প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা স্থানে অসংখ্যবার ভূমিকম্প হয়। ছোট বড় নানা মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এই ভূমিকম্পের আঘাতের কারণে ঘরবাড়িসহ নানান স্থাপনা ধ্বংস হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় অনেক কিছু। প্রতি বছর অসংখ্যবার ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্প কখনো ছোট আকারের হয় আবার কখনো বড় আকারের হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর কয়েক লাখ ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এগুলোর মধ্যে ১৭টি বড় আকারের ভূমিকম্প রিখটার স্কেলে সাত মাত্রার বেশি। আট মাত্রার ভূমিকম্প হয় বছরে গড়ে একবার। মৃদু ভূমিকম্পগুলো সাধারণভাবে অনেক সময় বোঝা যায় না। জনবহুল ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংঘটিত হওয়া ভূমিকম্প সাধারণ মানুষ অনেক সময় খেয়াল করে না।
সম্প্র্রতি তুরস্ক ও সিরিয়াতে ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। এটি সংঘটিত হয় তুরস্কের গাজিয়ানতেপসহ পার্শ্ববর্তী দেশ সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায়। এ ভূমিকম্পে মুহূর্তে সব লন্ডভন্ড করে দেয় সবকিছু। প্রথম আঘাত হানার পর দ্বিতীয় শক্তিশালী ভূমিকম্প আবারও তুরস্ক মধ্যাঞ্চলে আঘাত হানে, এক মিনিটের ভূমিকম্পে লন্ডভন্ড তুরস্কের গাজিয়ানতেপ। চারদিকে হাজারও মানুষের কান্না আর্তনাদ। ভূমিকম্প নয়, যেন মৃতু্যপুরীতে পরিণত হয় প্রাচীন দেশ তুরস্ক ও সিরিয়া। নগর সৌন্দর্যগাথা এসব স্থাপনা। ভয়াবহ এক মিনিটের ভূমিকম্পের কারণে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে সবকিছু। এ ধরনের কম্পনের কারণে সাড়ে ১০ হাজারের বেশি ভবন ভেঙে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। তুরস্কের ১০টি শহরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেসব এলাকায় মাইলের পর মাইল ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। রাস্তাঘাটে ফাটল দেখা দিয়েছে। মৃতু্যর মিছিল সব জায়গায়। ৪৫ হাজারের বেশি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এমনকি উদ্বেগজনক হারে হু হু করে বাড়ছে মৃতু্যর সংখ্যা। বাতাসের সঙ্গে লাশের গন্ধ। খুবই মর্মান্তিক ও হৃদয় বিদারক ঘটনা। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা উদ্ধার কর্মীরা উদ্ধার করছে লাশ ও জীবিতদের। ১১ দিন হয়ে যাওয়ার পরও এখনো পর্যন্ত জীবিত মানুষ উদ্ধার করছে। অনেক বিল্ডিংয়ে এখনো উদ্ধার কাজ শুরু করতে পারেনি। এমনকি কাফনের কাপড় পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। খাবারের সংকট খুবই প্রকট। ঠান্ডা পড়ছে মাইনেস ১০ ডিগ্রির মতো। তীব্র ঠান্ডা উপেক্ষা করে উদ্ধার কার্যক্রম চলছে।
ধারণা করা হচ্ছে, তুরস্ক ও সিরিয়াতে ভয়াবহ ভূমিকম্পের কারণে আড়াই কোটির বেশি মানুষ ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়ে নানাভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ভূমিকম্পে ৮৪ বিলিয়নের মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তুরস্কের মাইলের পর মাইল বিচু্যতি হয়েছে ভূমির। ৩০০ কিলোমিটারের মতো ফাটল। স্বজন হারিয়ে সবার আর্তনাদ চারদিকে। বিভিন্ন দেশ থেকে উদ্ধার কর্মীরা গিয়ে বিল্ডিং থেকে উদ্ধার করছে হাজার হাজার মানুষকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের কারণে ভৌগোলিক নকশায় নাকি বদলে গেছে। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, ইন্দোনেশিয়ার মতো তুরস্ক বিশ্বের সবচেয়ে ভূকম্পন এলাকাগুলোর মধ্যে একটি। দেশটির অবস্থান সেখানে, যেখানে সক্রিয়ভাবে গতিশীল বেশ কয়েকটি ফল্ট একত্রিত হয়েছে। তাই ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
গত কয়েকদিন আগে সিলেটে ৪.৩ মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এটির কেন্দ্রস্থল মেঘালয়। এটি ছাতকের ১১ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এতে সিলেটে মৃদু কম্পন অনুভূত হয়। যদি রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক বেশি হয়ে থাকে। দুর্যোগ, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় হলে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে জানানো হয় ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়, প্রস্তুতি নেওয়া যায়। ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই আলাদা। ভূমিকম্প এমন- যা কখন হবে কখন হতে পারে সে বিষয়ে জানা যায় না।? বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত ভূমিকম্প কখন হবে তা জানার জন্য কোনো প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে পারেনি বাংলাদেশে আরো অপরিকল্পিত নগরায়ণ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায়। তাই সবসময় সতর্ক অবস্থায় থাকতে হবে এবং সচেতন করতে হবে জনসাধারণকে রিখটার স্কেলে যদি ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে বাংলাদেশ কি সেই ধাক্কা সামলাতে পারবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তুরস্কের চেয়ে ছোট ভূমিকম্প হলেও রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও ভবন ধস হবে এবং পাশাপাশি অপরিকল্পিতভাবে ঢাকায় বিদু্যৎ সঞ্চালন, গ্যাসের লাইন, পানির লাইন, অগ্নিকূপে পরিণত করতে পারে। তুরস্ক ও সিরিয়ার ভয়াবহ ভূমিকম্প কাঁপিয়ে দিয়েছে পুরো বিশ্বকে। বাংলাদেশও এই শঙ্কার বাহিরে নয়। বাংলাদেশে ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে সব সময়। যে কোনো সময় ভয়াবহ ভূমিকম্পে ডেকে আনতে পারে মানবিক বিপর্যয়।
ভূতাত্ত্বিক গঠন ও অবস্থানের কারণে বড় ভূমিকম্প হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এমন ৮টি ভূতাত্ত্বিক চু্যতি এলাকা বা ফল্ট জোন আছে। এ ফল্ট থেকে যে কোনো সময় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন। রাজধানী ঢাকায় হলে মানবিক বিপর্যয় বেশি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ গণবসতি ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ তৈরি করার কারণে। বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশে ছোট বড় ভূমিকম্পে ১৪২ বার কেঁপে উঠে আর বাংলাদেশে ভূমিকম্পে প্রাণহানিসহ ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে শহরঞ্চলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট মাঝারি ভূমিকম্পগুলোকে হেলা করলে হবে না, এগুলো ভালো বার্তা দেই না। তাই সব সময় সতর্ক অবস্থায় থাকতে হবে। কারণ এগুলো বড় ভূমিকম্পের আলামতও বটে। ভূমিকম্পবিদরা বলেন, বড় ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে শত বছরের আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়।
বাংলাদেশে যদি বড় ভূমিকম্প হয় রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার মতো- তাহলে কয়েক হাজার ভবন ধসে পড়বে। তাই নিরাপদ আবাসস্থল, পরিকল্পিতভাবে ভবন তৈরি করতে হবে। নগরায়ণ হতে হবে পরিকল্পিত। জনসাধারণকে আতঙ্কিত না করে সচেতন ও সতর্ক করা উচিত। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির সমীক্ষাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প হলে ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে। ভূমিকম্প কখন কোথায় হবে কেউ বলতে পারে না। তা জানার প্রযুক্তি এখনো কোনো বিজ্ঞানী আবিষ্কার করতে পারেননি। তাই কোনো ভবন তৈরির সময় ফাউন্ডেশন দিয়ে ভূমিকম্প সামলাতে পারে এরকম করে ভবন তৈরি করতে হবে। শহরঞ্চলে ভবন নির্মাণের সময় বিধিনিষেধ মানতে হবে নির্মাণবিধি মেনে ভবন তৈরি করতে হবে। পরিকল্পিত ভাবে নগরের সবকাজ করতে হবে এবং বিদু্যৎ সঞ্চালন, গ্যাসের লাইন টানার সময় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ভূমিকম্পের জন্য সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে? ভূমিকম্পের পরবর্তী সময়ে উদ্ধারে প্রস্তুতি থাকতে হবে। জনগণের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি না করে সচেতনতা তৈরি করতে হবে? দ্রম্নত নগরায়ণের ফলে ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এলাকাভিত্তিক প্রশিক্ষণ স্বেচ্ছাসেবক দল গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের দ্বারা জনসাধারণে মাঝে জনসচেতনতা মূলক সেমিনারের আয়োজন করতে হবে। জাপানের মধ্যে প্রায়ই সময় ভূমিকম্প হয়ে থাকে তারা ভয়কে জয় করেছে,?