সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২

অমর একুশে বইমেলা-২০২৩ নতুন বইয়ের পসরা সাজিয়ে ডাকছে বইপ্রেমীদের

বাঙালির প্রাণের বইমেলা সারা মাসব্যাপী তার দীপ্তি ছড়িয়ে দিক, নতুন বইয়ের ঘ্রাণ পাঠককে দূরদূরান্ত থেকে টেনে আনুক, মানুষকে বই পড়ার প্রতি অভ্যস্ত ও আগ্রহী করে তুলুক, সেই প্রত্যাশাই করছি। সেইসঙ্গে যেসব ভাষা শহীদের স্মরণে এই বর্ণাঢ্য মেলার আয়োজন, ভাষার মাসে তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করছি।
মোহাম্মদ অংকন
  ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
অমর একুশে বইমেলা-২০২৩ নতুন বইয়ের পসরা সাজিয়ে ডাকছে বইপ্রেমীদের
অমর একুশে বইমেলা-২০২৩ নতুন বইয়ের পসরা সাজিয়ে ডাকছে বইপ্রেমীদের

অমর একুশে বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে এই বইমেলা জড়িয়ে আছে। প্রতি বছর লেখক, পাঠক, প্রকাশকসহ প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট মানুষ এই মেলার দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকে। এ যেন বছরের অন্যসব উৎসবের মতোই এক উৎসব। এ যে নতুন বই প্রকাশের মহোৎসব। 'পড়ো বই গড়ো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ' প্রতিপাদ্য নিয়ে সেই মহোৎসব এবারও শুরু হয়েছে যথারীতি পহেলা ফেব্রম্নয়ারি থেকে। ইতোমধ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের চিরসাক্ষী স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং বাংলা একাডেমির মেলাপ্রাঙ্গণ বই বিক্রির স্টলে সুসজ্জিত হয়ে মেলার মূল আমেজের বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে পাঠককে নতুন বই দেখা ও কেনার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। বইপ্রেমী পাঠকও যেন মেলায় যাওয়ার জন্য একটুখানি সুযোগ খুঁজছে। কেউ ভাবছে- অফিস ছুটির পর মেলায় যাব, কেউ ভাবছে কলেজ-ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে যাব। আবার কেউ কেউ সপ্তাহের ছুটির দিনে মেলায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করছে। এই প্রস্তুতি অবশ্য সাধারণ মানুষের চেয়ে লেখকশ্রেণির ভেতরে বেশি কাজ করছে, কাজ করছে এক অন্যরকম উত্তেজনা-উৎসাহ। তাই তো শুধু রাজধানী শহর নয়, চৌষট্টি জেলার আনাচে-কানাচে থেকে অমর একুশে বইমেলায় আসার জন্য প্রস্তুতি পর্ব সারছেন। এক মাসব্যাপী এই বইমেলা পাঠকদের সঙ্গে লেখকদের যে মেলবন্ধনের সুযোগ করে দেয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব লেখকের দেখা মেলে কিংবা মেলে না, মেলার মাঠে তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, অটোগ্রাফ, ফটোগ্রাফের সুযোগ হাতছাড়া করার কোনো মানে নেই। তাই তো ফেব্রম্নয়ারি মাসজুড়ে বইপ্রেমী, লেখকমনা ও সংস্কৃতিবোধ সম্পন্ন মানুষের মন পড়ে থাকে মেলার মাঠে, কবে যাব বইমেলায়?

বইমেলার শুরুর দিকে মানুষের আনাগোনা একটু কম লক্ষণীয়। তবে প্রতি শুক্রবার, বিশেষ দিন যেমন ১৪ ফেব্রম্নয়ারি ও সরকারি ছুটি দিন যথা ২১ ফেব্রম্নয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পাঠক ও সাধারণ মানুষের পদচারণা বেশি দেখা মেলে। সে সময়ের দৃশ্য চোখে পড়লে মনে হয়, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যুগেরও বইপ্রেমী মানুষ আছে, আজও কাগজের বইয়ের প্রতি মানুষের ভালোবাসা অটল আছে। আর তাই তো মেলার মাঠে এসব বিশেষ দিনে মানুষের উপচে পড়া ভিড় থাকে। আমি আমার লেখকজীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, প্রতি বছর ফেব্রম্নয়ারির শুক্রবার ও ছুটির দিনে যে পরিমাণ মানুষের উপস্থিতি মেলাপ্রাঙ্গণে ঘটে, তা মাসের অন্যসব দিনের সমষ্টির সমান বৈকি কম হবে না।

