অর্থনীতির সংস্কারে মনোযোগ দিতে হবে
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখন তিনটি মূল চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে মূল্যস্ফীতি। অন্যান্য খাতের পাশাপাশি আর্থিক খাতের দুর্বলতাও অন্যতম চ্যালেঞ্জ। তবে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার, যেখানে কার্যকর মুদ্রানীতি ও বাজারভিত্তিক ডলারের মূল্য নির্ধারণ অন্যতম পদক্ষেপ হতে পারে। আর রাজস্ব বৃদ্ধিও সমস্যার উত্তরণে বড় ভূমিকা রাখবে।
প্রকাশ | ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
রেজাউল করিম খোকন
ডলার সংকটের পাশাপাশি দেশের ব্যাংকগুলো এখন টাকার সংকটেও ভুগছে। ফলে ব্যাংকগুলো যে হারে টাকা ধার করে, সেই হার দ্রম্নত বাড়ছে। অনেক ব্যাংককে উচ্চ সুদে আমানতও সংগ্রহ করতে হচ্ছে। জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার ও খাত বিশেষজ্ঞরা তারল্যের এই সংকটের জন্য তিনটি কারণকে দায়ী করছেন। এগুলো হলো- বারবার ছাড় ও সুবিধা দেওয়ার কারণে ঋণ পরিশোধের সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে যাওয়া, সরকারের উচ্চ সুদে টাকা ধার নেওয়া ও বেশি দামে ডলার সংগ্রহ। তারল্য সংকট মোকাবিলায় এখন ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ অর্থ ধার করতে হচ্ছে। সরকারের রাজস্ব আদায় কম, তাই তারা ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে উচ্চ সুদে টাকা ধার করে যাচ্ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারকে খরচ কমিয়ে আনতে হবে, নতুন প্রকল্প নেওয়া বন্ধ করতে হবে। ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছর শেষে ঋণ পরিশোধে আবার ছাড় মিলবে- এমন প্রত্যাশায় অনেক ব্যবসায়ী গ্রাহক ঋণের টাকা ব্যাংকে ফেরত না দিয়ে অপেক্ষা করেছেন। পাশাপাশি সরকার উচ্চ সুদে বন্ডের মাধ্যমে টাকা ধার করায় ব্যাংকগুলো আমানত পেতে সমস্যায় পড়েছে। অন্যদিকে, ডলার কিনতে ব্যাংকগুলোকে ব্যয় করতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। দুই বছর আগে যে ডলার কিনতে ৮৫ টাকা খরচ হতো, তার আনুষ্ঠানিক দরই এখন ১১০ টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিকভাবে ১২৩ টাকাও খরচ করতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। এই টাকা তাৎক্ষণিকভাবে গ্রাহকদের থেকে পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নানা আর্থিক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তারল্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার করতে হচ্ছে। এসব ধার ১, ৭ ও ১৪ দিন মেয়াদি। ভালো হিসেবে পরিচিত অনেক ব্যাংকও এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে থাকা নগদ জমা হিসাবের (সিআরআর) ঘাটতি পূরণে টাকার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই দ্বারস্থ হচ্ছে। সরকারের রাজস্ব আদায় কম, তাই তারা ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে উচ্চ সুদে টাকা ধার করে যাচ্ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারকে খরচ কমিয়ে আনতে হবে, নতুন প্রকল্প নেওয়া বন্ধ করতে হবে। সরকারি প্রকল্পগুলো যেন টাকা বানানোর যন্ত্র। আছে বিপুল অপচয়ও। এখন ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার আমানতের সুদহারের চেয়ে কম রাখতে হবে। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোটা ভুল নীতি ছিল। খেলাপিদের ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়ার মতো ভুল নীতি আর নেওয়া যাবে না। এসব করলেই তারল্য পরিস্থিতি ঠিক হয়ে আসবে। ঋণ ও আমানতের নিয়ন্ত্রিত সুদহারের ব্যবস্থা তুলে এ খাতে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এরপর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাইয়ে সুদহার নির্ধারণে নতুন নিয়ম চালু করে। ঋণের সুদ ৯ শতাংশ ও আমানতের সুদ ৬ শতাংশ- বহুল সমালোচিত এই ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে স্মার্ট সুদহার হিসেবে পরিচিত নতুন পদ্ধতি চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারল্য সংকটের মধ্যে ব্যাংকগুলোর একটি বড় অংশই এখন আমানতের ওপর ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। সংকটে পড়ে কোনো কোনো ব্যাংক এমনকি ১২ শতাংশ সুদেও তহবিল সংগ্রহ করছে বলে জানা গেছে। আমানতে ওপর সুদের হার বাড়ার কারণে ঘরে রাখা টাকা ব্যাংকে ফেরানোর প্রবণতা বেড়েছে। তবে আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি। ফলে ব্যাংকে টাকার সংকট চলছেই।