তারা ভূমিকম্পের জন্য সবসময় প্রস্তুতি থাকে। তাই তাদের ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয় না, তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ খুবই কম। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিম্নমাণের রাখে এবং ভূমিকম্পের পরবর্তী সময়ে বিপর্যয় স্বল্প সময়ে সামাল দেই।
তুরস্কের ভয়াবহ ভূমিকম্প থেকে আমাদের শিক্ষা নিয়ে সচেতন ও সতর্ক অবস্থায় থাকতে হবে এবং ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গ্রহণ করতে হবে কর্মপরিকল্পনা।
বিশেষজ্ঞরা রিখটার স্কেলে ৭ বা ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে- যা ঘটতে পারে বলে মনে করেন:
১. রাস্তাঘাট ধসে লাইটপোস্ট নিচে পড়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ, ভবনের কাচ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে নিচে পড়া। রাস্তার বিলবোর্ড ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২. বিদু্যৎ সঞ্চালনের তার ছিঁড়ে নিচে পড়া এবং মাটির নিচে দিয়ে যাওয়া গ্যাস ও পানির লাইন ফেটে উপরে ওঠে আগুন ধরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
৩. মোবাইল ফোনের টাওয়ার ধসে পড়া এবং মোবাইল ও বিদু্যৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। মোবাইল ও বিদু্যৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়া।
৪. আগুন নিভানোর সংকট দেখা দেবে। ফায়ার সার্ভিস পৌঁছাতে না পারা রাস্তা বন্ধ থাকার কারণে?
ভূমিকম্পের সময় যা করবেন :
১. ভূমিকম্প হওয়ার সময় জীবন বাঁচাতে হলে প্রথমেই মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আতঙ্কিত হওয়া যাবে না?
২. গ্যাসের চুলা বন্ধ করে দিন এবং মেইন গ্যাসের লাইন বন্ধ করতে দ্রম্নত ব্যবস্থা নেবেন।
৩. বিদু্যতের মেইন সুইচ বন্ধ করতে হবে এবং লিফট থাকলে তার সুইচও বন্ধ করে দিন।
৪. যদি বাসাবাড়িতে থাকেন তাহলে মাথায় বালিশ দিয়ে ঢেকে টেবিল, খাট ও শক্ত আসবাবপত্রের নিচে আশ্রয় নিন ঘর থেকে বের হওয়ার সময় অবশ্যই মাথায় বালিশ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে কোনো অবস্থাতেই লিফট ব্যবহার করা যাবে না?
৫. ঘর থেকে বের হওয়া না গেলে ইটের তৈরি পাকা ঘর হলে ঘরের কোণে এবং কলাম ও বিমের তৈরি ভবন হলে কলামের গোড়ায় আশ্রয় নিন, টিনের ঘর হলে শক্ত খাট ও চৌকির নিচে আশ্রয় নিন।
৬. স্কুল-কলেজ বা অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকলে মাথায় ব্যাগ দিয়ে শক্ত টেবিলের নিচে আশ্রয় নেন এবং শিল্পকারখানা, মার্কেট, হাসপাতালে হুড়োহুড়ি না করে এক জায়গায় মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন দরজার সামনে ভিড় বা ধাক্কাধাক্কি করবেন না।?
৭. গাড়িতে থাকলে গাড়ি রাস্তার একপাশে থেমে গাড়িতেই থাকুন। সমুদ্র বা নদীর ধারে থাকলে উচুঁ জায়গায় অবস্থান নিতে হবে। ঘরের বাইরে থাকলে উঁচু বাড়ি, বড় গাছ ও বৈদু্যতিক খুঁটি থেকে দূরে থাকবেন। একবার কম্পন হওয়ার পর আবারও কম্পন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাই খোলা জায়গায় আশ্রয় নিন।
সতর্কতা ও সচেতনতা :
১. ভূমিকম্প সম্পর্কে সঠিক ধারণা নিন।
২. ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি থাকতে হবে।
৩. ভূমিকম্পে ঝুঁকি ও করণীয় সম্পর্কে অবহিত থাকতে হবে।
৪. এলাকাভিত্তিক প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক দল গড়ে তুলতে হবে। তাদের মাধ্যমে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
৫. বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, সভা, সেমিনারের আয়োজন করতে হবে।
৬. সরকার ও গণমাধ্যমকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।
৭. ভবন তৈরি করার সময় নির্মাণ আইন অনুযায়ী ভবন তৈরি করতে হবে।
রায়হান উদ্দিন : কলাম লেখক