শুধু ছুটির দিন হোক কিংবা অন্যসব দিন হোক, যারা নতুন মেলায় আসে বা পূর্বে থেকে মেলার স্টলের অবস্থান সম্পর্কে জেনেশুনে আসে না, তাদের একটু বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এ যেন মধুর এক বিড়ম্বনা। আমার এই লেখার আসল উদ্দেশ্যই ওইসব লেখককে মেলার মাঠ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেওয়া। তাই নতুন যারা বইমেলায় যাবেন/যাচ্ছেন, তাদের প্রতি জানাচ্ছি- সম্ভব হলে আগে থেকেই আপনার কাঙ্ক্ষিত বইটি কোথা পাওয়া যাবে, সেটার স্টল/প্যাভিলিয়ন নং জেনে যাবেন। এতে ভিড়ের মধ্যে সহজেই খুঁজে পাবেন স্টল। স্টলের অবস্থান বা নাম্বার না জানলে খুঁজে পেতে রীতিমতো ঘাম ঝরে যায়। আরেকটা কথা, স্টল আর প্যাভিলিয়ন ভিন্ন বিষয়। মানে ১নং স্টল মানেই ১নং প্যাভিলিয়ন নয়। এমন বিষয় নিয়ে অনেকে কনফিউজড হয়ে শেষমেশ খুঁজে না পেয়ে পছন্দের/পরিচিত লেখককে কল করে বা ফেসবুকে মেসেজ করে, তখন তা আর পৌঁছায় না। নেটওয়ার্কের দারুণ সমস্যা দেখা দেয় মেলার মাঠে, বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে। তাই বইমেলায় গেলে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে যাবেন।

আপনারা অনেকেই কাঙ্ক্ষিত লেখকের বই কেনার জন্য অনেক কষ্ট করে স্টল/প্যাভিলিয়ন খুঁজে বের করেন। তারপর কাঙ্ক্ষিত লেখকের কাঙ্ক্ষিত বইটি ডিসপেস্নতে খুঁজতে থাকেন। কখনো চোখে পড়ে আবার কখনও চোখে পড়ে না। চোখে পড়লে তো বেশ ভালো। তবে বেশির ভাগ সময়ই কাঙ্ক্ষিত বইটি চোখে পড়ে না। কিন্তু বইটি স্টলে/প্যাভিলিয়নে আছে এবং ডিসপেস্নতেও আছে, হয়তো কম সংখ্যক। আসলে একটা স্টলে/প্যাভিলিয়নে অসংখ্য লেখকের বই থাকে। সব লেখকের এক কপি করে বই ডিসপেস্নতে রাখলেও জায়গা সংকুলান হওয়া কঠিন। তাই এক্ষেত্রে আপনাদের করণীয় হচ্ছে- দায়িত্বরত বিক্রয় প্রতিনিধিকে নিঃসংকোচে জিজ্ঞাস করা। কেননা, তারা আপনাকে সেবা দিতেই আছেন। অনেকাংশেই বই ডিসপেস্নতে না পেয়ে ফিরে এসে মন খারাপ করে লেখকের ফেসবুক পোস্টে কমেন্ট করে বা ইনবক্সে জানায় যে, বইটি/বইগুলো পাওয়া যায়নি। এতে লেখকেরও মন খারাপ হয়। আর হঁ্যা, বই কেনার পর এটাও জিজ্ঞাস করবেন, ওই বইয়ের লেখক স্টলে/প্যাভিলিয়নে উপস্থিত আছেন কিনা। উপস্থিত থাকলেই নিতে পারবেন অটোগ্রাফ, তুলতে পারবেন ছবি ও সেলফি।

বইমেলায় শুধু বই-ই পাওয়া, তা না। যেহেতু নামে মেলার মাঠ, সেহেতু সেখানে মুখরোচক খাবারও মেলে। এটির একটি নেতিবাচক দিক আছে বলেই প্রসঙ্গটা উলেস্নখ করলাম। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মেলার মাঠে কিছু মানুষ বইকে উপলক্ষ করে গেলেও কোনো বই না কিনে সরাসরি খাবারের দোকানের দিকে ঝোঁকে। ক্ষেত্রবিশেষ দেখা মেলে স্টলের সামনে যেমন ভিড় থাকার কথা, তার চেয়ে বহুগুণ ভিড় লক্ষ্য করা যায় খাবারের দোকানের দিকে। মেলার মাঠে মানুষ আসবে, আনন্দ করবে, খাবারও খাবে, ছবি-ভিডিও করাসহ নানান আনুষ্ঠিকতা করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে- বইকে উপলক্ষ করে মেলার মাঠে এলেও কিছু মানুষ কোনো বই না কিনে দামি খাবার খেয়ে ফিরে যায় বাড়িতে। বইয়ের প্রতি যে কিছু মানুষের অনাগ্রহ আছে, তা এই ধরনের দৃশ্য থেকে উপলব্ধি করা যায়। তাই যারা মেলায় আসবেন, তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, অন্তত একটি হলেও বই কিনবেন। যে টাকা খাবারের পেছনে ব্যয় করবেন, তার থেকে যৎসামান্য ব্যয় করলেই হবে। আপনার যদি বই পড়ার অভ্যেস নাও থাকে, আপনার বাসায় যদি নতুন বই থাকে এবং অবসরে যদি এক পাতাও পাঠ করেন, অবশ্যই সেখান থেকে কিছু না কিছু জ্ঞান অর্জন হবে। মেলার মাঠে দামি খাবার খেয়ে যে জ্ঞান আপনার হবে না, একটি বই আপনাকে অনেকটা মার্জিত ও সামাজিক হতে অনুপ্রাণিত করবে বলে আমার বিশ্বাস।

