মেয়েশিশু কোলে নিয়ে কাঁদছে রোকসানা খাতুন। তার অপরাধ, তিনি কেন কন্যাশিশু জন্ম দিলেন! অপরদিকে হাসপাতালের বিছানায় ব্যথায়-যন্ত্রণায় ছটফট করছে হাতের কবজি কেটে দেওয়া ফাহিমা বেগম। তার অপরাধ, স্বামীর কথামতো গয়না বিক্রিতে কেন রাজি হননি ফাহিমা। সংবাদ মাধ্যমে রোকসানা ও ফাহিমা নামক দুই গৃহবধূর কান্নাজড়িত ছবি দেখে সহ্য করার মতো নয়। বিভিন্ন মিডিয়ায় ছবি দুটো দেখে কোনো পাষাণেরও মন কাঁদেনি বা হৃদয় ব্যথিত হয়নি এটা বিশ্বাস করতে পারি না। আমরা কোন সমাজে বাস করছি! মাঝে মধ্যেই এ ধরনের ছবি, সংবাদ দেখে রীতিমতো হতাশ ও আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার অবস্থা। এসব ঘটনা আমাদের মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে দেয়। দেশে সামাজিক মূল্যবোধ আজ এতই নিম্ন পর্যায়ে চলে আসছে- যা চিন্তার বিষয়। দীর্ঘদিন গর্ভজনিত নানামুখী কষ্টভোগ ও বাঁচা-মরার লড়াইয়ের পর যখন কোনো মায়ের কোলজুড়ে সন্তান আসে, সে সময়টা তার জন্য পৃথিবীর সবকিছু পাওয়ার চেয়েও বেশি আনন্দের হয়ে থাকে। অথচ সে সময়টায় রোকসানা খাতুনের স্থান হলো না স্বামীর বাড়ি, শুনতে হলো তালাকের খবর!
সম্প্রতি মানুষের প্রতি মানুষের হিংস্রতা, অমানবিকতা এত বেশি প্রকট আকার ধারণ করছে, যার জন্য মানুষ আর পশুতে কোনো ভেদাভেদ থাকছে না। পশুর মধ্যেও এত হিংস্রতা নেই, যতটা মানুষের মধ্যে দেখা যায়। মেয়েশিশু জন্ম হওয়ার কারণে ঘর থেকে বের করে দেওয়া, তালাক দেওয়ার সংবাদ শোনার পর বিশ্বাস হয় না যে আমরা মানুষ। মানুষের মধ্যে পশুর মতো এমন হিংস্রতা সত্যি মেনে নেওয়া যায় না। মানুষ আর পশু এক নয়। মানুষের বোধশক্তি আছে, যেটা কিনা একটা পশুর নেই। কোন কাজটা করলে ভালো হবে, আর কোনটা করলে খারাপ হবে এই বোধটুকু প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই থাকে, যেটা কিনা একটা পশুর মধ্যে থাকে না। কিন্তু বর্তমানে মানুষ এত বেশি বর্বর হয়ে গেছে, তার মধ্যে বিচার বিবেচনা বোধটুকুও লোপ পেয়েছে।
বলার, লেখার বা প্রতিবাদের ভাষা নেই! একটি মানুষে কী করে তার স্ত্রীর হাতের কবজি কাটতে পারে! হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার পিয়াইম গ্রামে স্বামীর কথামতো গয়না বিক্রিতে রাজি হননি ফাহিমা বেগম নামের এক গৃহবধূ। এ কারণে স্বামী শামীম মিয়া ফাহিমার হাতের কবজি কেটে দেয়। গুরুতর আহত অবস্থায় ওই গৃহবধূকে হবিগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঘটনার পর থেকে স্বামী পলাতক। ফাহিমার বড় ভাই আজিজুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, দুই বছর আগে পিয়াইম গ্রামের ব্যবসায়ী শামীম মিয়ার সঙ্গে তার ছোট বোন ফাহিমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই নানা সময় বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে দেওয়ার জন্য ফাহিমাকে চাপ দিত শামীম। একাধিকবার তারা টাকা দিয়েছেনও। এরপরও ফাহিমার ওপর শারীরিক নির্যাতন কমেনি। সম্প্রতি ফাহিমাকে তার গয়না বিক্রির জন্য চাপ দিয়ে আসছিলেন শামীম। কিন্তু ফাহিমা রাজি না হওয়ায় নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়ে। এ নিয়ে আবার কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে শামীম ঘরে থাকা দা দিয়ে ফাহিমার বাঁ হাতের কবজি কেটে ফেলে। পরে প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন ফাহিমাকে উদ্ধার করে প্রথমে মাধবপুর উপজেলা হাসপাতালে এবং পরে হবিগঞ্জের জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন।
