দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিম্নবিত্তের দুর্গতি
সব বাজারে ও গঞ্জে দ্রব্যমূল্য মনিটরিং সেল গঠনের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার ও ব্যবসায়ীদের স্বদিচ্ছাই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কমতে পারে।
প্রকাশ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
রায়হান আলী
সাম্প্রতিক সময়ে খবরের কাগজে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির খবর সরব। এ তো গেল খবরের কাগজ কিংবা যোগাযোগ মাধ্যমে। বাস্তব চিত্রটা যারা উপলব্ধি করছে তারাই বুঝতে পারছে পরিস্থিতিটা কতটা বেগতিক। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির প্রথম সংক্রমণ ঘটে ৮ মার্চ, ২০২০ সালে। এরপর থেকে ধীরে ধীরে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ সরকার ২২ মার্চ এক ঘোষণায় ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। তারপর ধাপে ধাপে ছুটি বাড়তে থাকে। আর নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের শুরু হয় মহাবিপদ। একদিকে করোনা থেকে বাঁচতে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা অন্যদিকে কর্মহীন হয়ে পড়ে সংসার চালোনোর দুশ্চিন্তা। সব কূল-প্রতিকূল অবস্থার ধাক্বা কাটিয়ে আস্তে আস্তে যখন নিম্ন আয়ের মানুষরা মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তখন আরো নতুন বিপদ! তা হলো দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন দাম।
আর সম্প্রতিক সময়ে তথা চলতি মাসের ১৯ তারিখে দেশ রূপান্তর পত্রিকায় 'মাস চলে না ৫০ হাজারেও' এমন একটা শিরোনাম দেখে অবাক হয়ে গেলাম। লেখাটি এমন- 'মাসিক বেতন ৫০ হাজার টাকা। এ টাকার মধ্যে ১৬ হাজার টাকা বাসা ভাড়া। পানির বিল ৫০০, গ্যাস ৯৭৫, ডিশ বিল ৪০০, বুয়ার বেতন ২০০০, পত্রিকা বিল ১৫০, ইন্টারনেট ৭০০, বিদু্যৎ গড়ে ৮০০, ময়লা ফেলার জন্য ১২৫, মাসিক ডিপিএস কিস্তি ১ হাজার, মায়ের ওষুধ ৮৫০, তিন সন্তানের লেখাপড়া বাবদ ৮ হাজার, অফিস যাতায়াত বাবদ ৩ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ৩৪ হাজার ৫০০ টাকার মতো খরচ। বাকি টাকা দিয়ে সারা মাসের চাল, ডাল, তেল, নুন, আটা, সবজি, মাছ-মাংস কিনতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করা মোসলেম উদ্দিন স্বপ্ন দেখেছিলেন একটা সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবনের। সেই অতি সাধারণ জীবনই এখন আর চলছে না তার। মোসলেম উদ্দিন গত ছয় মাস হয় বড় বিপাকে পড়েছেন। আয় ও খরচের এই ফর্দটি মো. মোসলেম উদ্দিনের। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের একটি বীমা কোম্পানির এই চাকরিজীবী পরিবার নিয়ে থাকেন হাজারীবাগে। স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলে ও মাকে নিয়ে তার সংসার। দুই মেয়ের বড়জন একটি কলেজে, বাকি দুই ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ে। তিন কামরার বাসার এক কামরায় তিনি ও তার স্ত্রী, এক কামরায় মা, অন্য কামরায় দুই মেয়ে আর ছেলেটি থাকে ড্রয়িংরুমে'।
আসলে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এটাই বাস্তবচিত্র বর্তমানে। দিন দিন দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি শুধু মোসলেম উদ্দিন নয়, কত মোসলেম উদ্দিন যে বিপাকে তা বলার নয়। তিনি তো বেতন পান ৫০ হাজার, আর না হোক একটা চাকরি তো আছে কিন্তু কোভিডকালীন চাকরি হারিয়ে কত যে বিপাকে, বিপত্তিতে দিন কাটাচ্ছে অনেকের তার ইয়ত্তা নেই। দিন মজুর শ্রেণির লোকজন তাহলে কোন পর্যায়ে দিন কাটাচ্ছে তা আর বুঝতে হয়তো বা কারো বাকি থাকার কথা নয়।
\হবাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো (বিবিএস) প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে জানুয়ারিতে সাধারণ মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ০৫ শতাংশ; তার আগের মাস নভেম্বরে এ হার ছিল ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। অর্থাৎ গত জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি কমেছে বা পণ্যের দাম কমেছে। খাদ্যসহ ভোগ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যে বিবিএসের এই তথ্যে সাধারণ মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না। যেখানে খাদ্যপণ্য চাল, তেল, ডাল থেকে শুরু করে টিসু্য ও কাপড় কাঁচার সাবানের দাম পর্যন্ত বেড়েছে। সেখানে সরকারি জরিপ সংস্থা বলছে দাম কমেছে। পরিসংখ্যান ও প্রতিবেদনের বাস্তবচিত্রটা ভুক্তভোগীরাই অবলোকন করছে। বর্তমানে চাকরিজীবীদের যে হারে বেতন বেড়েছে সে হারে পণ্যের দামও বেড়েছে অনেকাংশে বেশি, এমনটা বলছে চাকরিজীবীরা।
যার ফলে বেতন বেড়েও তেমন উপকারে আসেনি। সেজন্যই বিপাকে চাকরিজীবীরাও। এদিকে উপায়ন্তর না পেয়ে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তরা দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে আয় রোজগারের হিসাব মিলাতে না পেরে অবশেষে টিসিবি'র পণ্য বিক্রয় গাড়ির কাছে লাইন দেওয়া শুরু করেছে। টিসিবির ট্রাক ঘিরে ক্রেতাদের ভিড় বাড়ার ও হুরোহুরি করে পণ্য সংগ্রহের চিত্র কিছুদিন ধরেই গণমাধ্যমে আসছে। বেশ কিছু ভিডিও ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, মানুষ পণ্য কেনার জন্য ট্রাকের পেছনে দৌড়াচ্ছে নয়তো হুমরি খেয়ে পণ্য সংগ্রহের প্রচেষ্টায় অব্যাহত।
বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের এমন ভয়াবহ ও অসহনীয় ঊর্ধ্বগতি এবং মানুষের নাভিশ্বাসের বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, 'একমাত্র লুটপাটকারী কিছু লোক ছাড়া সমাজের সর্বস্তরের মানুষ খারাপ অবস্থায় আছেন। তাদের যে আয় তা দিয়ে সংসার কোনোভাবেই চলছে না। এ পরিস্থিতি কোনোভাবেই চলতে পারে না। সরকারকে রেশনিং প্রথা আবার চালু করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যদি সরকার কমাতে না পারে, তাহলে বাজারে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির সরকারি ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ছাড়া মানুষ বাঁচবে না। '
রক্ত দিয়ে লেখা, জীবন দিয়ে পাওয়া এ স্বাধীন দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বর্তমান অবস্থা দরিদ্র ব্যক্তিদের পক্ষে বজ্রাঘাততুল্য। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি করছেন। সরকারকে কঠোর হাতে অসাধু ব্যবসায়ীকে দমন করতে হবে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যতালিকা জনসম্মুখে বাজারে বাজারে টাঙানোর ব্যবস্থা করতে হবে। মূল্য তালিকানুসারে নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে কিনা তা সঠিক পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
সব বাজারে ও গঞ্জে দ্রব্যমূল্য মনিটরিং সেল গঠনের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার ও ব্যবসায়ীদের স্বদিচ্ছাই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কমতে পারে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির রাশ টেনে ধরতে শুধু সরকারকেই দায়ী করে হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকলে চলবে না। আমাদের সবার সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে বাজার সিন্ডিকেটদের প্রতি। দেশের সরকার ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কমিয়ে এনে নিম্নমধ্যবিত্তের দুর্গতি লাঘবে সচেষ্ট হতে হবে।
রায়হান আলী : আইনজীবী ও কলামিস্ট