আমানতের বাজারে একটা খরা চলছে। সুদহার বেশ বেড়ে গেছে, এরপরও চাহিদামতো আমানত মিলছে না। অনেকে সরকারের বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করছে। কারণ, তাতে ভালো সুদ পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে, ঋণ আদায়ও আশানুরূপ হচ্ছে না। এ কারণে তারল্য পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে অনেক ব্যাংক। তবে আরও কিছুদিন পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে আশা করা যায়। গত জুলাই-অক্টোবর সময়ে ঋণের চেয়ে আমানত বেশি বেড়েছে। এই চার মাস সময়ে আমানত বাড়লেও সম্প্রতি শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংকে আবার চলতি হিসাবে ঘাটতি হয়েছে। আর এই খবর আলোচনায় আসার পর এসব ব্যাংকের আমানতে ধাক্কা লেগেছে। এখন ডলারের বাজারের মতো প্রতিটি ঋণের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়া নজরদারি শুরু করতে হবে। সরকারের ঋণের সুদ কমলে তারল্য পরিস্থিতি ঠিক হয়ে আসবে। নির্বাচনের কারণে বছর শেষের আগে ছাড় দেওয়া হবে- এই আশায় অনেকে ঋণের কিস্তি দেননি। পাশাপাশি গত তিন বছরে কোভিড মহামারি ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়ার কারণে ঋণ পরিশোধের সংস্কৃতিই অনেকটা নষ্ট হয়েছে। দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ এবং তারচেয়েও বেশি পরিমাণ ঋণের কিস্তি সময়মতো আদায় না হওয়ায় সংকট দীর্ঘতর হচ্ছে। ঋণ পরিশোধে অনীহার কারণেও বছর শেষে এসে ব্যাংকগুলো তারল্য ব্যবস্থাপনা করতে হিমশিম খাচ্ছে। সাধারণত প্রতিটি ব্যাংককে পরিচালনা পর্ষদ থেকে মুনাফার নির্দিষ্ট লক্ষ্য বেঁধে দেয়। ফলে ঋণ আদায় না হলেও কাগজেপত্রে মুনাফা দেখানোর চেষ্টা করছে অনেক ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় পরিস্থিতি সামলাতে টাকা ধার দেওয়ার পরিমাণ বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ট্রেজারি বিল ও বন্ডের বিপরীতে এই টাকা ধার দেওয়া হচ্ছে। এক দিন মেয়াদি রেপো সুবিধা দেওয়া হচ্ছে মূলত সিআরআর ঘাটতি পূরণের জন্য। এ ছাড়া ৭ ও ১৪ দিন মেয়াদি টাকা ধারের পাশাপাশি বিশেষ ব্যবস্থাতেও টাকা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর বাইরে সংকটে পড়া পাঁচটি ইসলামী ধারার ব্যাংককে বিশেষ ব্যবস্থায় টাকা ধার দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ, এসব ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি রয়েছে। লেনদেনব্যবস্থা সচল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক বছর ধরে এসব ব্যাংককে এই সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক খাতের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে উদ্যোগ নিতে হবে। শরিয়াহ ব্যাংকগুলোতে যা চলছে, তা আর বরদাশত করা ঠিক হবে না। তাহলেই এই খাত ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে আসবে। না হলে ব্যাংক খাতই পুরো অর্থনীতিকে ভোগাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশ্য খেলাপিদের নতুন করে আর ছাড় দিতে চাইছে না। যদিও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো ইতোমধ্যে ছাড়ের জন্য তৎপরতা শুরু করেছে। তারা গভর্নরকে চিঠি দেওয়ার পাশাপাশি সরকারের উচ্চপর্যায়ে দেখা করেও এই দাবি জানিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক সম্মেলনে বলেছেন, বছরের পর বছর নানা ছাড় দেওয়া হলেও খেলাপি ঋণ শুধু বাড়ছে। এখন মনে হচ্ছে, এসব ছাড় কোনো কাজে আসেনি। এখন শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। খেলাপি ঋণ কমাতে শিগগির রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে। ঋণের সুদ ৯ শতাংশ থেকে সাড়ে ১১ শতাংশ হয়েছে। ব্যাংকগুলো এখন সতর্কতার সঙ্গে ঋণ দিচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে, আগের মতো আর নীতি ছাড় দেওয়া হবে না।