একজন বিদুষী নারীর কত আশা-ভরসা, ভালোবাসা ও স্বপ্ন থাকে প্রিয় স্বামীকে নিয়ে। আর সে স্বামী যদি হয় এতো নিষ্ঠুর, নির্দয়, অমানুষ, তাহলে নারীরা কোথায়, কার ওপর আস্থা রাখবে। মানুষ যদি সে না হয় মানুষ! হবিগঞ্জের মাধবপুরের ঘটনা মধ্যযুগীয় বর্বরতারই প্রতিচ্ছবি। বিচারে আজ যদি ফাহিমার স্বামী শামীমেরও হাতের করজিটা কেটে দেওয়া হতো, তাহলে একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতো।
অন্যদিকে গাইবান্ধার সাদুলস্নাপুর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের ঘোড়ামারা গ্রামের স্বামীর বাড়ির উঠান থেকে রাতে নবজাতক ও গৃহবধূকে উদ্ধার করে পুলিশ। প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ার কারণে রোকসানা খাতুন (২৩) নামে এক গৃহবধূকে চার দিনের নবজাতকসহ তাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে শ্বশুর বাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে। রোকসানার পরিবার জানায়, এক বছর আগে রাজা মিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় রোকসানার। রাজা মিয়া ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। ডাক্তারি পরীক্ষায় কন্যাসন্তান হবে বলে জানতে পেরে স্বামী রাজা মিয়া ও তার পরিবারের লোকজন রোকসানার ওপর নানা ধরনের নির্যাতন চালাতে থাকে। মারপিট থেকে শুরু করে যৌতুক দাবিসহ নানাভাবে নির্যাতন করতে থাকে।
সম্প্রতি প্রসব ব্যথা উঠলে রাজা মিয়া স্ত্রী রোকসানাকে রংপুরের সালেহিন ক্লিনিকে ভর্তি করে টাকা-পয়সা না দিয়ে উধাও হয়ে যায়। সেখানে সিজারিয়ানের মাধ্যমে রোকসানা একটি ফুটফুটে কন্যাসন্তান জন্ম দেন। এদিকে টাকা দিতে না পারায় ক্লিনিক থেকে রিলিজ পাচ্ছিলেন না তারা। বাধ্য হয়ে রোকসানার মা বাড়ি থেকে টাকার ব্যবস্থা করে মেয়েকে নিয়ে তার স্বামী রাজা মিয়ার বাড়িতে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন বাড়ির সমস্ত ঘরে তালা দেয়া। একটি ঘরে তার শ্বশুর মহাব্বর মিয়া অবস্থান করছিলেন। তিনি কিছুতেই রোকসানাকে ঘরে উঠতে দিচ্ছিলেন না।
রোকসানা খাতুন বলেন, 'বেবি টেস্টে যখন তারা জানতে পারে গর্ভের সন্তানটি মেয়ে। তখন থেকেই তারা বলছে, মেয়ে নাকি ওদের না।' রোকসানার শ্বশুর মহাব্বর আলী বলেন, 'বাড়ির বউয়ের কাছে ঘনঘন বন্ধু আসে। বউয়ের চরিত্র খারাপ। তাই তাকে তিন মাস আগে তালাক দিছে আমার ছেলে।' পরে বিকালে রোকসানার শ্বশুর ও শাশুড়ি তাকে সাফ জানিয়ে দেয়, তিন মাস আগে তালাক দেওয়া হয়েছে তাকে।
মানুষরূপী অমানুষ রোকসানার স্বামী রাজা মিয়া যখন মেয়েশিশু জন্ম হওয়ার কারণেই ঘরে জায়গা না নিয়ে তালাক দেওয়ার কথা বলছেন, তাহলে রাজা মিয়া বিয়ের সময় কেন একজন নারীর দরকার অনুভব করলেন? সে কী নিজের চাহিদা অনুযায়ী ছেলেসন্তান বা মেয়েসন্তান বানাতে সক্ষম? কিছু মানুষের চিন্তাচেতনা ও রুচি এখন পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে গেছে। মনে হয়, আদিকালের জাহেলিয়াত যুগ আবার এসেছে আমাদের দুয়ারে! সন্তান জন্মের জন্য স্ত্রীকে দায়ী করা কতটুকু কান্ডজ্ঞানহীন ধারণা। এই আধুনিক সময়ে এসেও দেখতে হচ্ছে, এটা আমাদের মানসিক শিক্ষার বিকলাঙ্গতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
এরা সমাজ ও সভ্যতার শত্রম্ন। ধিক্কার জানাই এসব মানুষরূপী জানোয়ারদের। একই সঙ্গে গর্ভের শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। জন্মের আগেই শিশুর লিঙ্গ জানতে চাওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আইন পাস জরুরি। মেয়েটিকে আর্থিক সহায়তা হয়তো কেউ দেবে, কিন্তু সমাজ থেকে এ অপরাধ নির্মূল হবে কী? রোকসানার স্বামীকে আইনের আওতায় এনে ন্যায়বিচার করতে হবে। যেন ভবিষ্যতে এমন নিম্নমানের কাজ কেউই করার সাহস না করে।
এই উপমহাদেশে এখনো কন্যাশিশু অনাকাঙ্ক্ষিত! সবাই চায় ছেলে। আগেভাগে কন্যাশিশুর খবর জানলে অনেকেই তা নিতে চান না। গর্ভের শিশুর লিঙ্গ জানার পরেই অনেক কন্যাশিশুর অকালমৃতু্য হয় মাতৃগর্ভেই। একবিংশ শতাব্দীতেও কন্যাশিশু জন্ম দেয়ার 'অপরাধে' অনেক নারীকে হেনস্তার শিকার হতে হয়। অনেকের সংসার ভেঙে যায়।
সংসারে মেয়েরা যে কোনো বিবেচনায় ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে। নারীরা অনেক বেশি দায়িত্বশীল, সময়ানুবর্তী, সুশৃঙ্খল, মানবিক ও মমতাময়ী। একটা ছেলে শুধু একটাই চাকরি করে। আর কর্মজীবী নারীরা একসঙ্গে অফিস সামলায়, ঘর সামলায়, স্বজন ও সন্তানের দেখাশোনা করে থাকে। ছেলের সংসারে বাবা-মায়ের অনাদর-অবহেলা জোটার উদাহরণ ভূরিভূরি। কিন্তু কন্যার সামর্থ্য যেমনই হোক, কখনো বাবা-মাকে ফেলে দেয় না।
গ্রামগঞ্জে প্রকাশ্যে কন্যা সন্তানের জন্ম নেয়ায় মুখ কালো করার রীতি এখনো আছে। সমাজের কোনো কোনো অংশে এখনো কন্যাশিশুর জন্মটাকে সমাদৃত হয় না ঘটা করে। আবার একাধিক কন্যাশিশু জন্ম দেয়ায় অনেক মাকে সতিনের ঘর করতেও বাধ্য করা হয়। কোথাও কোথাও কন্যাশিশুকে বোঝা মনে করে জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গেই ডাস্টবিনে ফেলে দেয়ারও নজির আছে।
জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক দিয়ে বিশ্ব অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করলেও এখনো কিছু কিছু নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা মানব সমাজকে পীড়া দেয়। এর একটি হচ্ছে, মেয়েশিশু জন্ম হলে স্ত্রীকে নির্যাতন। আমরা সভ্যতার মুখোশ পরলেও প্রকৃত অর্থে সভ্য নই। যুগে যুগে নারীরা ছিল নির্যাতিত, অধিকারহারা, দাসী, বাঁদি, ভোগ্যপণ্য কিংবা মনোরঞ্জনের সামগ্রী। নারী কি মানুষ! না অন্য কোনো জীব- এটি নির্ণয় করাই ছিল বিস্ময়। রোমান সভ্যতার প্রাক্কালে নারীকে দাসী, গ্রিকদের কাছে বিকিকিনির পণ্য, খ্রিস্টানরা নারীকে শয়তানের প্রতিভূ মনে করত। আরব দেশে নারীদের সব দুঃখ-কষ্টের কারণ বলে গণ্য করে শিশুকন্যাকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। রাজা অষ্টম হেনরি নারীদের বাইবেল পড়া নিষিদ্ধ করেছিলেন।
নারীর অধিকার এবং সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ ও নারীর প্রতি সব বৈষম্য দূরীকরণে প্রণয়ন করা হয়েছে বিভিন্ন নীতি, বিধিমালা ও কর্মপরিকল্পনা। নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও ধর্ষণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনসহ নানা সহিংসতা দমনে রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যর্থতার পালস্না যেন দিন দিন আরও ভারী হচ্ছে। কখনো শ্লীলতাহানি, কখনো যৌন নির্যাতন, কখনো মেয়ে হিসেবে জন্মানোর জন্য চূড়ান্ত নিপীড়ন, আবার কখনোবা ধর্ষণ। সত্যিই ভালো নেই মহিলারা!
প্রতি বছর শিশুদের নিয়ে আন্তর্জাতিক শিশু দিবস, কন্যাশিশু দিবস পালন করা হয়। কিন্তু এত কিছুর পরেও টিভি বা খবরের কাগজের শিরোনাম হচ্ছে নির্যাতনের অনেক খবর। সমাজে অবহেলিত, নির্যাতিত, বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে অনেক শিশুরা। পারিবারিক ক্ষেত্রেও কন্যাশিশুর অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে না। শিশু সুরক্ষার জন্য শিশু নীতিমালা, শিশু অধিকার আইন ইত্যাদি করা হলেও এখনো রয়েছে কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্য। শিশুশ্রম রোধ ও তাদের সুরক্ষায় ঢাকঢোল পিটিয়ে কাজ করে যাচ্ছে সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা। ভূরিভূরি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে কাগজে-কলমে, কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে কতটুকু?
মোহাম্মদ আবু নোমান : কলাম লেখক