল।
অজৈব পানি দূষণকারী পদার্থগুলোর মধ্যে রয়েছে: শিল্পকারখানার বর্জ্য নিষ্কাশনের দ্বারা সৃষ্ট অম্স্নত্ব, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের বর্জ্য থেকে প্রাপ্ত অ্যামোনিয়া, শিল্পকারখানার উপজাত হিসেবে প্রাপ্ত রাসায়নিক বর্জ্য, নাইট্রেট এবং ফসফেট জাতীয় উপাদানযুক্ত সার- যা কৃষিজমি থেকে এবং বাণিজ্যিক ও গৃহস্থ ব্যবহারের ফলেও বৃষ্টির জলের সঙ্গে যুক্ত হয়, মোটর গাড়ির ভারী ধাতব, নির্মীয়মাণ অঞ্চল, বৃক্ষচ্ছেদন, জুমচাষ অথবা ভূমি নিষ্কাশন অঞ্চল থেকে প্রবাহিত পানির পলি। পানি দূষণকারী দৃশ্যমান বড় বড় পদার্থ- যেগুলো শহরের ঝোড়ো জলের পরিপ্রেক্ষিতে ভাসমান বলা চলে, এ ধরনের পদার্থগুলোকে নিম্নলিখিতভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়: মাটিতে মানুষের দ্বারা পরিত্যক্ত আবর্জনা, ছোট ছোট সর্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা পস্নাস্টিকের টুকরো এবং পরিত্যক্ত ভাঙা জাহাজ।
উন্নত দেশের শহরে, পৌরসভার বর্জ্যজল, শোধনকারী কারখানা দ্বারা বিশেষভাবে পরিশোধিত হয়। ভালোভাবে পরিকল্পিত এবং পরিচালিত ব্যবস্থার মাধ্যমে ৯০ শতাংশ বা তার বেশি দূষণকারী পদার্থ থেকে দূর করা যায়। কোনো কোনো কারখানায় অতিরিক্ত ব্যবস্থা থাকে যাতে রাসায়নিক উপাদান এবং রোগ সংক্রামক জীবাণু দূর করা যেতে পারে, কিন্তু এসব আরো উন্নত শোধনমূলক পদক্ষেপ ক্রমশই আরো বেশি ব্যযবহুল হয়ে পড়ছে। কেন্দ্রীভূত শোধনকারী কারখানার পরিবর্তে পরিবেশভিত্তিক সমাধানও ব্যবহার করা হচ্ছে।
দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য লো-ইমপ্যাক্ট ডেভেলপমেন্ট প্রযুক্তিরও ব্যবহার করা যেতে পারে যেমন সবুজ ছাদ স্থাপন এবং রাসায়নিকের উন্নত ব্যবহার।
মো. আরাফাত রহমান : কলাম লেখক