মেলা মানেই মানুষের আনাগোনা, প্রচন্ড ভিড়। শৈশব-কৈশোরে যখন গ্রাম্যমেলায় যেতাম, তখন মেলার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত চোখে পড়ত না। সমবয়সি অনেকে হারিয়েও যেত। তখন মেলার মাইক থেকে নিখোঁজ সংবাদের বাণী ভেসে আসত কানে। বইমেলাতেও হারিয়ে যাওয়ার প্রবণতা আছে। তাই যারা ছোটদের সঙ্গে আনবেন, তারা অবশ্যই সচেতন থাকবেন। ছোটদের জন্য শিশুচত্বরে মজার মজার যে বই আছে, তা ছোটরা জানলে মেলায় আসার জন্য বাবা-মাকে আবদার করবে। তাই অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, আপনার সন্তানকে বইমেলায় নিয়ে আসবেন। আজকের ক্ষুদ্র পাঠক একদিন বড় ও মনোযোগী পাঠক হওয়ার দিকে ধাবিত হবে। আমরা এখন আপসোস করি, সেই শৈশব-কৈশোরে যদি মজার মজার বই পড়তে পারতাম, তবে কত না আনন্দ হতো, কত না স্মৃতি জমা হতো জীবনে, শেখা হতো পাঠ্যবইয়ের বাইরে থেকে ভিন্ন কিছু। এখন ইন্টারনেটের যুগ। বেশির ভাগ শিশু-কিশোর মোবাইল-কম্পিউটারের গেমে আসক্ত। বইমেলার এই মাসটা অন্তত ওদের এই আসক্তি থেকে মুক্ত করার সুযোগ আছে। নতুন বই পেলে ওরা নিশ্চয়ই বইয়ের দিকে ঝুঁকবে। নিজের পাঠবই পড়ার পাশাপাশি শিশুসাহিত্যের বইয়ের দিকে আগ্রহী হবে। বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সবার জন্যই অবশ্য একই উপদেশ- সারাক্ষণ ডিজিটাল ডিভাইসে সময় না দিয়ে বই পড়ার দিকে আগ্রহী হয়ে উঠুন। আর বই পড়ার অভ্যেস গড়ার মাস এই ফেব্রম্নয়ারি। আর তাই তো প্রতি বছর অমর একুশে বইমেলা উদযাপনে বাংলাদেশ সরকারের প্রাণান্ত চেষ্টা।

আমার এই নিবন্ধটি যে বা যারা পড়ছেন, তাদের প্রতি আহ্বান করব, কর্মজীবনের ব্যস্ততা ভুলে আসুন বইমেলার মাঠে। দেখুন, কত মুক্তমনা, সৃজনশীল মানুষে মুখরিত হয়ে উঠেছে মেলার মাঠ। অবশ্যই ভালো লাগবে। আর হঁ্যা, এবার বইমেলায় আমার দুটো নতুন বই থাকছে। থ্রিলার উপন্যাস 'কঙ্কাল রহস্য' পাওয়া যাবে প্রিয় বাংলা প্রকাশনের ৫৯৭-৫৯৮নং স্টলে এবং 'মেঘে ঢাকা চাঁদ' পাওয়া যাবে চর্যা প্রকাশের ৫৯১নং স্টলে। এছাড়া বিগত বছর প্রকাশিত বইসমূহও পাওয়া যাবে। ক্ষুদ্র এই লেখকের প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা ও আমার বই পড়ার আগ্রহ থাকলে, আপনার বুকসেলফেও জায়গা হতে আমার বইগুলোর। মেলায় দেখাও হতে পারে প্রিয় পাঠকদের সঙ্গে, প্রিয় মুখদের সঙ্গে। বাঙালির প্রাণের বইমেলা সারা মাসব্যাপী তার দীপ্তি ছড়িয়ে দিক, নতুন বইয়ের ঘ্রাণ পাঠককে দূরদূরান্ত থেকে টেনে আনুক, মানুষকে বই পড়ার প্রতি অভ্যস্ত ও আগ্রহী করে তুলুক, সেই প্রত্যাশাই করছি। সেইসঙ্গে যেসব ভাষা শহীদের স্মরণে এই বর্ণাঢ্য মেলার আয়োজন, ভাষার মাসে তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করছি।

মোহাম্মদ অংকন : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে