আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি

প্রতিদিনই জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, রাজধানীর বাইরে চাষিরা তীব্র খরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ দলে দলে শহরে আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করছেন। অন্যপক্ষে ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞরাও দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা দুরূহ হয়ে পড়েছে।

প্রকাশ | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

রণেশ মৈত্র
তালেবানদের আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসার বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেল। নাটকীয়ভাবে আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহারের শেষ পর্যায়ে এসে দেখা গেল আইএসকে নামক এক নতুন জঙ্গি সংগঠন কাবুল বিমানবন্দরে গোলা নিক্ষেপ করে ১৩ জন মার্কিন সেনাসহ শতাধিক মানুষকে হত্যা এবং আরও শত শত মানুষকে মারাত্মকভাবে আহত করেছে। তাদের টার্গেট, যতদূর জানা যায়, আমেরিকা নয় বরং তালেবানরা। ওই জঙ্গিরা তালেবানদের চেয়েও নৃশংস এবং যথেষ্ট পরিমাণে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিতও বটে। তারা মারাত্মক এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সম্ভবত আইএসকে তারই জানান দিল ওই ভয়াবহ গোলাবর্ষণ এবং গণহত্যা চালিয়ে। আমেরিকার খোদ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দৃশ্যত এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করলেন এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জানালেন, তিনি এই ঘটনার প্রতিশোধ নেবেন। যথাসম্ভব জো বাইডেন ওই মর্মান্তিক ঘটনার প্রতিশোধ নিলেনও। জানানো হলো ওই হত্যালীলার মূল ষড়যন্ত্রকারীসহ দু'জন আইএসকে সদস্য নিতে। পরে জানা গেল ওই ঘটনায় কয়েকজন বেসামরিক লোকজনও মারা গেছেন। তা নিয়ে 'গণতন্ত্র'-এর আন্তর্জাতিক মুরুব্বী আমেরিকার মাথাব্যথা নেই- নেই বেসামরিক মানুষজন যারা মারা গেছেন বা আহত হলেন তাদের চিকিৎসা, সৎকার বা ক্ষতিপূরণের কোনো খবর। যেন এটা ডাল-ভাত এবং আফগানিস্তানের যে কোনো অঞ্চলে থাকে খুশি তাকে হত্যা বা আহত করার পরিপূর্ণ অধিকার তাদের রয়েছে। তালেবানরা এ ঘটনায় আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হানা হয়েছে বলে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করলেন অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে ব্যস, ওই পর্যন্তই। তালেবানরা কি আমেরিকানদের আফগানিস্তান থেকে বিতাড়িত করেছে? ঘটনাক্রম তা প্রমাণ করে না। তবে আমেরিকান সৈন্য ও তাদের নাগরিকদের অপসারণের সময়সীমা ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বেঁধে দেওয়া এবং তা আর বাড়ানো হবে না- তালেবানদের এমন প্রচারণায় এবং আমেরিকাও দ্রম্নততার সঙ্গে ওই সময় সীমার মধ্যে তড়িঘড়ি করে আফগানিস্তান ত্যাগ করা তাদের মধ্যে পরস্পর শত্রম্ন বলে ধারণা সৃষ্টি করতে চাইলেও বিদায়লগ্নে দেখা গেল আমেরিকা অত্যন্ত বশংবদের মতো বা শান্ত খোকার মতো সময়সীমার আগেই আফগানিস্তান থেকে চলে গেল এবং যাওয়ার বেলায় পুনরায় তারা বিপুলসংখ্যক উড়োজাহাজ, হেলিকপ্টার ধ্বংস সাধন করে গেল। জানান দিল, কাবুল বিমানবন্দর দিয়ে আমেরিকায় ফিরে যেতে মার্কিন সৈন্যরা ওই বিমানবন্দরে অবস্থারত অনেক হেলিকপ্টার উড়োজাহাজ অকেজো করে রেখে গেছে। তবে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র বিপুল পরিমাণে ফেলে রেখে গেছে এবং সেগুলো এখন তালেবানদের দখলে। মার্কিন-আফগান সম্পর্ক কেমন দাঁড়াবে? তার প্রাথমিক ধারণা আমেরিকার সেনা ও রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যে পাওয়া যায়। দেশে মার্কিন সেনারা ফিরে যাওয়ার আগ মুহূর্তে কাবুল বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু এই মুহূর্তে বলা না গেলেও এটা নিশ্চিত যে আমেরিকা তার জাতীয় স্বার্থে এ ব্যাপারে নীতি-নির্ধারণ করবে। অন্যদিকে সেনা প্রত্যাহার সম্পূর্ণ হওয়ার পর একজন শীর্ষ নেতা জানালেন, আমেরিকা আইএসকে উৎখাতে তালেবানদের সঙ্গে যৌথ অভিযান চালাতে প্রস্তুত। অন্যদিকে তালেবানরা পৃথিবীর সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাইছে। আমেরিকার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ভুলেও কোনো কথা তাদের কারও মুখ থেকে বেরোয়নি। বোঝাই যায়, বিষয়টা আপসের ভিত্তিতে ঘটেছে। এখন দেখা যাক, এই পরিবর্তনকে আফগানিস্তানের মানুষ কীভাবে গ্রহণ করেছে। তালেবানরা কতটা উদার হবে নতুন করে তাদের সরকার ও প্রশাসন গড়ে তোলার পরে- তা নিয়ে আফগান জনগণের মধ্যে সংশয়ের অন্ত নেই। হাজারে হাজারে আফগানরা নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে আজও পাকিস্তানসহ নিকটস্থ সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে চলে যাওয়ার প্রচেষ্টায় রত। বিশেষ করে নারীসমাজ। তারা ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের প্রথম তালেবানি শাসন ধর্মের নামে যে কট্টর নারীবিরোধী ভূমিকা দেখেছেন, নারীসমাজকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যেভাবে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা গড়ে তোলা হয়েছিল- দোররা ও পাথর নিক্ষেপ করে পথে-ঘাটে নারী নির্যাতন ও নারী হত্যার যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল- আফগানিস্তানে নারীসমাজ সেই স্মৃতি আজও ভোলেননি বরং তা মনে পড়লে অনেকেই আজও শিউরে ওঠেন। অবশ্য ঘোষণা করা হয়েছিল শরিয়তের নির্দেশ- মেয়েদের হেজাব পরে মেয়েরা এখন থেকে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও নানা কর্মস্থলে যেতে পারবেন। বাস্তবে তা হয়নি। তালেবানি শাসন মানুষের গ্রহণযোগ্য হবে কিনা তা নিয়ে আফগানিস্তান এখনো সংশয়াচ্ছন্ন। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক কর্তা সংস্থা ও বিবিসির খবরে জানা যায়, আফগানিস্তানে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শঙ্কা। এই শঙ্কাই এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। দেশটির জরুরি ভিত্তিতে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু দেশের বাইরে আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জব্দ হওয়া ১০০ কোটি ডলারে সহসাই হাত দিতে পারছে না তালেবানরা। ব্যাংকগুলো দু'সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিলেও নগদ অর্থ তোলার ক্ষেত্রে কঠোরভাবে সপ্তাহে অত্যন্ত সীমিত পরিমাণ অর্থ উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। রয়টার্সের খবরে জানা যায়, আফগানিস্তানের ব্যাংকগুলোতে দীর্ঘ লাইন দেখা যাচ্ছে, অর্থের মূল্য কমে যাচ্ছে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। কাবুলের অধিবাসীদের অভিযোগ, এখন সব কিছুর জন্যই চড়া দাম দিতে হচ্ছে। প্রতিদিনই জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, রাজধানীর বাইরে চাষিরা তীব্র খরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ দলে দলে শহরে আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করছেন। অন্যপক্ষে ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞরাও দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা দুরূহ হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে আফগানিস্তানের বৃহত্তম হেরাতের নারীরা নিজেদের অধিকার রক্ষায় রাস্তায় নেমে আন্দোলন শুরু করেছেন। বিগত ২ সেপ্টেম্বর হাতে পস্নাকার্ড নিয়ে হেরাত প্রদেশের রাস্তায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন তারা। নারী অধিকার কর্মীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং সরকারি কর্মচারীরাও যোগ দেন এ বিক্ষোভে। তালেবান শাসনে নারী সুরক্ষা, শিক্ষার সুযোগ, সরকারি কাজে অংশগ্রহণের অধিকার, তার স্বীকৃতি ও বাস্তবায়নের দাবিতে এ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন তারা। তাদের পস্নাকার্ডে স্পষ্ট লেখা ছিল, 'নারীদের ছাড়া কোনো সরকার স্থায়ী হতে পারে না। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের সমান অধিকার দেওয়া হোক।' গত দুই দশকে নারীরা অনেক সুযোগ পেয়েছেন, শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রভৃতি নানা অঙ্গনে নিজেদের অংশগ্রহণ বাড়িয়েছিলেন নারীরা। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর সব বন্ধ। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া নারীরা চেয়েছিলেন তালেবান সরকারের মন্ত্রিসভায় নারীদের স্থান দেওয়া হোক। কিন্তু তারা দেখতে পাচ্ছেন, তালেবানদের সভা-সমাবেশে নারীদের রাখা হয় না। একজন বিক্ষোভকারী বলেন, আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলতে চাই দয়া করে আপনারা আফগান নারীদের জন্য কিছু একটা করুন। অন্যদিকে তালেবানের শীর্ষ নেতা শের মোহাম্মদ আব্বাস স্তানিক জহি বিবিসিকে বলেছেন, তালেবান সরকারের শীর্ষপদে নারীদের রাখা হবে না। অথচ তারা নারীদের সরকারে রাখেনি। নারীদের আগের দৃষ্টিতেই দেখছে তারা। \হমার্কিনিদের আফগানিস্তান ত্যাগ, তালেবানি সরকার, প্রশাসন গড়ে ওঠায়, যে তীব্র অর্থনৈতিক ও খাদ্য সংকটের মধ্যে দেশটি নিপতিত হয়ে পড়েছে তা নিয়ে আফগানিস্তানের বিদেশি দাতারা অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। এই সংকট আরো তীব্র হওয়ার সম্ভাবনা। রণেশ মৈত্র : সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত