সরকারি কর্মকর্তারা কেন রাজনৈতিক বক্তব্য রাখেন
বিভিন্ন সময় প্রশাসন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তারা রাজনৈতিক বক্তব্য দেন মূলত যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা না থাকার সুযোগে। গুরুতর এসব অভিযোগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কারণ দর্শানোর নোটিশ ও কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করা হয়। সরকারি চাকররিজীবীরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, তাদের কাজ জনসাধারণকে সেবা দেওয়া। পাশাপাশি নির্ধারিত রুটিন কাজ করা। কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য পক্ষপাতমূলক বক্তব্য রুটিন কাজের মধ্যে পড়ে না।
প্রকাশ | ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মোবারক আজাদ
বিভিন্ন সময়ে নানা সভা-সেমিনারে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রকাশ্যে রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে দেখা যায়। প্রযুক্তির কল্যাণে এসব বক্তব্যের কিছু ভিডিও আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। এতে নানা আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। কারণ এসব কর্মকর্তার বক্তব্য সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার গুরুতর লঙ্ঘন।
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর ২৫(১) অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারীর কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগ নেই। তারপরও কেউ কেউ সরকারি চাকরির পদে থেকেই রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে বিতর্কে জড়াচ্ছেন। ফলে জনসাধারণের মধ্যে তাদের নিয়ে নানা প্রশ্ন ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
মূলত পাঁচ কারণে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন বলে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে।
যেসব কারণে রাজনৈতিক বক্তব্য দেন সরকারি কর্মকর্তা। তার মধ্যে রয়েছে-পদোন্নতি-বদলি, দলীয় নেতাদের সান্নিধ্যে থেকে সহজে দায়িত্ব পালন করা, চাকরি শেষে রাজনীতিতে যাওয়ায় আকাঙ্ক্ষা, অনেকে ছাত্রজীবন কিংবা পারিবারিকভাবে কোনো দলের মতাদর্শ থাকায় সেটিও জাহির করা ও একই সঙ্গে কঠোর শাস্তির নজির না থাকা।
বিভিন্ন সময় প্রশাসন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তারা রাজনৈতিক বক্তব্য দেন মূলত যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা না থাকার সুযোগে। গুরুতর এসব অভিযোগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কারণ দর্শানোর নোটিশ ও কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করা হয়। সরকারি চাকরিজীবীরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, তাদের কাজ জনসাধারণকে সেবা দেওয়া। পাশাপাশি নির্ধারিত রুটিন কাজ করা। কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য পক্ষপাতমূলক বক্তব্য রুটিন কাজের মধ্যে পড়ে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক জাকির হোসেনের মতে- সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাষ্ট্রের সেবক। কোনো দলের কর্মচারী না। তবে, কোনো দলের প্রতি ভালোবাসা এবং আদর্শের প্রতি ভালোবাসা থাকতেই পারে। তবে সেটা কখনোই দায়িত্ব পালনকালে কোনো সভায় কোনো দলের রাজনৈতিক দলের জন্য ভোট চাইলে সেটা পক্ষপাতমূলক আচরণ হয়ে গেল এবং কর্মের নিয়োগের যে শর্ত, সেটা লঙ্ঘন হয়ে গেল।
সরকারি কর্মকর্তাদের উলেস্নখযোগ্য কিছু রাজনৈতিক বক্তব্য: গত ১৫ আগস্ট শোক দিবসের আলোচনা সভায় কুমিলস্নার নাঙ্গলকোটে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় সংসদ সদস্যের জন্য ভোট চেয়েছেন থানার ওসি মো. ফারুক হোসেন। একই দিন জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ মডেল থানার ওসি শ্যামল চন্দ্র ধর আওয়ামী লীগকে নিজের দল দাবি করে নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়েছেন। গত ১১ সেপ্টেম্বর এই সরকারকে আবার ক্ষমতায় আনতে হবে এমন এক এমন বক্তব্য দেন জামালপুরের জেলা প্রশাসক ইমরান আহমেদ। পরে তাদের তিনজনকেই পরে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র থেকে প্রত্যাহার করা হয়।
পেছনে তাকালে দেখতে পাই ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রম্নয়ারি প্রহসনের নির্বাচনের প্রতিবাদে ২৩ মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তৎকালীন ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জনতার মঞ্চ। সেখানে সরকারি কর্মচারীরা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। সেটা ক্ষমতাসীন দলের বিপক্ষ হয়ে তারা অংশ নেন। সে সময়ের সরকার সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এমনকি পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে বরং তাদের অনেককে পুরস্কৃত করেন। মূলত শাস্তি না হয়ে পুরস্কৃত হওয়ায় অন্যরাও উৎসাহিত হচ্ছে।
সরকারি কর্মচারী বিধিমালায় বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি নির্ধারিত আছে। কেউ অসদাচরণ, ক্ষমতার অপব্যবহার বা অন্য কোনো অপরাধ করলে সব অপরাধেরই শাস্তি মূলত দুই ধরনের- লঘুদন্ড ও গুরুদন্ড। লঘুদন্ড আছে চার ধরনের- তিরস্কার, নির্দিষ্ট মেয়াদে পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, জরিমানা এবং বেতন গ্রেডেও অবনমন। আর গুরুদন্ডগুলোও চার ধরনের- বেতন গ্রেডের অবনমন, বাধ্যতামূলক অবসর, চাকরি থেকে অপসারণ এবং বরখাস্ত। এ ছাড়া কোনো অভিযোগ এলে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নোটিশ, তদন্ত ও বিভাগীয় মামলা হয়।
খসড়া চূড়ান্ত না হওয়ায় গুরুতর শাস্তির নজির নেই। পেছনে থাকালে দেখতে পাই, সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯ সালেরটি যুগপোযোগী করতে ২০০২ ও ২০১১ সালে দুই দফায় এই বিধিমালা সংশোধন করা হয়। এরপরও কিছু বিষয় অস্পষ্ট থাকায় ২০১৪ সালে আবার বিধিমালা সংশোধনের কাজ শুরু হয়। কিন্তু দীর্ঘ ৯ বছরেও সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার খসড়া চূড়ান্ত হয়নি। খসড়া বিধিমালায় ৩৪টি নির্দেশনা আছে। কিন্তু প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এ ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্যের বিষয়ে কিছু বলা নেই। এজন্য অনেকে কোনো কিছু তোয়াক্কা না করেই বিধিমালার ফাঁকফোকরে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন। এই ক্ষেত্রে শাস্তি শুধু প্রত্যাহার।
মোবারক আজাদ : কলাম লেখক