আজ ১৭ এপ্রিল, ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। স্বাধীনতা অর্জনের পথে এক ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির আলোকবর্তিকা হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। রচিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায় স্বাধীন বাংলাদেশের নাম। এ যেন জয় বাংলা ধ্বনির মধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রকাশ্য অভু্যদয়। সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান এবং মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলাতে হলেও বঙ্গবন্ধুর নামের সঙ্গে এর নতুন নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। এটা হলো প্রথম বাংলাদেশ সরকার। তবে মুজিবনগর সরকার কিংবা প্রবাসী সরকার হিসেবেও এটি পরিচিত।
১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পর ১৭ এপ্রিল এর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই সরকার গঠন ও শপথ পরিচালনা সহজ কোনো বিষয় ছিল না। প্রথমদিকে শপথ অনুষ্ঠানের বিষয়টি অত্যন্ত গোপন রাখা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটিকে মুজিবনগর সরকারের শপথ নেওয়ার কথা জানানো হয়। সংগ্রাম কমিটি এ লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। কিন্তু সভার জন্য চেয়ার-টেবিল কোথায় পাবে? খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। গ্রামের এবাড়ি-ওবাড়ি থেকে অল্প ক'টি চেয়ার-টেবিল জোগাড় করা হয়। ছোটখাটো একটি সভামঞ্চ করা হয় খোলা মাঠের এক কোণে, গাছতলায়। একাধিক প্রকাশনা ও দলিলপত্রে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি সম্পর্কে এমন তথ্য দেওয়া আছে। ওই দিনের পরিবেশ সম্পর্কে মুজিবনগর সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সচিব নুরুল কাদের সিএসপি লিখেছেন, 'আশপাশের বাড়ি থেকে চৌকি এবং বাঁশ আনা হলো। উন্মুক্ত মঞ্চ এটি। উপরে শামিয়ানা লাগানো সম্ভব হলো না। নিভৃত গ্রাম এলাকা। লোকবসতি শহরের তুলনায় অনেক কম। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে যে আয়োজন তাতেও মানুষ হলো প্রচুর। দেখতে দেখতে সভাস্থলে অন্তত হাজার পাঁচেক লোক জমায়েত হলো।'
পশ্চিমবঙ্গের লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ওই সময়ের বর্ণনায় লিখেছেন, 'গাড়িগুলো শেষ পর্যন্ত এসে থামলো একটি বিশাল আমবাগানের মধ্যে।... কিছু লোক সেখানে দৌড়াদৌড়ি করে চেয়ার সাজাচ্ছে। অধিকাংশ হাতলভাঙা চেয়ার। কাছাকাছি গ্রামের বাড়িগুলো থেকে জোগাড় করে আনা।...আশপাশের গ্রাম থেকে ধেয়ে এসেছে বিপুল জনতা। সেনাদের বৃত্ত ভেদ করে তারা হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়তে পারছে না বলে অনেকেই আমগাছগুলোতে চড়তে শুরু করেছে।'
কলকাতার যুগান্তর পত্রিকার প্রতিনিধি অজিত চক্রবর্তী সেদিনের বর্ণনায় লিখেছেন, 'কলকাতার প্রেস ক্লাব থেকে সাংবাদিকদের গাড়ির মিছিল চার ঘণ্টা পরে মুজিবনগরে যখন পৌঁছল তখন বেলা ১১টা। বিরাট আমবাগান, কিন্তু সভা যেখানে বসেছে, সেখানে মঞ্চের মাথার উপরে, বিরাট কয়েকটা মেহগনি গাছ। ঘন সবুজ আর কাঁচা সবুজের সমারোহ। হালকা মেঘে ঢাকা আকাশের ছায়া পড়েছে চারদিকে। অপূর্ব পরিবেশ। বাংলা এককালে স্বাধীনতার শেষ লড়াই লড়েছিল এক আম্রকুঞ্জে, আর স্বাধীনতার ঘোষণা হলো আর এক আম্রকুঞ্জে। পলাশীর পাপ ঘোচানোর জন্যই মুজিবনগর।'
মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। যে কোনো মুহূর্তে পাক-হানাদার বাহিনীর বিমান হামলার আশঙ্কার মুখে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক এ শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের স্থায়িত্ব হয় মাত্র ৪৫ মিনিট। অনুষ্ঠানের সূচনায় পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত এবং গীতা, বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়। স্থানীয় শিল্পী এবং হাজারো মানুষের কণ্ঠে গাওয়া হয় বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।' এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম উত্তোলন করেন মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। এরপর আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী ঐতিহাসিক দলিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এরপর নতুন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিবর্গ ও সেনাবাহিনীর প্রধানকে শপথবাক্য পাঠ করান তিনি। শপথ গ্রহণের পর সশস্ত্র তেজোদীপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এবং আনসার বাহিনীর সদস্যরা মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের রাষ্ট্রীয় কায়দায় 'গার্ড অব অনার' প্রদান করেন। পাক-শাসকগোষ্ঠীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় তার অনুপস্থিতিতে সেদিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসাবে শপথ নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সরকারের মন্ত্রিসভায় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদকে সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, এএইচএম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। বাংলার ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিচিত খন্দকার মোশতাক আহমেদকে আইন, বিচার ও পররাষ্ট্র দপ্তরের মন্ত্রী করা হয়।
শপথ গ্রহণ শেষে মুজিবনগরের আম্রকাননে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, 'জাতি হিসেবে বাঙালি জেগে উঠেছে। পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই বাঙালির এই জয়যাত্রায় বাধা দিতে পারে।' তিনি আরও বলেন 'প্রান্তরে প্রান্তরে, হাটে-বাজারে, শহরে-গঞ্জে বাঙালি লড়ছে। অকাতরে আমরা রক্ত দিচ্ছি পরাজিত হওয়ার জন্য নয়। এ যুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতার, আমাদের অস্তিত্বের যুদ্ধ- এ যুদ্ধে আমরা জিতবই।' প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণার পটভূমি ব্যাখ্যা করেন বিশদভাবে। তিনি বললেন, 'পাকিস্তান আজ মৃত। অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে।...স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশু রাষ্ট্রকে লালন-পালন করছেন। দুনিয়ার কোনো জাতি এ নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক, কাল হোক দুনিয়ার ছোট-বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে। স্থান করে দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে।'
\হযদিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতি সবাই অনুভব করছিলেন। এ কারণে প্রতিটি ভাষণের ছত্রে ছত্রে বারবার তার নাম উঠে আসে। তিনিই রাষ্ট্রের প্রধান, এই সরকার গঠন করেছেনও তিনিই। সবাই বলেছেন তার নির্দেশই কাজ হচ্ছে।
মুজিবনগরে শপথ নেওয়া ১৯৭১ সালের প্রথম সরকারের অসাধারণ নেতৃত্ব এই সরকারকে সফলতার দিকে নিয়ে যায়। মাত্র নয় মাস সময়ের মধ্যে এক অসাধারণ কার্যকর ও দক্ষ প্রশাসন তারা গড়ে তুলেছিলেন। যদিও এই সরকারের কলেবর অতটা বড় ছিল না, কিন্তু সুবিন্যস্ত এক সাংগঠনিক কাঠামো ছিল। এই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন এইচটি ইমাম। তিনি লিখেছেন, '১৯৭১ সালের বাংলাদেশ সরকার আকারে বিশাল ছিল না, কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর এবং দক্ষ ছিল। মন্ত্রিসভার প্রাত্যহিক বৈঠক ছাড়াও যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো প্রয়োজন ও সময়ের তাগিদে। যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থায় যেভাবে সরকার পরিচালনা করতে হয়, ঠিক সেইভাবে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা এবং আমরা সবাই কাজ করেছি। সিদ্ধান্তগ্রহণ পদ্ধতি ছিল দ্রম্নত এবং দৃঢ়। বাস্তবায়ন তদারক ক্ষিপ্র গতিতে।' (এইচটি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, পৃ. ৩৪)
যুদ্ধ চলাকালীন অনেক দেশেই প্রবাসী সরকার গঠিত হওয়ার উদাহরণ আছে। কিন্তু মুজিবনগর সরকার কাঠামোতে যে সাফল্য ছিল তা অন্য প্রবাসী সরকারে দেখা যায়নি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শুধুমাত্র প্রবাসী ছিল না। সরকারের নিজস্ব ভূখন্ডও ছিল। বাংলাদেশের যেসব অঞ্চল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদারদের থেকে শত্রম্নমুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল কিংবা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেসব এলাকা পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী দখল করতে পারেনি সেই সব মুক্তাঞ্চলে সরকার সব রকমের সামরিক এবং বেসামরিক প্রশাসন কর্মকান্ড চালিয়ে আসছিল। এই সব মুক্তাঞ্চলে সরকারের গৃহীত কর্মকান্ড বিদেশি সাংবাদিকরা নিয়মিত পরিদর্শনে যেতেন।
মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধের একটি সফল কাঠামো তৈরি করেছিল। বিশ্বের সহানুভূতি ও পরোক্ষ স্বীকৃতি থেকে মুজিবনগর সরকারের বিকল্প ছিল না। শ্রীমতি গান্ধীর যে ব্যাকুল প্রশ্ন, 'সরকার গঠিত হয়েছে কিনা?' এর তাৎপর্য প্রমাণিত হয়েছে। এইচটি ইমাম 'বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-৭৫' নামে যে তথ্য বহুল বইটি লিখেছেন, সেখানে বলেছেন, 'বাংলাদেশকে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কবলমুক্ত করতে মুক্তিযুদ্ধ তথা জনযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়? এই ইতিহাসের সঙ্গে প্রথম বাংলাদেশ সরকার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, শরণার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা মেটানো, অধিকৃত বাংলাদেশে প্রশাসন ব্যবস্থাপনা সামলানো, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, খাদ্য রশদ সংগ্রহ, চিকিৎসাসেবা দান, পররাষ্ট্রবিষয়ক তৎপরতা সচল রাখা ইত্যাদি যাবতীয় রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় প্রথম বাংলাদেশ সরকারের যেসব মন্ত্রী, কর্মকর্তা, কর্মী, কর্মচারী সংশ্লিষ্ট ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে তাদের নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে।'
মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে মাসে মুজিবনগর সরকার সম্প্রসারিত হয় এবং ১৯৭১ সালের ২০ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ সচিবের এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে তা প্রকাশ করা হয়। মুজিবনগর সরকারকে ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ভাগ করা হয়। মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূল দায়িত্বটি পালন করে মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন। অভ্যন্তরীণ প্রশাসন ছিল সামরিক ও বেসামরিক- এ দুই ভাগে বিভক্ত। সামরিক প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত হতো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে- যার দায়িত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বয়ং। বাংলাদেশের সমগ্র যুদ্ধাঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে অধিনায়ক নিযুক্ত করা ও যুদ্ধ পরিচালনা তদারকি করা ছিল এ মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ। বেসামরিক প্রশাসনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সাধারণ প্রশাসন এবং তথ্য ও বেতার বিভাগ। সাধারণ প্রশাসন বিভাগটি নিয়োগ, বদলি, পোস্টিং, শৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি দায়িত্ব অর্থাৎ সরকারের সংস্থাপন বিষয়ক যাবতীয় দায়িত্ব পালন করত। আঞ্চলিক প্রশাসনও ছিল বেসরকারি প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আঞ্চলিক প্রশাসনের দায়িত্বে ছিলেন একজন চেয়ারম্যান ও একজন প্রশাসক। শরণার্থী সমস্যা, আঞ্চলিক সামরিক-বেসামরিক বিষয়াবলির সুষ্ঠু সমন্বয় ইত্যাদি ছিল আঞ্চলিক প্রশাসনের প্রধান কাজ। এছাড়া অভ্যন্তরীণ প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এ বেতার কেন্দ্রে প্রায় ১০০ লোক নিয়োগ করা হয়েছিল। বিভিন্ন রণাঙ্গনের যুদ্ধের খবর, পাকবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের খবর এবং পাকবাহিনীকে ধিক্কার দিয়ে ও বিদ্রূপ করে রচিত চরমপত্র এই বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রচার করা হতো। এ বেতার কেন্দ্রটি মুক্তিযোদ্ধাদের দারুণভাবে উজ্জীবিত করত।
বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক সোনালি অধ্যায়। কারণ এ ধরনের তৎপরতার ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকবাহিনীর ধর্ষণ, নির্যাতন ও গণহত্যা সম্পর্কে জানতে পেরেছিল। মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির প্রতি বিশ্বব্যাপী যে সহানুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল তা ছিল বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতারই ফল। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন, কূটনৈতিক তৎপরতা, প্রতিনিধি প্রেরণ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন লাভের চেষ্টা, বিদেশে তহবিল সংগ্রহ ইত্যাদি ছিল বহির্বিশ্বে তৎপরতার মধ্যে বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য। তবে এসব তৎপরতার ক্ষেত্রে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কারণ একই সঙ্গে তিনি ছিলেন জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি এবং নিউইয়র্ক ও লন্ডন দূতাবাসের প্রধান। তাছাড়া বহির্বিশ্বে তিনিই ছিলেন মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত। বহির্বিশ্বে তৎপরতার ফলে এ সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, বাংলাদেশ সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বা শরণার্থী সমস্যা নয়, বরং এটা ছিল শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির স্বাধীনতার সংগ্রাম। চীনের বাঁধার কারণে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি জাতিসংঘে বক্তৃতা করতে না পারলেও এই প্রচেষ্টার মধ্যদিয়ে বিশ্ববাসী বাঙালির স্বাধীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষার কথা জানতে পেরেছিল। এমনকি সেপ্টেম্বর মাসে শেখ মুজিবের বিচারের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে জনমত গড়ে উঠেছিল সে জনমতের চাপে পাক-শাসকবর্গ শেখ মুজিবের মৃতু্যদন্ড কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছিল। সর্বোপরি বাংলাদেশ ও বাঙালির সংগ্রাম বিশ্বব্যাপী যে আলোড়ন ও আবেদন সৃষ্টি করেছিল তা ছিল বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতারই ফল।
পরাধীন পাকিস্তানি আমলের সুদীর্ঘ ২৩ বছরের লড়াই-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন স্বদেশ প্রতিষ্ঠা বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। ১৯৭১ সালের মুজিবনগরে শপথ নেওয়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার হচ্ছে সেই আশা-আকাঙ্ক্ষারই প্রত্যক্ষ ফসল, মহত্তম রূপ। যত দিন যাবে, বাংলাদেশ যতই বিশ্বের বুকে মাথা তুলে গৌরব নিয়ে দাঁড়াবে, ততই মহিমান্বিত হতে থাকবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত প্রথম বাংলাদেশ সরকার বা মুজিবনগর সরকারের সাফল্য, ইতিহাস এবং কীর্তিগাঁথা।
প্রফেসর ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম :ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাক্তন প্রো-ভিসি, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়