দেশের অর্থনীতির স্বার্থে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার করা প্রয়োজন। কষ্টদায়ক হলেও সংস্কার করতে হবে। তাতে অর্থনীতিতে এক ধরনের ভারসাম্য আসবে। প্রথমত, ব্যাংক খাতে সুশাসন ও রাজস্ব আয় বাড়াতে নতুন ব্যাংক কোম্পানি ও আয়কর আইনের বাস্তবায়ন জরুরি। এই দুই আইনের যথাযথভাবে বাস্তবায়নে কিছু মানুষ হয়তো চাপে পড়বেন। সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজনীতিবিদের সদিচ্ছা লাগবে। দ্বিতীয়ত, ডলারের দাম বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। হয়তো নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। ডলারের দামে বড় ধরনের সমন্বয় করলে পণ্য আমদানির ব্যয় বাড়বে। তখন আমদানি শুল্ক কমানোর মতো ব্যবস্থা নিতে হবে। যদিও ডলারের দাম বাড়লে পণ্য রপ্তানিতে প্রতিযোগিতাসক্ষমতা বাড়বে। রপ্তানিকারকদের প্রণোদনা দিতে হবে না। ব্যাংক-মাধ্যমে প্রবাসী আয় আসার হারও বাড়বে। তৃতীয়ত, ব্যাংক ঋণের সুদের হারও বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতি, ভূ-রাজনীতি, ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জসহ বিভিন্ন বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত নতুন শ্রমনীতির অধীনে নিষেধাজ্ঞা আসার শঙ্কা আছে কিনা, বাণিজ্যে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসবে কি আসবে না; এলে কোন পদ্ধতিতে আসবে- সেটি অনুমান করা কঠিন। তবে আমরা দেখেছি, শ্রম অধিকার ও কর্মপরিবেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছে। এমন প্রেক্ষাপটে বলতে চাই, আমাদের যেসব জায়গায় উন্নতি করার প্রয়োজন আছে, সেগুলো যেন আমরা করি। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে সেগুলো আমরা করতে পারি। শ্রমিকরা এক দিনে সবকিছু চাচ্ছেন না। তাদের পাশ কাটিয়ে কিংবা সঠিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সমস্যা বাড়ে। ফলে তাদের কথা শুনে সমস্যা সমাধানে একটি রূপকল্প (রোড ম্যাপ) প্রণয়ন করা জরুরি। যুক্তরাষ্ট্র কী করবে না করবে তারা জানে। নিষেধাজ্ঞা দিতেও পারে। তবে আমরা যত শৈথিল্য দেখাব, তত নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে দেশটির আকাঙ্ক্ষা বাড়বে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মৌসুম চলছে। সরকার দলীয় প্রার্থীদের অর্থসম্পদ কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ার প্রার্থীদের হলফনামা দেখে সবাই বিস্মিত, চমৎকৃত ও আশ্চর্যান্বিত হয়েছে। এত কম সময়ে তারা এত টাকার মালিক হলেন কীভাবে, সেটি একটি প্রশ্ন। যদিও এক কোটি টাকার জমির দাম এক লাখ টাকা উলেস্নখ করা হয়েছে। ফলে হলফনামার থেকেও প্রকৃত সম্পত্তির পরিমাণ অনেক বেশি হবে। রাজনৈতিক দলের উচিত তাদের প্রার্থীদের সম্পদের বিশ্লেষণ প্রকাশ করা। দুর্নীতি দমন কমিশনেরও (দুদক) কাজ করা দরকার যে প্রার্থীদের এই বিপুল পরিমাণ সম্পদ যৌক্তিক, অযৌক্তিক নাকি অনৈতিক। রাজনীতি আর অর্থনীতিকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। গণতান্ত্রিক দেশে ভালো রাজনীতি মানেই হলো ভালো অর্থনীতি। সেদিকে সবার খেয়াল রাখতে হবে। রাজনীতিবিদরা যদি সংস্কারের উদ্যোগ না নেন, তাহলে উদ্যোক্তাদের যেটুকু করা সম্ভব, তা-ও সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশে যেটুকু অর্জন হয়েছে, তার পেছনে শ্রমিক ও উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি রাজনীতিবিদদের বড় অবদান রয়েছে। সামনের দিনে আরও অর্জন করতে পারলে তাদের অবদান থাকবে। না করতে পারলে তাদের বড় ধরনের ব্যর্থতা থাকবে। অর্থনীতি এখন বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছে। এতে অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়ছে। এক ধরনের অনিশ্চয়তা জেঁকে বসেছে সবার মধ্যে। সাধারণত চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, দিনমজুর থেকে শুরু করে দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ, অর্থনীতিবিদ সবাই এক ধরনের উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় পার করছেন এখন। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে। বিশেষ করে বিনিময় হার ধরা বাঁধার বাইরে রাখা, মুদ্রানীতি আধুনিক করা এবং রাজস্ব খাতের সংস্কারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বহিঃখাতের সমস্যা সমাধানে বিনিময় হারে যেসব অসঙ্গতি আছে, তা দূর করতে হবে। এ জন্য বিনিময় হারের সীমা তুলে দেওয়া উচিত- যা আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতের মধ্যে বিনিময় হারের পার্থক্য কমে আসতে সহায়তা করবে। মূলধন কম এমন ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে নিত্যপণ্যের ওপর শুল্ক কমানোর সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক। আর্থিক খাতের ঝুঁকি আরও বেড়ে যেতে পারে, যদি খারাপ ঋণ বেড়ে যায় এবং ব্যাংক খাতের তারল্যের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করে। এছাড়া রাজস্ব আদায় বাড়াতে সংস্কার করতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখন তিনটি মূল চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে মূল্যস্ফীতি। অন্যান্য খাতের পাশাপাশি আর্থিক খাতের দুর্বলতাও অন্যতম চ্যালেঞ্জ। তবে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার, যেখানে কার্যকর মুদ্রানীতি ও বাজারভিত্তিক ডলারের মূল্য নির্ধারণ অন্যতম পদক্ষেপ হতে পারে। আর রাজস্ব বৃদ্ধিও সমস্যার উত্তরণে বড় ভূমিকা রাখবে।
জ্বালানির উচ্চমূল্য, দুর্বল মুদ্রানীতি, টাকার অবমূল্যায়ন, পণ্যের সরবরাহ সংকট ও আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। একই সঙ্গে মজুরি না বাড়ায় মানুষের ভোগব্যয় কমছে- যা জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ অন্য ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বাজারে কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। বরং ব্যাংকের ঋণখেলাপি, পুনঃতফসিল ও ঋণ অবলোপন বাড়ছে- যা ব্যালান্স অব পেমেন্টে চাপ তৈরি করছে। রেমিট্যান্স কমায় রিভার্জও কমেছে। সরকারের আমদানি নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপে কর আহরণও দুর্বল হয়েছে। এমনিতেই রাজস্ব আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্ন। আর সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে আসায় সরকারের ব্যাংকনির্ভরতা বেড়েছে। এতে আয় না বাড়লেও সরকারের ঋণ বেড়েই চলেছে। আবার দারিদ্র্য কমলেও বাড়ছে বৈষম্য। এমতাবস্থায় কাঠামোগত সংস্কারে কিছু পদক্ষেপের কথা বলা যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সংস্কার এখন মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেশে বিদ্যমান সমস্যার কারণে, নাকি বৈশ্বিক কারণে এমন প্রশ্নও রয়েছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রভাব সব দেশেই বিদ্যমান থাকে। কিন্তু সে পরিস্থিতির সঙ্গে দেশীয় পলিসি অ্যাডজাস্ট করে সমস্যার সমাধান করতে হয়। বাংলাদেশে কিছু সংস্কার কাজ হয়েছে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। অনেক ক্ষেত্রে সংস্কার হচ্ছে, কিন্তু আরও করতে হবে। আগামীর পরিবেশ অর্থাৎ নির্বাচনের পরের পরিবেশ যদি ভালো থাকে, তাহলে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। মানুষ যদি উন্নয়নের পক্ষে থাকে, তাহলে দেশ এগিয়ে যাবে। আগামী ৭ জানুয়ারি ২০২৪ অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠিত হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবার টানা চতুর্থবারের মতো মোট পঞ্চমবারের মতো বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হতে যাচ্ছে। আগামী সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশলে নিশ্চয়ই নতুনত্ব আনতে সচেষ্ট হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিরাজমান অর্থনৈতিক সংকট এবং অন্যান্য ব্যাপারগুলোর নিয়ে তিনি অবশ্যই ওয়াকিবহাল। বেশ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার জরুরি হয়ে উঠেছে, এটা তিনি উপলব্ধি করেছেন আরও আগেই। হয়তো এতদিনে সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়ে যেত। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচন এসে যাওয়ায় সেটা শুরু করা সম্ভব হয়নি। এবার তিনি আগের ত্রম্নটি বিচু্যতিগুলো যথাসম্ভব দূর করে একটি সুস্থ সুন্দর সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। আমরা অতীতে দেখেছি, তিনি দেশের স্বার্থে যে কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণে পিছপা হননি কখনো। এবারও নিশ্চয়ই তিনি আমাদের অর্থনীতির সংস্কারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক